“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
by
·
Published
· Updated
আমার রবীন্দ্রনাথ
তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা কোনটি তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তা হবে আর একটি বিশ কি তিরিশ। খণ্ডের রচনাবলি এ নিয়ে নিশ্চিত থাকা যায়। কেন না প্রতিটি মানুষই আলাদা স্বভাব ও চরিত্রের, তাদের ভালাে লাগার রকমও আলাদা। কেউ তাঁর কবিতা নিয়ে উচ্ছ্বসিত, কেউ ছােটোগল্প, কেউ বা গান। আমার নিজের যেমন ভালাে লাগে রক্তকরবীর প্রতিটি পঙত্তি, প্রতিটি উচ্চারণ। এই নাটকের প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি অঙ্ক, তাদের উপস্থাপনা, এমনকী প্রতীকের ব্যবহার আমাকে নতুন ভাবে শেখায় এই মানবজীবনকে। এই সেদিনও শাঁওলি মিত্র বেহালার শরৎসদনে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে এক আসনে বসে শােনালেন গােটা রক্তকরবী, আর তা কী আশ্চর্য টানা পৌনে দু’ঘন্টা বসে শুনল এই এলাকার সাধারণ ঘরের মেয়ে-বৌ-রা, বাচ্চাকাচ্চা সমেত।
সাধারণভাবে আমাদের ধারণা ‘রক্তকরবী’ এতটাই প্রতীকী যে সাধারণ মানুষের বােঝার অগম্য। শম্ভু মিত্র যখন এই নাটক প্রথমবার প্রযােজনা করেছিলেন, মহড়া শুরু করার আগে তাঁর। অনেকটাই দ্বিধা ছিল এই নাটক সর্বসাধারণের গ্রাহ্য হবে কি না। তখন এমন একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রনাথের এই নাটক সবাই দেখবে তা ভাবাও হত না। ধ্রুপদী নাটকের দর্শক সীমিত এমন ভাবনার মধ্যেও শম্ভু মিত্র অনেক দ্বিতীয় চিন্তার পরে এই নাটক উপস্থাপিত করেছিলেন দর্শকের সামনে। তার পরের ঘটনার কথা সবাই জানেন, আর আজ তা একটি ইতিহাস।
শরৎসদনের গল্পটা প্রথমেই বললাম এ কথা জানাতেই যে একটি প্রতীকী উপন্যাস যা সাধারণভাবে আমরা ধরে নিই সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য, কিছুতেই সর্বজনগ্রাহ্য হবে না, সেই ভাবনাটি যে কতখানি উর্বর মস্তিস্কের তা শরৎসদনের অভিজ্ঞতাটি প্রমাণ করে দিয়েছে সেদিন। কয়েকদিন আগে আর একটি একক পাঠের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে শাঁওলি মিত্র জানিয়েছেন সেদিন কয়েকটি বাচ্চাও কেঁদে ফেলেছিল রক্তকরবী শােনার সময়ে, রঞ্জন আর পাগলভাইয়ের কথা ভেবে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার জন্য যতটা নয়, তাঁর গানের কারণেই আজ বাঙালির জীবনে নির্বাস-প্রশ্বাসের মতাে থাকছেন সারাক্ষণ। তাঁর যে গানই আমরা শুনি বা পড়ি না কেন, সেই গান আমাদের জীবনের কোনও না কোনও অনুভূতি ছুঁয়ে থাকে , আমাদের ভাবায়, ভাবতে শেখায়, কাঁপায়, কাঁদায়,আনন্দে উদ্বেল করে, উল্লসিতও করে কোনও নিভৃত মুহুর্তে।
পথে যেতে যেতে কোনও বাড়ির জানালা থেকে ভেসে এল আমি নিশিদিন তােমায় ভালােবাসি, তুমি অবসরমত বাসিয়াে’, অমনি কারও না কারও মুখ চকিতে ভেসে ওঠে আমাদের মনে যার উদ্দেশে কখনও না কখনও প্রেম নিবেদন করেছি আমরা, কিন্তু সেই প্রেম নিতান্তই একতরফা, কখনও হয়তাে ভাবিওনি সে আমাকে ভালােবাসবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে উসকে দিলেন সেই ভাবনাটি, ‘তুমি অবসরমত বাসিয়াে। কিংবা ঘরে বসে ক্যাসেটে শােনা গেল, ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’,
অমনি কারও না কারও মুখ মনে পড়ে যায়, কিংবা মনে হয়, হ্যাঁ, আমার হৃদয়েও তাে কোনও একজন নীরবে রয়ে গেছে যে আমাকে ‘ভরিবে গৌরবে পূর্ণিমানিশীথিনাসম’, রবীন্দ্রনাথ কী করে যে জেনে গেলেন সেই গােপন কথাটি! । অথবা পথে যেতে যেতে সাউন্ডবক্সে কানে এল ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় তুমি করুণাধারায় এসাে, হঠাৎই কিছুটা উদ্বেল হয়ে উঠি কেন না কেউ না কেউ তখন আমাদের ভাবনে ধীরপায়ে প্রবেশ করেছে তা আমাদের মনে পড়ে, যে আমাকে ভরিয়ে তুলছে, প্রেরণা জোগাচ্ছে, কিংবা আর কেউ না থাকলেও রবীন্দ্রনাথই তাে তখন আমাদের আত্মস্থ করছেন তিনিই আমাদের সকল রসের ধারায় আছেন হৃদয়ে, সত্ত্বায়, চেতনায়।
এমন বহু বহু পঙক্তি নিয়ে সারাদিন কোনও মানুষ যদি নাড়াচাড়া করেন তাে তাঁর সমস্ত ভাবনা একতারে বাঁধা হয়ে যাবে রবীন্দ্রগানের সঙ্গে।
কিংবা কেউ হয়তাে পছন্দ করেন তাঁর অসাধারণ সব ছােটোগল্পের সঙ্গে যা পড়তে গিয়ে তিনি একাত্ম হয়ে যান কোনও চরিত্রের সঙ্গে, কোনও অনুষঙ্গ মিলে যায় তাঁর জীবনের কোনও ঘটনার সঙ্গে , কিংবা সামাজিক কোনও ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে।
আর তাঁর নৃত্যনাট্যগুলিই তাে আজও এই বাংলার হাজার হাজার নৃত্যশিল্পীদের একান্ত আশ্রয়। এখনও রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে আমরা কতদূর এগােতে পেরেছি এই বাংলা সাহিত্যের বিশেষ আঙ্গিকটি ছেড়ে তাও আজ ভেবে দেখার বিষয়।
এ হেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনেকেরই জীবনে সেই শৈশবে প্রবেশ করে দিনে দিনে মহীরুহ হয়ে যাচ্ছেন ভাবনায়-চেতনায় কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ তাে প্রথমে একটা ফর্মুস্রোতের মতাে, তারপর যত দিন গেছে তার স্রোতে সঞ্চারিত হয়েছে গতি, জাগিয়েছে উন্মাদনা, সম্মােহন,ক্রমে রবীন্দ্রনাথ দামামার মতাে দু-কূল ভাসিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন সমগ্র সত্ত্বা।
হয়তাে আমার মতাে অনেকেরই একই অভিজ্ঞতা, যেমন একটা ক্যালিডােস্কোপ হাতে পাওয়ার পর গােটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তােলপাড়। হাতের চোঙ ঘােরালেই পলক না ফেলতে একটা রঙিন পৃথিবী, আর একটু ঘােরালেই আগের ছবিটা ভেঙে তছনছ, আবার নতুন ছবির প্রাপ্তি। এমন সারাদিনে সারাক্ষণ অজস্র, অসংখ্য ছবির মালিক হয়ে কী অসম্ভব সমৃদ্ধ মনে হত সেই শৈশবের নিজেকে, সেরকমই রবীন্দ্রনাথ।
ঠিক কবে মনে নেই, স্কুলে পড়াপড়ির দিনগুলিতে প্রথমবারের মতাে সঞ্চয়িতা হাতে পেতে আর একবার এমন আশ্চর্য শিহরন। বইটা আমাদের নিজস্ব ছিল না, কয়েকদিনের জন্যে প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে পড়তে এনে শুরু করি। কখন যেন হাত থেকে খসে গেল ক্যালিডােস্কোপ। সমৃদ্ধ হতে শুরু করলাম এমন এক পৃথিবীর অভিজ্ঞতায় যা আমার ধারণাতেই ছিল না। হঠাৎই অনেকটা বড় হয়ে গেলাম মানসী’ ‘সােনার তরী’র পৃথিবীতে পৌঁছে গিয়ে। বহু দিন বহু রাত নিমগ্ন করে রাখল সেই অক্ষরসমূহ।
সেই অক্ষর সর্বগ্রাসী, বনের মতাে দুর্নিবার, এলােঝড়ের মতাে তছনছ করে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ এক বালককে কী দ্রুত সাবালক করে দিতে পারেন তা ভুক্তভােগীরাই জানেন। পাশাপাশি কিছু অক্ষর সাজানাের কৌশলে তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা যায় তা ঠিকঠাক উপলব্ধি করা গেল রবীন্দ্রনাথে পৌঁছে। অক্ষরের এত শত্তি, অক্ষর যে ব্রহ্মের সমান তা রবীন্দ্রনাথ বােঝালেন মগজে পেরেক গেঁথে। দিন দুয়েকের মধ্যে মনে হল এই বইটা সর্বক্ষণ আমার কাছে থাকা প্রয়ােজন। মাস্ট। কিন্তু পরিবারে অর্থনৈতিক দুর্দশা এমন ছিল যে, সঞ্চয়িতা কেনা মানে ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা। বইটা প্রতিবেশীর কাছে ফেরত দেওয়ার পর অনেকদিন ফতুর হয়ে থাকি। ফুটবল খেলতে গিয়ে ৫-০ হেরে বাড়ি ফেরার মতাে। বইটার দাম দশটাকা। দ—শ টাকা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। টাকার দাম সােনার চেয়ে বেশি।
কীভাবে এতগুলাে টাকা জোগাড় করা যায় তা ভেবে রাতের ঘুম হাওয়া। অন্তত একটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা না করলে আমার পথে এ টাকা হাতে পাওয়া অসম্ভব। পাঁচবছরে টিফিনবাবদ যেখানে যা পয়সা পাওয়া যাবে তা একত্র করে কোনও একদিন সঞ্চয়িতা কিনব এমন দুরাশা নিয়ে পাড়ি দিতে থাকি রবীন্দ্রবিহীন দিন।।
ততদিনে দশ থেকে বারাে, বারাে থেকে চোদ্দ টাকা দাম হয়ে গেল আলাদিনের প্রদীপটার। মরীচিকা হয়ে যেতে থাকা বইটার কথা ভুলে যেতে বাধ্য হই। এখান থেকে ওখান থেকে হাতে পৌঁছে যেতে থাকে ‘শিশু’ ‘পুনশ্চ’ ‘পলাতকা। তারপর একে একে আরও বহু রবীন্দ্রনাথ হাতে উঠে আসার পর আরও আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা।
এই কোলাহলের মধ্যে হঠাৎ আমাদের জীবনে পৌঁছে গেল এক পঁচিশে বৈশাখ। মফস্বল গ্রামটিতে কোথাও তেমন রবীন্দ্র আবহ ছিল না। তার মধ্যেই আমরা কয়েকটি কচিকাঁচা ঠিক করলাম আমাদের বাড়ির সামনেই ছােট্ট মাঠটায় পালন করব রবীন্দ্রজয়ন্তী। দুঃসাহস তাতে সন্দেহ নেই। ভালাে করে রবীন্দ্রনাথ পড়িওনি তখনও। পাঠ্যপুস্তক পেরিয়ে সঞ্চয়িতার কিছু কবিতা পর্যন্ত দৌড়।
কারও বাড়ি থেকে একটা চৌকি জোগাড় করে সেটি মাঠের একদিকে পেতে তার উপর সতরঞ্চি বিছিয়ে বানানাে হল মঞ্চ। পাড়ার দিদি-বৌদি-কাকিমা-জ্যেঠিমা কে কবে কনে-দেখানাে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলেন তা খুঁজতে বেরােনাে হল। তৈরিও হয়ে গেল একটা নাতিদীর্ঘ তালিকা। আমরা ছােটরা কে কোন কবিতা আবৃত্তি করব তা নিয়ে ঘাের উত্তেজনা। আমার আবার কবিতা মুখস্থ থাকে না। অর্ধেক বলার পরেই ভুলে যাই পরবর্তী লাইন। এর আগে একবার বাইরের এক স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযােগিতায় নাম দিয়ে কী ভােগান্তি। অর্ধেক কবিতা পড়ার পর বেমালুম ভুলে গেলাম বাকি লাইনগুলাে।স্ক্রিনের পাশ থেকে প্রম্পট করেও এক যুবক মনে করাতে পারেনি বাকি লাইন। আসলে প্রম্পটার বার দুই বলার পরেও মনে হচ্ছিল শুনতে পাচ্ছি না সঠিক শব্দগুলাে। বাধ্য হয়ে প্রবল হাস্যধ্বনির মধ্যে নেমে আসতে হয়।
কোনও ঝুঁকি না নিয়ে এবারে আমি ঠিক করলাম কবিতা আবৃত্তি নয়, পাঠ করব। বই দেখে। পড়লে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমি একটা রবীন্দ্রসংগীতও গাইব খালি গলায়। একজন খাবি খায়, ‘তুই গান গাইবি ? তাও রবীন্দ্রসংগীত! বলি, কেন, আমি তাে বাড়িতে গুনগুন করে গাই, তুমি কেমন করে গান করাে হে গুণী। ওই গানটাই গাইব। সম্পূর্ণ মুখস্থ।
শুনে কে একজন বলল, দেখিস, স্বরচিত রবীন্দ্রসংগীত গাস নে যেন। এই আশঙ্কাটা অমূলক তা নয়। একটা সত্যকাহিনীও আত্মগােপন করে আছে এর পিছনে। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর থেকে আমার কবিপ্রতিভা বৃদ্ধি পেতে থাকে। স্কুলে পরীক্ষার খাতায় যত বাংলা রচনা লিখেছি, তাতে প্রতিবারই চারপাঁচটা কবিতার উদ্ধৃতি থাকেই, তাতে আমি প্রতিবারই লিখি, এইজন্যেই কবি বলিয়াছেন—
অতঃপর যে কবিতাটা আমি কোটেশন চিহ্নের মধ্যে লিখি তা অবশ্যই আমার স্বরচিত। কোনওটা গদ্য কবিতা, কোনওটা ছন্দ মিলিয়ে লিখি বৈচিত্র্য আনতে যাতে পরীক্ষক না ধরতে পারেন। কখনও পেরেছিলেন বলে জানতে পারিনি। কারণ রচনায় হায়েস্ট পাওয়াটা ছিল আমার বরাদ্দ। নিশ্চয়ই উদ্ধৃতির আধিক্যের কারণেই। কিন্তু এই কৌশলটা আমার কোনও এক নিকটবন্ধুকে বলতে সে সারা জায়গায় রাষ্ট্র করে দেয় আমার রচনায় হায়েস্ট পাওয়ার কৌশল। তখন আমাকে আরও নিদারুণ সব উদ্ধৃতি রচনা করতে হত পরীক্ষায়। তাতে আমার কবিপ্রতিভারও শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে দিনদিন।
যাই হােক মঞ্চে বসে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নাকি রবীন্দ্রলাঞ্ছনা করা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা আমার সেই ক্ষুদ্র জীবনে। একটি লাইনও মিস হয়নি। সুর কীরকম হয়েছিল সে বৃত্তান্ত বেশি বলাই ভালাে। আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল গানটা ঠিকঠাক মুখস্থ গাওয়া।।
মঞ্চে রবীন্দ্রসংগীত লাঞ্ছনা আমার সেই শেষ নয়। পরে আরও একবার উঁদিপুরে পিকনিক করতে গিয়ে অফিসকর্মীদের স্ত্রীদের অনুরােধে গাইতে হয়েছিল সে বৃত্তান্ত স্বতন্ত্র।
শৈশবে অনুষ্ঠিত সেই রবীন্দ্রজয়ন্তীর সন্ধেয় কবিতায় গানে বক্তৃতায় এমন জমে গিয়েছিল যে। পরদিন পাড়ায় আমাদের মতাে খুদে উদ্যোক্তাদের জয়জয়কার। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঢুকে গেলেন। পাড়ার নিরক্ষরদের কাছেও। পাড়ার এক জেলেবৌ টিউবওয়েলে কলসি কাঁখে জল আনতে এসে হাসি হাসি মুখে বলেছিলেন, তুমাদের ওই রবিন্দোজয়ন্তী কিন্তু বেশ আমােদ দিইছিল আমাদের।
তবে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে ঢুকলেন কয়েক বছর পরে শতবর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে। সেই মফস্বলেও কী জমজমাটি গান ও আবৃত্তির আসর। গার্লস স্কুলের সামনের মাঠে মস্ত প্যান্ডেল করে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরের আর্টিস্ট সহযােগে রবীন্দ্রজয়ন্তী শােনা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। চারপাশের এলাকার সংস্কৃতিপ্রেমীরা চুটিয়ে উপভােগ করলেন এক মফস্বল সেমিশহরের রবীন্দ্রচর্চা।
সেবারই আমাদের বাড়ি প্রথম সঞ্চয়িতার আগমন। শতবর্ষের সেই প্রাপ্তির সঙ্গে অনেকটা জড়িয়ে আছে আমার কররেখার সাহিত্যযােগ। সেই চোদ্দ টাকা সংগ্রহের ইতিহাস আমার জীবনে। অসামান্য। তার কিছুকাল পরেই আরও প্রবল প্রাপ্তি রবীন্দ্ররচনাবলীর গ্রাহক হওয়া। চল্লিশ বছরেরও আগে কেনা সেই সঞ্চয়িতা, তারপর পনেরাে খণ্ডের রবীন্দ্ররচনাবলী, কী আশ্চর্য, আজও আমার বইয়ের তাকে জাজ্বল্যমান। জাজ্বল্যমান এই বিশালকায় হাতুড়ি পেটানাে শব্দটা ব্যবহার করতে ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে। রবীন্দ্রনাথ তাে তার পর থেকেই আমার শয়নে স্বপনে জাগরণে সত্যিই আমার। অস্তিত্বে জাজ্বল্যমান।
একসেট রচনাবলীর যে কী অসম্ভব কার্যকারিতা তা আজও আমার কাছে এক বিস্ময়। আমার জীবনের লেখালেখির পর্বে বইয়ের ভূমিকার কথা বারবার বলতে ইচ্ছে হয়। চারপাশে বইয়ের পাহাড় না থাকলে আমার মগজ যেন ঠিকঠাক কাজ করে না। যখনই লিখতে গিয়ে মনে হয়, নাহ্, যা লিখতে চাই তা আসছে না কলমের ডগায়, তখনই এক মুগ্ধ বিস্ময়ে আমি তাকিয়ে থাকি আমার কয়েক আলমারি বইয়ের দিকে। বিখ্যাত সব লেখকদের বই থেকে সারাক্ষণ এক অদ্ভুত রশ্মি তীব্রগতিতে বিচ্ছুরিত হতে থাকে বলে আমার বিশ্বাস। সেই রশ্মি ক্রমাগত সেঁধিয়ে যেতে থাকে আমার শরীরে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই আমার শরীরে ভরে উঠতে থাকে নতুন প্রেরণা, মেধায় সঞ্চারিত হতে তাকে নতুন বৈভব।
আমার গােটা কৈশাের, যৌবনের একটা বড় অংশ রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী আমাকে এভাবেই সাহায্য করে গেছেন আমাকে গড়ে উঠতে। আজও করেন।
রবীন্দ্রনাথের এ হেন সর্বগ্রাসী প্রভাব আমার মতাে বহু বাঙালিকেই গ্রাস করে রেখেছে গােটা জীবন, শুধু কি বাঙালিকেই ভারতের এমনকী পৃথিবীর বহু কোণে বহু বিদেশিও আজও রবীন্দ্রচর্চায় রত। কারণ যিনি একবার রবীন্দ্ররচনায় অবগাহন করবেন তাঁর তাে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অব্যাহতি নেই।