• Uncategorized
  • 0

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় তন্ময় সরকার

জাতীয়তাবাদ, দ্বিজাতিতত্ত্ব ও একুশে ফেব্রুয়ারি

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জড়ো হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নারী, বৃদ্ধ, এমনকি শিশুরাও। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চালার সয়ং। জড়ো হয়েছে একটা লড়াইয়ের শপথ নিয়ে। সামনেই পুলিশ ব্যারিকেড। গেটের কাছে পুলিশ অপেক্ষা করছে, আর এখানে স্লোগান উঠছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এ লড়াই এবং তার পরবর্তী ইতিহাস আমরা সকলেই জানি— একবুক রক্তের সাগরে সারা বিশ্ব দেখল বাংলার সূর্যোদয়।
ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির পেছনে মূল যে ইস্যুটি ছিল তা হল— মাতৃভাষার জন্য এই প্রথম কোনও জাতি রক্ত দিয়েছে। এ একটা দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই দৃষ্টান্তের উৎস কোথায়? এর অনুপ্রেরণা কোথায়? কীসের জন্য ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে মানুষ পুলিশের গুলির সামনে এগিয়ে গেল?
একটা ঔপনিবেশিক শাসন ছিল আমাদের ভারতবর্ষে। ইংরেজরা শাসন করত। এখান থেকে ধন-সম্পদ-মানুষের শ্রম লুট করে তারা নিয়ে যেত— এই ছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক পুঁজির চরিত্র। আর আমরা ছিলাম তাদের পদদলিত— আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের জীবন— সমস্ত কিছু। বিকাশের কোনও পথ ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ইংরেজ রাজ শক্তির বিরুদ্ধে যে লড়াই সংগ্রাম ভারতবর্ষের মাটিতে হয়েছিল তার মূলত দু’টি ধারা ছিল। একটা আপোষহীন ধারা, একটা আপোষকামী ধারা। ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেন, ভগৎ সিং, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, বনয়-বাদল-দীনেশ, আসফাকুল্লা প্রমূখরা ছিলেন এই আপোষহীন ধারার প্রতিনিধি। এবং গান্ধীজীর নেতৃত্বে যে ধারা গড়ে উঠেছিল তা ছিল আপোষকামী ধারা। আপোষহীন ধারার মূল বক্তব্য ছিল— অনুনয়-বিনয় নয়, ভিক্ষাবৃত্তি নয়; আপোষহীন লড়াই করে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে এবং সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটাতে হবে। কিন্তু যখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা এসেছে তখন ভারতবর্ষ ও বিশ্বের অর্থনীতি-রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে নবজাগরণের চিন্তাকে হাতিয়ার করে উজ্জ্বল প্রগতির মশাল নিয়ে পুঁজিবাদ এসেছিল। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানুষের মনুষ্যত্বকে, মানুষকে সে স্থান দিয়েছিল। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের অধিকারের স্লোগান নিয়ে সারা বিশ্বে পুঁজিবাদী অর্থনীতি আবির্ভূত হয়েছিল। জ্ঞানে বিজ্ঞানে সংস্কৃতিতে সে এনেছিল এক বিরাট প্রগতিশীল পরিবর্তনের ঢেউ। কিন্তু সেই ঢেউ ভারতীয় উপকূলে এসে পৌঁছেছিল অনেক দেরিতে। ভারতে যখন এই নবজাগরণের আলোকে আলোকিত হয়ে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্রদের হাত ধরে পার্থিব মানবতাবাদী ধারা এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদের যৌবন গিয়েছে চলে। পুঁজিবাদ তার নিজের অর্থনীতির নিয়মেই তখন সংকটগ্রস্থ। বাজার নেই, বেকারী, অতিউৎপাদন, চারিদিকে শ্রমিক বিক্ষোভ। তাই তখন সে আর উদাত্ত কণ্ঠে মানব মুক্তির কথা বলতে পারে না, সব রকম শোষণের অবসানের কথা বলতে পারে না। যে ধর্মীয় সংকীর্ণতা, মধ্যযুগীয় সামন্তীয় অবক্ষয়ী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে পুঁজিবাদ ক্ষমতায় এসেছিল, সে এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে সেগুলোই ফিরিয়ে আনতে চাইছিল নিজের অস্তিত্বকে রক্ষার তাগিদে। ইতিমধ্যে দেশীয় বাজার সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে সে নতুন নতুন ভূখণ্ডে পুঁজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বাজার দখল করার জন্য। এভাবে পুঁজিবাদ তখন তার সাম্রজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে শোষণের হীন অস্ত্র ‘সাম্প্রদায়ীকতা’রও জন্ম দিয়েছে সে। সেই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রভাব এসে পড়েছে ভারতবর্ষে। রামমোহন বিদ্যাসাগরদের পার্থিব মানবতাবাদের ধারা তাই তখন রুদ্ধ হয়েছে। ভারতবর্ষ থেকে সামন্ততন্ত্র তখনও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি। ধর্মকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার দ্বারা এসেছে ধর্মভিত্তিক জাত্যাভিমান। তৎকালীন ভারতবর্ষের যে বিকাশমান জাতীয় পুঁজি, তাই সে গড়ে উঠেছে সাম্রজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সাথে আপোষ করে। সেজন্য আপোষহীন ধারার উপর নয়, টাটা-বিড়লারা তখন ভরসা রেখেছে আপোষপন্থী গান্ধীজীদের উপর। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষ পেয়েছে তার স্বাধীনতা।
এই জন্য সেই দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আমরা যে স্বাধীনতা পেলাম সেই স্বাধীনতা ছিল একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে। যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে শহিদ ক্ষুদিরাম ফাঁসীর মঞ্চে হাসি মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন, ফাঁসীর মঞ্চে সাম্যের জয়গান গেয়েছিলেন শহিদ-ই-আজম ভগৎ সিং, সেই স্বাধীনতা আমরা পাইনি। স্বাধীনতা এসেছিল ভারতীয় জাতীয় পুঁজির প্রত্যক্ষ মদতে একদল আপোষপন্থী ক্ষমতালোভী মানুষের হাত ধরে। মুনাফা লোটার উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে বাজার দখলের জন্য রেষারেষির জেরে পুঁজিপতিরা দেশটাকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল। এবং এই ভাগটা করেছিল অবক্ষয়ী পুঁজিবাদ-সাম্রজ্যবাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হয়েছিল— সেই তত্ত্ব বলেছিল, যারা হিন্দু তারা ভারতবর্ষে থাকবে, আর যারা মুসলমান তারা থাকবে পাকিস্তানে। ভারতবর্ষের সংবিধানে পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এসেছে ঠিকই, কিন্তু মূল বক্তব্য ছিল এটাই—ধর্মের ভিত্তিতে দেশটাকে ভাগ করে দাও। কিন্তু সত্য হল, সাধারণ মানুষ এমন বিভাজন চায়নি। এই বিভাজন করা হয়েছিল কৃত্রিমভাবে ও জোরপূর্বক। পাকিস্তানকে আরও অদ্ভুতভাবে ভাগ করা হল, একটা এই প্রান্তে আর একটা ঐ প্রান্তে। দুটো ভূখণ্ডের মধ্যে দূরত্ব ২২০০ কিলোমিটার। কিন্তু এই ভাগ কত নিষ্ঠুর ছিল আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি। একই বাংলা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল, একই পাঞ্জাব দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। একই দেশের মানুষ, একই সংস্কৃতিতে, একই জলে-মাটিতে বড় হওয়ার মানুষ দুটো দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ল। কেউ কারোর মুখ দেখবে—সে অধিকার নেই, কাঁটাতারের বেড়া গজিয়ে উঠল মাঝখান দিয়ে। এ-ভাই এ-পাশে, ও-ভাই ও-পাশে। আজও সেই আত্মীয়তার টানে মানুষ যাচ্ছে আর আসছে। সেই ভোগান্তি আমরা আজও ভুগছি।
এই যে বলা হচ্ছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশটাকে ভাগ করা হল—এই বিভাজন ছিল কৃত্রিম, এর মধ্যে ভুল ছিল, একটা গলদ ছিল, কী সেই গলদ? সেটা হচ্ছে— ধর্মকে জাতির নির্ণায়ক ভূমিকা হিসাবে খাঁড়া করা। ধর্ম কখনও কোনও জাতির নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না। ধর্ম সবসময়ই ছিল মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও পালনের বিষয়। ধর্ম কখনও রাষ্ট্র বা জাতির বিষয় হিসাবে ছিল না। একটা জাতির নির্ণায়ক ভূমিকা কী? একটা জাতি গড়ে ওঠে কীসের ভিত্তিতে? স্ট্যালিন তাঁর ‘মার্কসবাদ ও জাতি সমস্যা’-তে বলেছেন, “জাতি হল ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট স্থায়ী জনগোষ্ঠী। একটা অভিন্ন ভাষা, অঞ্চল, অর্থনৈতিক জীবন আর সাধারণ সংস্কৃতিতে প্রকাশিত মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ভিত্তিতে এটি তৈরী হয়।” [জে ভি স্ট্যালিন, নির্বাচিত রচনাবলি, প্রথম খণ্ড, প্রমিথিউস পাবলিশিং হাউস, পৃঃ ১১৮] “এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সবক’টা একসাথে থাকলে তবেই আমরা একটা জাতি পাব।” [ঐ, পৃঃ ১১৯]
জাতীয় পুঁজি জাতীয় বাজার সৃষ্টি করে। এই জাতীয় বাজার অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আধুনিক জাতি। তাই পুঁজিবাদ যখন ছিল না তখন জাতীয় বাজার ছিল না, এবং আধুনিক জাতিও ছিল না। সুতরাং পুঁজিবাদী অর্থনীতির উৎপত্তি ও বিকাশের সাথে সাথে জাতিরও উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। সেজন্যই স্ট্যালিন বলেছেন যে ‘জাতি হল ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট জনগোষ্ঠী’। ইতিহাসের বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে বিশেষ অর্থনীতিকে ভিত্তি করে সে গড়ে উঠেছে; সেই সাথে অবশ্যই চাই একটি ভাষা, একটি অখণ্ড ভূখণ্ড, আর একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি। এই শর্তগুলো পূর্ণ না হলে কখনই একটি জাতি গড়ে উঠবে না।
সমস্ত বিশ্বে আমরা যেকোনও জাতিকে দেখলেই বুঝব এভাবেই তারা গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং জাতি একই সাথে গড়ে ওঠে। এইভাবে গড়ে ওঠা একটিমাত্র জাতি নিয়ে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে। আবার বহু জাতিসত্তা নিয়ে ভারতবর্ষের মত একটি বহুজাতিক রাষ্টও সৃষ্টি হতে পারে। এই বহু জাতিসত্তা নিয়ে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটি বন্ধনে তারা আবদ্ধ থাকে। সে বন্ধন হল একটি অভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধন, কোনও অবস্থাতেই কোনও সম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় বন্ধন নয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ভারতবর্ষের এক জাতিসত্তার সাথে অন্য জাতিসত্তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে। ভারতবর্ষকে শাসন করার স্বার্থে ইংরেজ সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। আর সেই যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বহু জাতিসত্তাকে একত্রিত করে বেড়ে উঠেছে ভারতের জাতীয় পুঁজি। কারণ কোনও একটি জাতিসত্তার পুঁজি এককভাবে জাতীয় পুঁজি হিসাবে বিকশিত হওয়ার মত শক্তিসামর্থ তখনও অর্জন করতে পারেনি। এই জাতীয় পুঁজির বিকাশকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এক বহুজাতিভিত্তিক জাতীয়তাবোধ। এই কারণেই আমরা একই সাথে বাঙালি এবং ভারতীয়। এই সম্পর্কে স্ট্যালিনের বক্তব্য আমাদের ধারণাকে আরও স্পষ্ট করবে, “রাষ্ট্র গঠনের এই বিশেষ পদ্ধতিটি (বহুজাতীয় রাষ্ট্র গঠনের পদ্ধতি-লেখক) কেবল সেখানেই দেখা যায় যেখানে সামন্ততন্ত্র তখনো ধ্বংস হয়নি, পুঁজিবাদের বিকাশ অতি ক্ষীণ, পেছনে পড়ে থাকা জাতিসত্তাগুলো তখনো নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে সুগঠিত করে একক জাতিতে পরিণত হয়নি।” [ঐ, পৃঃ ১২৩]
সুতরাং জাতি ও রাষ্ট্র যেভাবেই গড়ে উঠুক ধর্ম কখনই সেখানে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেনি। কোনও একটা মানবগোষ্ঠীকে কেউ বলে দিল, ‘তুমি পাকিস্তানি কারণ তুমি মুসলমান, তুমি ভারতীয় কারণ তুমি হিন্দু’—এটা কোনোভাবেই ইতিহাসসম্মত নয়। জাতি গঠনের ঐতিহাসিক ভিত্তির সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এই বিভাজন নিঃসন্দেহে কৃত্রিম। বাস্তবে তখন ভারতীয় জাতিগুলোর মধ্যে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বন্ধন ছিল তাতে একটি মাত্র রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারত, কখনই দুটো রাষ্ট্র নয়। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের কিছুদিনের মধ্যেই এই অন্তঃসারশূন্য বিভাজন কতখানি জনস্বার্থবিরোধী তা প্রকট হয়ে দেখা দিতে লাগলো বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যার মাধ্যমে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ ছিলো বাঙালি এবং কে কোন ধর্মের— হিন্দু নাকি মুসলমান—  তার চেয়ে বড়ো পরিচয় নির্ধারক বিষয় ছিলো যে তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, একটা ‘সাধারণ সংস্কৃতিতে প্রকাশিত মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ভিত্তিতে’ তারা ঐক্যবদ্ধ। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে একটি পাকিস্তান-জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা সামগ্রিক সম্পূর্ণতা পায়নি। এই না-পাওয়ার কারণ হিসাবে এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ বলেছেন, “কতকগুলো কারণে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান মিলে এক পাকিস্তান জাতীয়তাবোধ ও মানসিকতা গড়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ, প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার দূরত্ব বিরাট এবং ভৌগলিক দিক থেকে একে অপরের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের দুই প্রান্তের মধ্যে সংস্কৃতিগত অর্থেও একটা মিল গড়ে তোলা দুরূহ ব্যাপার হয়ে গেল। কারণ, ভাষা ও সংস্কৃতিগত দিক থেকেও একের সাথে অপরের কোন  মিল নেই। তাছাড়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানের বিকাশ, শিল্পোন্নয়ন এবং আর্থিক অগ্রগতির জন্য পূর্ববাংলাকে প্রায় একটি ‘কলোনি’তে পর্যবসিত করে ফেলেছিল।” [শিবদাস ঘোষ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে, পৃঃ ৬-৭]
হ্যাঁ, আমরা দেখতে পেলাম, এই পূর্ব পাকিস্তানকে (অধুনা বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তানিরা একটা উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করল। ঠিক যেরকমভাবে ইংরেজরা আমাদের দেশকে উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করত। এর মূল কারণ হল অভিন্ন পাকিস্তান-জাতীয়তাবাদ গড়ে না ওঠা। এই বিচ্ছিন্নতাই সবল জাতিসত্তার পুঁজিকে দুর্বল জাতিসত্তার উপর ঔপনিবেশিক শোষণ-নিপীড়ন নামিয়ে আনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর যদি কোনও শাসকগোষ্ঠী অন্য ভূখণ্ডকে উপনিবেশ হিসাবে  শোষণ করতে চায়, তাহলে তাকে কী করতে হবে? ইতিহাসে সবসময়ের জন্য আমরা দেখেছি, যখন কোনও অত্যাচার এসেছে, যখন কোনও শাসন-শোষণ এসেছে, সে প্রথম আঘাত এনেছে শোষিতের সংস্কৃতির উপর, তার শিক্ষার উপর, তার ভাষার উপর। ভাষা যদি সে শিখে যায়, সত্যিরকারের জ্ঞান যদি সে অর্জন করে ফেলে তাহলে তার চোখ খুলে যাবে। তখন এই শোষণের রাজত্ব আর চলবে না। তাই মানুযের জ্ঞানজগতকে সে ধ্বংস করে দিতে চায়, মানুষের প্রগতিশীল চিন্তাকে মেরে ফেলতে চায়, মানুষের বিবেককে অন্ধ করে দিতে চায়, মানুষের মুখের ভাষাকে সে কেড়ে নেয়। ২১ মার্চ ১৯৪৮। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনী সভায় কর্জন হলে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, “There can however, be only one lingua franca that is, the language for inter-communication between the various provinces of the State, and that language should be Urdu and cannot be any other. The State language, therefore, must obviously be Urdu, …”
এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাষ্ট্রপ্রধানের চোখের উপর আঙুল তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেই মুহূর্তে ‘না! না! না!’-বলে চিৎকার করেছিল। কায়েদি-আজমের রাজনৈতিক জীবনে এত বড় প্রত্যাঘাত বোধহয় এর আগে কখনও আসেনি।
জিন্নাহর উপরোক্ত বক্তব্যের অর্থ হল— একটিমাত্র ভাষা পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অন্তর্বর্তী যোগাযোগের ভাষা এবং অবশ্যই রাষ্ট্র ভাষা হবে। আর সে হল উর্দু। এবং অন্য কিছু একদমই নয়।
পাকিস্তান বা ভারতের মত বহুজাতীয় রাষ্ট্রের জন্য ‘একটি মাত্র রাষ্ট্র ভাষা’ কি থাকতে পারে? বা, থাকলেও বহু ভাষার মধ্য থেকে কীভাবে সেটি বেছে নেওয়া হবে? লেনিন বহুজাতীয় রাষ্ট্র রাশিয়ার ‘বাধ্যতামূলক সরকারি ভাষা’ থাকা উচিৎ কিনা সেই প্রশ্নে ১৯১৪ সালে বলেছেন, “What we do not want is the element of coercion. We do not want to have people driven into pradise with a cudgel; for no matter how many fine phrases about “culture” you may utter, a compulsory official language involves coercion, the use of the cudgel.” [V.I. Lenin, Is a Compulsory Official Language Needed?, Lenin Internet Archive (2004)] তাহলে একটি বহুজাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে পার্লামেন্ট, ভাবের আদানপ্রদান, অর্থনৈতিক লেনদেন কীভাবে চলবে? একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য যোগাযোগের ভাষা কি থাকবে না? বা, থাকার প্রয়োজন নেই কি? এই প্রসঙ্গে লেনিন আরও বলেছেন, “If all privileges disappear, if the imposition of any one language ceases, all Slays will easily and rapidly learn to understand each other and will not be frightened by the ” horrible” thought that speeches in different language will be heard in the common parliament. The requirement of economic exchange will themselves decide which language of the given country it is to the advantage of the majority to know in the interests of commercial relations. This decision will be all the firmer because it is adopted voluntarily by a population of various nationalities, and its adoption will be the more rapid and extensive the more consistent the democracy and, as a consequence of it, the more rapid the development of capitalism.” [V.I. Lenin, Critical Remarks on the National Question (Liberals and Democrats on the Language Question), Lenin Internet Archive (2004)]
অর্থাৎ আপত্তি কোথায়? আপত্তি হল ‘বলপ্রয়োগ’-এ। জোর করে কোনও ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আর চাপিয়ে দেওয়া ভাষা কোনওভাবেই অন্য জাতিসত্তা দ্বারা সর্বান্তকরণে গৃহীত হয় না। কোনও বিশেষ জাতিসত্তার ও তার ভাষা-সংস্কৃতির আধিপত্য না থাকলে, পারস্পরিক মুক্ত মেলামেশার মধ্য দিয়েই উঠে আসবে একটি ভাষা, যা ভাবের বিনিময়, অর্থনৈতিক লেনদেন ও পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু লেনিন যে আধিপত্যহীন জাতিসত্তাগুলোর মুক্ত মেলামেশার কথা বলেছেন, বাস্তবে বহুজাতীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে তা সম্ভব নয়। কারণ সেখানে পুঁজির আধিপত্য থাকে। যেখানে পুঁজির আধিপত্য নেই, সেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই একমাত্র এটা সম্ভব। বহুজাতীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট হল, সবল জাতিসত্তা দুর্বল জাতিসত্তার উপর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্থাপন করতে চায়। এই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্থাপন আসলে সবল জাতিসত্তার পুঁজির দ্বারা দুর্বল জাতিসত্তার পুঁজির বাজারের উপর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্থাপন। এই অর্থনৈতিক আধিপত্যের একটি প্রকাশ হল ভাষার উপর আগ্রাসন। ভারতবর্ষে আজও আমরা এই আগ্রাসন দেখতে পাই। যে পুঁজিপতি শ্রেণি সাধারণ মানুষকে শোষণ করছে, এদের মধ্যে আছে বাজার দখলকে কেন্দ্র করে দলাদলি। ভারতবর্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী বা সবল পুঁজিপতি গোষ্ঠী যারা তাদের ভাষা হচ্ছে হিন্দি। তারা আঞ্চলিক পুঁজির প্রতিনিধিদের উপর খবরদারি করতে চায়, ব্যবসা এদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেরা সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে চায়। আর সেজন্য তার ভাষাটাকে আঞ্চলিক ভাষার উপর চাপিয়ে দেয়। আমরা দেখতে পাবো— দক্ষিণ ভারতে হিন্দি বললে চলে না। হয় ইংরেজি বলতে হবে—সেটাও খুব সামান্য সংখ্যক মানুষ বুঝবে, নাহলে ওদের ভাষায় কথা বলতে হবে। কারণ দক্ষিণের আঞ্চলিক জাতিসত্তার যে পুঁজিপতি শ্রেণি তারা উত্তর বা মধ্য ভারতের ছোট ছোট আঞ্চলিক পুঁজিপতি শ্রেণির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা সমানে সমানে এই উত্তর ভারতের প্রভুত্বকারী পুঁজির সাথে লড়ে। তাই ওরা ওদের ভাষার উপর আগ্রাসন হতে দেয় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভাষার উপরে যে আগ্রাসন সেটা আসলে এই পুঁজির আগ্রাসন। পুঁজির প্রভুত্ব। শুধু বাংলা বা সাঁওতালি ভাষার উপর নয়; বিশ্বের সব ছোট ছোট ভাষার উপর বড় বড় পুঁজির ভাষা এভাবে আগ্রাসন নামিয়ে আনছে। একটা পরিসংখ্যান দেখলে আমাদের ধারণা অনেকখানি পরিষ্কার হতে পারে। ২০১১ সালের ভারতের আদমশুমারীর রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে ভারতবর্ষে হিন্দি ভাষায় কথা বলা মানুষের শতকরা হার ছিল ৩৬.৯৯ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৩.৬৩ শতাংশ। কিন্তু পাশাপাশি সমস্ত অন্যান্য scheduled ভাষায় কথা বলা  মানুষের সংখ্যা শতকরা হারে কমেছে। [Census of India 2011, Paper 1 of 2018, Language, India, States and Union Territories (Table C-16)] সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায় এই শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রায় সাত হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতি চৌদ্দ দিনে কোনও না কোনও ভাষা বা উপভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে আধিপত্যকারী জাতিসত্তার ভাষা যখন অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন দুর্বল জাতিসত্তার মানুষ ঐ ভাষাটি যথাযতভাবে শিখছে। ইংরেজি ভাষার উদাহরণ নিলে আমরা সহজে বুঝতে পারব। হিন্দি, বাংলা, তামিল বা বিশ্বের যেকোনও অন্য ভাষার উপর ইংরেজি ভাষার একটা আধিপত্য আছে। কারণ ইংরেজি হল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষা। আজকের দিনে যে ইংরেজি সবাই শিখছে, তাকে কি প্রকৃতঅর্থে ইংরেজি শিক্ষা বলা যায়? অধিকাংশ শিক্ষিত জনসাধারণ ইংরেজি জানে। সেটা কোন্‌ ইংরেজি? যে ইংরেজিটা ব্যবসার জন্য, বানিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য দরকার, সেই কম্যুনিকেটিভ ইংরেজিটা সকলে জানে। সাথে জানে কিছু বিশেষ ইংরেজি শব্দ। যে শব্দগুলো ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নরুচির মানুষরা ব্যবহার করে থাকে। ইংরেজিকে চাপিয়ে দিয়ে ইংরেজি শেখানোর নামে এগুলোই আমাদেরকে শেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য অধিকাংশ মানুষই অধ্যায়ন করে না বা শেখে না। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের যে রস, যে মাধুর্য্য, যে সুরভী— তা ক’জন জানে? তা ক’জনের হৃদয়ে আছে? অধিকাংশকে দু’একটা কথা বলতে শেখানো হয়, যাতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ব্যবসাটা ভালভাবে চলে। এখানে উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে আঞ্চলিক ভাষার উপর আগ্রাসন কখনই পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে প্রত্যক্ষ গায়েরজোরি ভাষাগত আগ্রাসন— সেই রূপ নেয়নি। তার কারণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিসত্তাগুলো একটি অখণ্ড ভূখণ্ড দ্বারা এবং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ। তাই এখানে সবল জাতিসত্তা তার পুঁজি দ্বারা দুর্বল জাতিসত্তার পুঁজির বাজারের উপর যে আগ্রাসন নামিয়ে আনে তা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের চরিত্র অর্জন করেনি।
এখন আমরা ফিরে যাব জিন্নাহর উপরোক্ত বক্তবের পরবর্তী অংশে। যেখানে জিন্নাহ বলেছেন, “The State language, therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent, a language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all, a language which, more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries.” এখানে লক্ষণীয়, মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের ভাষা হিসাবে উর্দুকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সাথে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে এই ভাষা ইসলামিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত, অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রের ভাষার খুব কাছাকাছি এই ভাষা। অর্থাৎ দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারাকে বজায় রেখে ইসলাম ধর্মকে ভিত্তি করে একটি জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা এখানে পরিলক্ষিত হয়। এই প্রসঙ্গে শিবদাস ঘোষ যথার্থই বলেছেন, “ভাষাকে ভিত্তি করে, সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নকে ভিত্তি করে পূর্ববাংলার মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে জনমত গড়ে উঠতে থাকে এবং বিভিন্ন দাবি উত্থিত হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই আন্দোলনগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ ও ঐতিহাসিক গতি কোন্‌ দিকে তা ধরতে পারেননি। একদিকে আন্দোলনগুলোকে জবরদস্তি রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে দমন করতে চেয়েছেন আর অন্যদিকে ধর্মীয় জিগির তুলে পাকিস্তানের একটি অখণ্ড জাতীয়তাবোধের ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে খাড়া রাখতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন যে, শুধু ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতি গড়ে ওঠে না।” [ঐ, পৃঃ ৭] যার ফলে “… বাস্তবে পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান ঘটল দু’ভাগে বিভক্ত জাতীয়তাবাদের রূপ নিয়ে।” [ঐ, পৃঃ ৮]
তাই এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাংলার দামাল সন্তানরা। তারপরের ইতিহাস আমরা সকলেই জানি। জ্ঞাত-অজ্ঞাত অসংখ্য শহিদের বুকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি পেল তার প্রাণের মাতৃভাষার মর্যাদা। এই ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হল— এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা একটা জাতিকে পেলাম, জোরপূর্বক ধর্মকে ভিত্তি করে কৃত্রিমভাবে জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার চেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করে যে জাতি গড়ে উঠেছে। এই আত্মবলিদানের ক্রমপরিণতিতে একটা ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট হিসাবে বাংলাদেশকে আমরা পেয়েছি। স্পষ্টতই ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ হল ‘ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট’ জনগোষ্ঠীর ‘একটা অভিন্ন ভাষা, অঞ্চল, অর্থনৈতিক জীবন আর সাধারণ সংস্কৃতিতে প্রকাশিত মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ভিত্তিতে’ গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ। তাই আমরা দেখতে পাই, বিশ্বের একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যে ‘পয়লা বৈশাখ’-এর মত একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় উৎসবের জন্ম দিয়েছে। এবং তারও পূর্বে আর একটা রাষ্ট্রীয় শোক-উৎসবের জন্ম দিয়েছে যার গায়েও কোনও ধর্মের গন্ধ নেই। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ একটা শোক-উৎসব, একটা গর্বের উৎসব—সে হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। আমরা যদি একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের যেকোনও প্রান্তে যাই তাহলে দেখতে পাব—  আবালবৃদ্ধবনিতা কারও পায়ে জুতো নেই, সবার হাতে ফুল, সবাই হেঁটে চলেছে শহিদ মিনারের দিকে। সবার মাথা উঁচু, মুখে একটাই গান— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’। একটি ধর্মনিরপেক্ষ আপোষহীন অধিকার আদায়ের সংগ্রামই একমাত্র এমন মহৎ আবেগের জন্ম দিতে পারে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাংলাদেশও আজ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির দ্বারা আক্রান্ত। আজ শুধু বাংলাদেশ নয়,  ভারতবর্ষসহ বিশ্বের সর্বত্র পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তার শোষণ নিপীড়ন অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে মানুষের মূল সমস্যার থেকে চোখ ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। আর অন্যদিকে অনাহারে, অশিক্ষায়, বিনা চিকিৎসায়, বেকারিতে, অপুষ্টিতে মানুষ মরছে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার উপর আগ্রাসন পুঁজিবাদের সামগ্রিক আগ্রাসন-শোষণ-নিপীড়নেরই একটা প্রকাশ। তাই পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ যতদিন থাকবে, পুঁজির আগ্রাসন যতদিন থাকবে ততদিন যেমন ভাষার উপর আগ্রাসন হবে একইভাবে অন্যান্য সমস্ত দিক দিয়েই মানুষ শোষিত হবে। সুতরাং এই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত লড়াই যদি আজ আমরা গড়ে তুলতে পারি তাহলেই ভাষাশহিদ রফিক, শফিক, সালাম, বরকতদের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। এছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *