• Uncategorized
  • 0

অনুবাদ গল্পে অপরাজিতা ভট্টাচার্য

ইন্সপেক্টর কিমতলালএবং একটি তদন্ত

(রাসকিন বন্ডের ‘ আ কেস ফর ইন্সপেক্টর লাল’ গল্পেরঅনুবাদ)

সে প্রায় বছর দুই আগের কথা। আমি তখন শাহপুরে থাকি। উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমতলের একটা ছোট্ট শহর এই শাহপুর।এই ধুলোটে শহরেই ইন্সপেক্টর কিমতলালের সঙ্গে আমার আলাপ।

কিমতলাল তখন স্থানীয় পুলিশ থানার চার্জে ছিলেন। বিশাল দশাসই চেহারা। কিন্তু তিনি বেশ শ্লথ এবং  কুঁড়ে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বেশীরভাগ অলস মানুষ যেমন বুদ্ধিমান হয়, কিমতলালও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তার কারণেই তাঁর সঙ্গে আমার আড্ডা জমত ভাল। তবে চাকরি জীবনে তেমন সফল হতে পারেন নি কিমতলাল। বরং ব্যর্থই বলা ভাল। বছরের পর বছর কিমতলাল ইন্সপেক্টর থেকে গেছেন। একসময় তিনি নিজেও প্রমোশানের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভাগ্যের সাহচর্য পান নি, এমনটাই মনে করেন কিমতলাল। কর্কট রাশির জাতক হিসেবে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা তাঁর পক্ষে লাভজনক হত, সে ক্ষেত্রে উন্নতিও হত। কিন্তু সময় এগিয়ে গেছে। ফলে এখন আর রেস্টুরেন্টের ব্যবসার কথা ভাবেন না।

আমাদের দুজনের বয়সের ফারাক ছিল অনেকটাই। যখনকার কথা বলছি তখন কিমতলালের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, আর আমি পঁচিশ। সেভাবে দেখতে গেলে কিমতলাল আর আমার মধ্যে মিল ছিল সামান্যই। এই যেমন আমরা দুজনেই ইংরাজিতে কথা বলতে পারতাম। শাহপুরে তখন হাতে গোনা কয়েক জনই ইংরাজিতে কথা বলত।

 শহরটায় বিনোদনের উপকরণ তেমন ছিল না। পুব দিক থেকে ধুলোর ঘূর্ণি পাকিয়ে পাকিয়ে উড়ে আসত। গরমের দাবদাহ আর ধুলোর ঝাপটা খেয়ে পিপাসায় কাহিল হয়ে পড়তাম আমরা। মাছি আর মশার সংখ্যা প্রায় সমান সমান। মশার কামড়ের সঙ্গে ধুলোমলিন শহরের একঘেয়েমিতে আমাদের যা প্রয়োজন হত,তা হল পানীয়। পান করার মত তরল বলতে শাহপুরে যা পাওয়া যেত তা হল গেঁজে যাওয়া লেমোনেড। কিন্তু আমাদের সে তৃষ্ণা লেমোনেডে মিটত না। এ সময় আমাদের শারীরিক এবং মানসিক তৃপ্তি দিত বিয়ার। আমার আর কিমতলালের মিলের আরেকটা বিষয় হল এই বিয়ার আসক্তি। বিয়ারেই মিটত আমাদের তেষ্টা। বিয়ার পানেই বিনোদন।

আমার বাড়িতেই কিমতলালের সঙ্গে আড্ডাটা জমত। শহরের এক নিরিবিলি প্রান্তে আমার বাড়ি। ফলে আমাদের আড্ডায় বিঘ্ন ঘটানোর মত কেউ তেমন থাকত না। বেড রুমের জানলাগুলোতে পুরু খসখস ঝুলত, সিলিংও বেশ উঁচু। গরমের দুপুরে বেডরুমটা আমার কাছে বেশ আরামদায়ক ছিল। দীর্ঘ দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে আমি বেড রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতাম।  এসময় সপ্তাহে দু তিনদিন আমার বাড়িতে আসতেন কিমতলাল। বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে উঠে আসতেন। ঘাম মোছার জন্য রুমালের পরিবর্তে ছোট তোয়ালে ব্যবহার করতেন। কিমতলাল এলেই দেখতাম আমার একমাত্র চাকর বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়ত। ইন্সপেক্টর অফ পুলিশকে সেবা করার এটাই ছিল একটা বড় সুযোগ। সে দৌড়ে গিয়ে আমাদের জন্য গ্লাস, এক বাকেট বরফ আর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বিয়ার নিয়ে আসত।

একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা চলাকালীন চতুর্থ বোতল শেষের মৌতাতে আমি বলেছিলাম ‘আপনার কেরিয়ারের কোন বিশেষ উত্তেজনাপূর্ণ কেসের কথা শুনতে চাই ইন্সপেক্টর। বলুন না।‘

‘দেখো। সাফল্যের কেসগুলো বেশিরভাগই সাদামাটা, ম্যাড়ম্যাড়ে। সে তুলনায় রোমাঞ্চময় কেসগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিনারাই হয় না। যদি মীমাংসা হত, তাহলে আমি এতদিনে সুপারিন্টেনডেন্ট হয়ে যেতাম। তবে তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি কোন মার্ডার কেসের গল্প শুনতে চাইছ। মনে আছে সেই গ্রামের মন্ত্রীর শুটিঙের কথা? আমি সেই কেসে ছিলাম। ইন্টারেস্টিং ছিল কেসটা। কিন্তু রাজনৈতিক খুন ছিল এবং যথারীতি কিনারা হয় নি।‘ কথাগুলো বলতে বলতে যথেষ্ট বিব্রতই হচ্ছিলেন কিমতলাল।

‘তাহলে মীমাংসা হয়েছে এমন একটা কেসের কথাই না হয় শোনান। তবে ঘটনা বেশ রহস্যময় হওয়া চাই। গোপন তথ্য ফাঁস হবার ভয় করবেন না। কারণ বেশি বিয়ার খেয়েও আমি কিন্তু সংযত এবং সতর্ক থাকি। তাই আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি বলুন।‘

কিমতলাল বললেন, ‘কিন্তু তুমি সংযত থাকবে কি করে? তুমি তো লেখক।‘

‘লেখকরা সাধারণতঃ সংযতই হয়। তারা স্থান আর চরিত্রের নাম বদলেই তো লেখে।‘ আমি বিরোধিতায় বলি।

‘ধরো তুমি যদি আমাকে নিয়ে গল্প লেখো, আমাকে কিভাবে বর্ণনা করবে?’ বিরল এক হাসিতে জানতে চাইলেন কিমতলাল।

‘দেখুন, সেক্ষেত্রে আপনি যেমন তেমনটিই রাখব। সে যাক।“কিমতলালকে কিছুটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।

প্রশ্রয়ের হাসিতে আমার গ্লাসে আরো খানিকটা বিয়ার ঢেলে দিলেন কিমতলাল।

‘আমার মনে হয় আমিও নাম পরিবর্তন করে বলতে পারি …  খুব উত্তেজনার একটা কেস তোমাকে শোনাব। অভিযুক্ত এবং খুনি দুজনেই বেশ অন্যরকম চরিত্র। প্রতিজ্ঞা কর এই নিয়ে তুমি কোন গল্প লিখবে না।‘ কিমতলাল গল্প বলার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন।

‘লিখব না বলছি তো।‘কিমতলালকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই দিলাম। আসলে কিমতলালের গল্প শোনার জন্য ক্রমশঃ অধৈর্য হয়ে পড়েছি।

‘তুমি পনৌলির নাম শুনেছ?’

‘ও হ্যাঁ,পাহাড়ে তো? আমি গিয়েছি দু একবার।‘

‘তাহলে তো জায়গাটা সম্পর্কে খুব বেশি বলার প্রয়োজন নেই। তুমি জানো। বছর তিনেক আগে আমি যখন পনৌলিতে থাকতাম, এটা সেই সময়ের ঘটনা। সেখানে কখনোই খুব কিছু ঘটত না। সামান্য কিছু চুরি, ছিনতাই, আর গ্রীষ্মে ছুটকো ছাটকা মারপিট। খুন তো দশ বছরে একটা হত কিনা সন্দেহ। সেই কারণেই পনৌলির রানিকে যখন তাঁর বসার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, এলাকায় খুব আলোড়ন ওঠে। রানির মাথা কুঠারের আঘাতে দুভাগ হয়ে গেছিল। ভাবতে পারছ! সে অঞ্চলের রানির মাথা দু ফালা! তাও আবার তাঁর নিজের বাড়িতে! আমি বুঝতে পারলাম পনৌলিতে থাকতে হলে এই কেসের কিনারা আমাকে করতেই হবে।‘

‘আমার মনে হয়েছিল পনৌলির রানিকে যে কেউ খুন করে থাকতে পারে। আসল সমস্যা সেটা নয়। ইন ফ্যাক্ট রানির মৃত্যুতে অনেকেই তাদের খুশি হবার ভাবটা গোপন রাখতে পারে নি। পনৌলিতে রানির সুখ্যাতি ছিল না। স্বামী মৃত, ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। রানি কোনদিনই বিশাল সম্পদশালী ছিলেন না। তাঁর টাকাপয়সাও দিনকেদিন কমে যাচ্ছিল। পনৌলির এক প্রান্তে তাঁর পুরনো বাড়িতে একাই থাকতেন রানি। পনৌলিতে তখন রানির অধীনে রীতিমত মাতৃতান্ত্রিক শাসন।

রানির এক চাকর ছিল। সেই চাকরই রানির মৃতদেহ দেখে পুলিশের কাছে যায়। কিন্তু সে পুলিশ স্টেশনে এসে মুখে কুলুপ এঁটে দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে গ্রেপ্তার করি। তবে আমার মনেই হয়েছিল ও সম্ভবতঃ নির্দোষ। এমনিতেই বেসিক রুল হল মৃতদেহ প্রথম যে দেখেছে তাকে গ্রেপ্তার করা, আর সে চাকর হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এই চাকর আমাদের তেমন কিছু বলতে পারে নি। তাই আমরা তাকে সামান্য মারধোর করে ছেড়ে দিই। আর ঐ চাকরের পক্ষে জোরালো অ্যালিবাইও ছিল।‘

‘যে অস্ত্র দিয়ে রানিকে আঘাত করা হয় সেটা আমরা খুঁজে পাই নি। কিন্তু রানির মাথার ক্ষত থেকে  মনে হয়েছিল যে অস্ত্রটা কোন কাঠুরের কাঠ কাটার ছোট কুঠার। রানির বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের ক্ষোভ, অভিযোগ তো ছিলই। ফলে রানিকে যে কোন পুরুষ কিংবা মহিলা হত্যা করতেই পারে। পনৌলির বাজারে নানা গুঞ্জন ছিল। শাটলককের মত হাওয়ায় উড়ে বেড়াত সেসব গুজব। রানি নাকি নিজের বিভিন্ন যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে মেয়ে পাচারের ব্যবসা করত। এই ব্যবসায় ভাল অর্থ উপার্জন হত। রানির বাড়ির গোডাউনে নাকি এইভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ আছে। যদিও আমরা কিছুই খুঁজে পাই নি। আমি এসবে কর্ণপাত করে সময় নষ্ট করি নি। বরং রানির ঘনিষ্ঠ লোকজন তা সে ব্যক্তিগত সম্পর্কেই হোক বা বাড়িতে যাতায়াতের কারণেই হোক, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম।‘

‘ বম্বের এক ধনী ব্যবসায়ী মিঃ কাপুরের একটা বাড়ি ছিল পনৌলিতে। এই মিঃ কাপুর এক সময় রানির বড় ভক্ত ছিল। মিঃ কাপুরকে দিয়েই আমি জেরা শুরু করি। আমি রীতিমত আবিষ্কার করি যে মিঃ কাপুর রানিকে মাঝে মধ্যে টাকা ধার দিত। বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকা সত্বেও সেই ধার বাবদ মিঃ কাপুর রানির থেকে চড়া সুদ দাবী করত।‘

‘এরপর তার নিকটতম পড়শিদের কথা ধরো। এক আমেরিকান মিশনারি আর তাঁর স্ত্রী। এঁরা রানিকে খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করতে চাইছিলেন। রানিও এই আমেরিকান দম্পতির ওপর বিরক্তই ছিলেন। আবার এক বছর সত্তরের অবিবাহিত ইংলিশ বৃদ্ধা পড়শিও কোন লুকোছাপা করেন নি। আমাকে সরাসরিই জানান যে তিনি এবং রানি পরস্পরকে ঘৃণা করতেন। রানির সঙ্গে প্রতিবেশী এক স্থানীয় পৌরপিতা এবং তাঁর পরিবারেরও বনিবনা ছিল না। এটা ঠিক যে রানির সম্পর্কে চারপাশ থেকে কোন প্রশংসা বাক্যই শুনি নি। কিন্তু রানির আশেপাশের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে রানিকে খুন করার তেমন কোন মোটিভও খুঁজে পাই নি। রানির বাড়ির কাছে ছিল এক দর্জির দোকান। দর্জির মেয়েটা কিন্তু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।‘

‘মেয়েটার নাম কুসুম। বারো কি তের বছর বয়স। কালো, রোগা মেয়ে। অপূর্ব কালো চোখ। কুসুম হাসত অল্প। কিন্তু সে হাসি যেন রেশ রেখে যায়। আমি রানির বাড়ি এবং সংলগ্ন জায়গার রুটিন ইনকয়ারি করার সময় খেয়াল করি যে ওইটুকু মেয়ে আমাকে কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে। আমি কুসুমের কাছে রানির কথা জানতে চাই। ঘটনার দিন কুসুমের গতিবিধির কথাও জানতে চাই। কিন্তু মেয়েটা বোকা এবং অস্পষ্ট ভাবে চেয়ে থাকে। দেখে যেন মনে হয় বোকার ভান করছে সে। টুঁ শব্দটি করে না। ভেবে দেখো, এই বয়সী একটা মেয়ের পক্ষে সব কিছু বলে ফেলাই তো স্বাভাবিক।‘

‘ আমার স্থির বিশ্বাস ছিল যে কুসুম বোকা নয়। সে রানি সম্পর্কে অস্বাভাবিক কোন তথ্য জানে। সে হয়ত খুন সম্পর্কেও কোন কথা জানে। এমনও হতে পারে, কুসুম কাউকে আড়াল করার জন্য যা জানে তা গোপন রাখছে। প্রায়শই আমি কুসুমের কাছে রানির মৃত্যু দৃশ্যের ভয়াবহতার কথা বলতাম। খুনের ব্যাপারটা সত্যিই তো ভয়ানক ছিল। একটা কুঠারের আঘাতে কারো মাথা দুভাগ হয়ে যাওয়া! কথাগুলো বলে মেয়েটাকে উত্তেজিত করতে চাইতাম। উত্তেজনার বশে যদি মুখ খোলে… ’

 ‘আমি কথা তুললেই দেখতাম ওর দুচোখে ভয়। ধীরে ধীরে আমার মনে হতে লাগল হয়ত কুসুমেরই প্রাণ সংশয়। আমি ওর ওপর নজর রাখতে শুরু করলাম। কুসুমকে আমার ভাল লাগত। ভাল লাগত ওর তরতাজা তারুণ্য, ওর সরলতা, ওর চোখের বিস্ময়। কুসুমের সঙ্গে সুযোগ পেলেই মমতায়, পিতৃস্নেহে কথা বলতাম। বেশ ভাল লাগত জানো।

 আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম, বুঝলে। এই যেমন কুসুম আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করে। আমাকে বেশ অবাক চোখে চেয়ে দেখে। বাচ্চা মেয়েটার জন্য কেমন যেন আশঙ্কা হত। ভাবে, ভাবনায় কুসুমের সঙ্গে সঙ্গে পনৌলির নানা চড়াই উৎরাই আমাকে বেদম হাঁপিয়ে তুলত। মনে হত মেয়েটা কিছু বলতে চায় এবং বলবেও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে পিছিয়ে যেত, মুখ খুলত না।‘

‘ একদিন দুপুরে আমি রানির বাড়িতে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। দরজার চৌকাঠের সরু ফাটলের মধ্যে কিছু একটা চকচক করতে দেখলাম। জানলা দিয়ে সূর্যের আলো চৌকাঠে না পড়লে হয়ত খেয়াল করতাম না। আমি নিচু হয়ে কুড়িয়ে দেখি সেটা একটা ছোট্ট কাঁচের টুকরো। সেটা আসলে একটা কাঁচের চুড়ির অংশ।‘

‘ টুকরোটা আমি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখলাম। রঙ এবং ডিজাইন কেমন যেন চেনা লাগল। কুসুম কি এমন চুড়ি পরে? সঙ্গে সঙ্গে কুসুমের খোঁজে আমি ওর বাবার দোকানে যাই। কিন্তু কুসুমের দেখা পাই না। আমাকে বলা হয় কুসুম নাকি জ্বালানির কাঠ জোগাড় করতে পাহাড় বেয়ে নিচে গেছে।‘

‘ আমি ঠিক করলাম আমিও সরু পথ বেয়ে নিচে নেমে দেখব। রাস্তাটা উৎরাইতে পাথর আর ক্যাকটাসের মধ্যে দিয়ে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নেমেছে। আর তারপর ওক গাছের জঙ্গলে হঠাৎই মিলিয়ে গেছে। কুসুমকে সেই জঙ্গলের এক প্রান্তে বসে থাকতে দেখি। চারদিকে ছোটছোট গাছপালা, লতাপাতা।‘

‘তুমি সব সময় একা একা ঘুরে বেড়াও। তোমার ভয় করে না?’ আমি কুসুমকে জিজ্ঞেস করি।

কুসুম বলেছিল, ‘আমি একা থাকলেই বেশি নিরাপদ থাকি। এখানে কেউ আসে না।‘

 ‘অতটুকু একটা মেয়ের থেকে এমন নির্লিপ্ত দার্শনিক উত্তর আশা করি নি জানো। আমি চট করে কুসুমের হাতের চুড়িগুলো দেখে নিই। সেই ভাঙ্গা চুড়ির টুকরোর সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। ভাঙ্গা টুকরোটা দেখিয়ে কুসুমকে বলি ‘এইটে আমি রানির বাড়িতে পেয়েছি। মনে হয় কোনভাবে পড়ে গেছে … ‘

‘কুসুম আমার কথাটা শেষ হবার অপেক্ষা না করেই ঘাস থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। চুড়ির টুকরোটা দেখে সে কি ভয়ার্ত মুখ কুসুমের ভাবতে পারবে না!’

‘আমি চমকে গেলাম। এরকম কোন কিছু আশা করি নি। ভাঙ্গা চুড়ির টুকরোটার তাহলে তাৎপর্য কি?  আমার অনুমানই কি ঠিক যে কুসুম অনেক কিছু জানে!’

‘ আমি কুসুমকে ধাওয়া করি। পাইন সূচে মোড়া সেই ঢালু রাস্তা বেয়ে পিছলে পিছলে ছুটতে লাগলাম। প্রতিটা গাছের আশেপাশে কুসুমকে খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমার পিছনে কেউ শব্দ করে কাঁদছে। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি কুসুম আমার দিকে মুখ করে একটা বোল্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে কাঁদছে, দুহাতে ধরা একটা ছোট কুঠার।‘

‘আমাকে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকতে দেখে কুসুম দুহাতে কুঠারটা উঁচিয়ে ধরে এবং ঢালু বেয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে।‘

‘আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হাঁ করা মুখে কুসুমের দিকে তাকিয়েই ছিলাম। কুসুমের দৌড়নোর গতিতে তার আমার সামনে এসে পড়ারই কথা। আর কুঠারটা নেমে এসে আমার মাথার মোটা খুলি দুভাগ করে দেবার কথা। কিন্তু কুসুম যখন আমার থেকে প্রায় ছয় ফুট দূরত্বে, তখনই কুঠারটা কুসুমের হাত থেকে উড়ে বেরিয়ে যায়। কুঠারটা হাওয়ায় পাক খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছিল।‘

‘নিজের ভারি ওজন সত্বেও আমি দ্রুত এক পাশে সরে যাই। কুঠারটা আমার কাঁধ ঘুরে পিছনের গাছের নরম বাকলে গেঁথে যায়। কুসুম এরপর আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে।‘

ইন্সপেক্টর কিমতলাল বিয়ারের গ্লাসটা ভর্তি করার জন্য থামলেন। তারপর একটি দীর্ঘ চুমুক দিলেন। বিয়ারের ফেনা কিমতলালের গোঁফে চকচক করতে লাগল।

‘এরপর কি হল?’ আমি কিমতলালকে আগ্রহে তাড়া দিলাম।

‘সম্ভবতঃ এরকম ঘটনা একমাত্র ভারতবর্ষেই ঘটে এবং আমার সঙ্গেই হয়। যে তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, তার প্রতি তুমি দয়া পরবশ হয়ে পড়লে। রাগে, ক্ষিপ্রতায় মেয়েটাকে তো আমার পুলিশ স্টেশনেই টেনে নিয়ে যাবার কথা। তা না করে আমি কি করলাম? কুসুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। কিছু সাধারণ কথা বললাম, কিছু আশ্বাসের কথা বললাম।‘

‘এবং মেয়েটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলল যে সেই রানিকে মেরেছে?’ কিমতলাল যাতে থেমে না যান, তাই আমি আবার প্রশ্ন করি।

‘কুসুম আমাকে বলেছিল কিভাবে রানি ওকে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে চা, মিষ্টি দিয়েছিল। মিঃ কাপুর তখন সেখানে ছিল। কিছুক্ষণ পর মিঃ কাপুর কুসুমের হাতদুটো ঘসতে থাকে, দুটো হাঁটু টিপতে থাকে। অস্বস্তিতে কুসুম নিজেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু মিঃ কাপুর থাবা বসাতে থাকে। রানি কুসুমকে বোঝাতে থাকে যে কুসুম অযথা ভয় পাচ্ছে। ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তার কোন ক্ষতি হবে না। নিরুপায় কুসুম তখন মিঃ কাপুরের থেকে পালিয়ে দরজার দিকে ছোটে। এতে রানি রেগে যান।  কুসুমের দুই কাঁধ ধরে ঠেলে তাকে আবার ঘরে ঢুকিয়ে দেন।‘

‘ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা একটা ছোট কুঠার কুসুমের নজরে আসে। কুসুম কুঠারটা মুহূর্তে মাথার ওপর তুলে মিঃ কাপুরকে হুমকি দেয়। মিঃ কাপুর বুঝতে পারে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। নিজের গর্দানের কথা ভেবে ভয়ে সে পিছিয়ে যায়। কিন্তু রানি ভয়ঙ্কর রাগে কুসুমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কুসুমের অবস্থাটা ভাবো একবার। কুসুম আতঙ্কে, হতাশায় কুঠারটা রানির মাথাতেই বসিয়ে দেয়।‘

‘রানি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিঃ কাপুর এরপর কি করতে পারে সে ভেবে কালক্ষেপ না করে কুসুম পালিয়ে যায়। দরজার দিকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যাওয়ার সময় হয়ত কোনভাবে কুসুমের হাতের চুড়ি ভেঙ্গে গেছিল। কুসুম এক ছুটে পাহাড় বেয়ে নেমে জঙ্গলে ঢুকে গেছিল। দীর্ঘ ফার্ণ গাছের সারির মাঝে কুঠারটা লুকিয়ে রেখে ঘাসের ওপর বসে সন্ধ্যে নেমে আসা অবধি কুসুম কেঁদেছিল। সেকারণেই কুঠারটা আমরা খুঁজে পাই নি। তবে তারুণ্যের জন্যই হয়ত কুসুম ঘরে ফেরার আগেই সহজ স্বাভাবিক হতে পেরেছিল। পরবর্তী সময় সে সমস্ত ঘটনাটি চেপে চুপ করে থাকত। তাকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না।‘

উত্তেজনায় তখন আমার আর তর সইছে না। আমি চোখ গোল গোল করে জানতে চাইলাম, ‘আপনি এরপর কি করলেন?’

কিমতলাল আমার বেরিফলের মত গোল হয়ে ওঠা চোখের দিকে সোজাসুজি তাকালেন।

‘কিচ্ছু না, একদম কিছুই করি নি। কুসুমকে আমি রিমান্ড হোমে রাখার কথা ভাবতে পারি নি। ওখানে থাকলে হয়ত মেয়েটার সাহস, উদ্যম সব শেষ হয়ে যেত।‘

‘ কাপুরের কি হলো?’

‘কাপুরের নীরব থাকার ব্যক্তিগত কারণ ছিল। বুঝতেই পারছ আশা করি। কেসটা ক্লোসড হয়েছিল। বরং বলা ভাল কেস ফাইলটা আমার পেন্ডিঙ ট্রেতে জায়গা পেল। আমার প্রমোশানও পেন্ডিঙ ট্রেতেই রয়ে গেল।‘

‘এটা তো আপনার জন্য ভাল হল না।‘

‘না তো। এই যে দেখছ এখনো শাহপুরে আমি ইন্সপেক্টর পদেই বহাল। কিন্তু তুমি আমাকে বলো আমার জায়গায় থাকলে কি করতে?’

কয়েক মুহূর্তের জন্য কিমতলালের প্রশ্নটি বিবেচনা করলাম এবং বললাম,’ মেয়েটি আমার মধ্যে কতটা সমব্যথা উদ্রেক করতে পারত তার ওপর আমার সিদ্ধান্ত নির্ভর করত। সে নির্দোষ সারল্যেই খুন করেছিল নাকি … ‘

‘তার মানে তুমি তোমার ব্যক্তিগত অনুভূতি তোমার ডিউটি এবং আইন রক্ষার ওপরেই রাখতে তো?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তাহলে আমি খুব ভাল পুলিশ ইন্সপেক্টর হতে পারতাম না।‘

‘একদম তাই। আমিও তো সেটাই করেছিলাম ভায়া। কুসুম একদম তাই। আমিও তো সেটাই করেছিলাম ভায়া। কুসুমকে থানায় নিয়ে গেলে আমারও প্রমোশান হত। কিন্তু তা আর পারলাম কই?‘ ‘কিন্তু এটা দুঃখের যে মিঃ কাপুর সহজে ছাড়া পেয়ে গেল।‘ ‘মেয়েটাকে বাঁচানোর আর কোন উপায় ছিল না। তবে মিঃ কাপুর কিন্তু পুরোপুরি বাঁচে নি। অন্য একটা ম্যানুফ্যাকচারিং কনসার্ন থেকে টাকা তছরুপের দায়ে কিছু বছর জেল খেটেছিল।‘ ‘আর সেই মেয়েটা — তাকে কি আর কখনো দেখেছিলেন?’ ‘পনৌলি থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসার আগে মাঝে মধ্যে কুসুমকে রাস্তায় দেখতাম, সাধারণতঃ স্কুলে যাওয়ার পথেই। কুসুম জোড়হাতে আমাকে অভিবাদন জানাত, আঙ্কল বলে ডাকত।‘ বিয়ারের বোতলগুলো ততক্ষণে সব খালি। কিমতলাল চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ‘আমার পুলিশ হওয়া উচিৎ হয় নি ভায়া, উচিৎ হয় নি।‘

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *