• Uncategorized
  • 0

অণুগল্পে গৌতম বাড়ই

গুরুদায়িত্ব

বেলা তো হয়েই আসছিলো।শরতের শেষ।তারপর এক গুরু দায়িত্ব নিয়ে এখানে এসেছি। কাজটি সেরে সন্ধের আগেই দেবীপুর থেকে ফিরতে হবে। লোকজনকে জিগ্গেস করে কবি, নাট্যকার আর প্রাক্তন বিধায়কের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
একজন আচমকা কোথা থেকে এসে জিজ্ঞেস করলো–আপনি কি নতুন এখানে।
–না, মাননে…. হ্যাঁ।
-কি আমতা আমতা করে ঢোক গিলে গিলে কথা বলছেন।
ধমকের সুরেই বললো,বলুন হ্যাঁ।
আমি তো হতবাক।একটা নতুন জায়গা।না গ্রাম না শহর,গঞ্জ বলা যেতে পারে। তারচেয়েও আরো নতুন এই আগন্তুক।চেনা নেই,জানা নেই,একজন ভদ্রলোককে ধমকে দিতে পারে!।আমার তো কম বয়স হলো না,তা প্রায় চব্বিশ।তো আমি ভদ্রলোক বৈ কিছু না। একটা মোটামুটি ভদ্রস্থ সরকারী চাকরী করি। তাও আবার পুলিশ সুপারের অফিসের করণিক কাম টাইপিস্ট। পাবলিক কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে পাওয়া।কোথায় আমি দাপট দেখাবো,না উনি আমায় ধমকে দিলেন।এরপর তিন চারশো মিটার গিয়েছি সবে,কোথা থেকে আরো একজন –বলি, দাদার কোথায় গন্তব্য?এইবারে প্রথম থেকেই কড়া হলাম। আপনার তাতে কি প্রয়োজন?
–ওরে চাঁদু,এ বলে কি রে?আমাদের টাউনে এসেছো।আমায় বলবে নাতো কাকে বলবে?
আমি ওর পাশে চাঁদু টাদু বলে কাউকেই দেখতে পেলাম না।ছাতার টাউন।নিকুচি করেছে।বাস স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে তিনশো মিটার ছাড়ালেই ধানখেত আর গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি নেই,বলে কিনা টাউন!
আমি হাঁটতে লাগলাম।ব্যাটা দেখছি আমায় ফলো করছে।
পুলিশ সুপার সাহেব লোকটি ভালো।আমায় অফিস শুরু হবার পর একটি গুরুত্বপূর্ণ খাম তুলে দেয় হাতে।বলে,এটা নিয়ে দেবীপুর যেতে হবে। প্রাক্তন এম.এল.এ নৌসাদ আলী সাহেবের বাড়ি। তার একমাত্র ভরসা আমি।কড়কড়ে দুটি একশো টাকা দেয় রাস্তার খরচের জন্য। দেখলাম বড়োবাবু আড়চোখে আমায় দেখছেন।পরে আবার খরচের ফিরিস্তি নিয়ে ভাগ না চায়।যা স্বভাব শকুনটার।
আমি বাসস্ট্যান্ড এ নেমে ইস্তক কোনো ভ্যান, রিক্সা কিছু না পেয়ে হেঁটেই রওনা দি, যে সময়ের কথা বলছি তখন মোবাইল ফোন, টোটো লোকে স্বপ্নেও ভাবেনি বা দেখেনি।
পেছনের সেই অনুসরণ করা লোকটি দেখলাম সাঁই সাঁই করে সাইকেল চালিয়ে আমার পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
এ বারে এক বিষম বিপদ এসে হাজির হলো।এই এমন গঞ্জে এরকম ফুলের মতন সুন্দরী!হেসে কিনা বলছে,প্রিয়তম প্রিয় আমার এতোদিন কোথায় ছিলে?
এতক্ষণ যা হোক ছিলাম।এই অচেনা জায়গায় এক সুন্দরী আমায় এসে সুললিত ভাষ্যে কথা বলছে,চেনা নেই জানা নেই,তাও আবার কোথায় ছিলে?পরপর এইসব উদ্ভট ঘটনা,আমায় জায়গাটিকে নিয়ে সন্দিগ্ধ করে তুলছিল। কি কুক্ষণে যে সুপার সাহেবের কথায় রাজী হয়ে গেলাম।নাও এবার ল্যাঠা সামলাও।
ভাবলাম এইবার দৌড়ে পালাই।না ওটা ঠিক দেখাবে না।বেশ সপ্রতিভ ভাব দেখিয়ে বললাম
–ভালো আছি প্রিয়তমা,এবারে একটু দয়া করে বলবে, নৌসাদ সাহেবের বাড়ি কোথায়?
—ঐ তো।
—কোথায়?
—চোখ নেই নাকি?
—–ও, আচ্ছা।সুপারী বাগানের মাঝে কাঠের দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে কিছুটা। ধন্যবাদ।
—–আমায় যেতে হবে?
—না!না! পাগল।তুমি যেদিক দিয়ে এসেছো, ওদিকেই যাও।আমি বাচ্চা না।মনে মনে ভাবছি,অন্য কেসে ফাঁসিয়ে দেবে না তো!
এতো পাগলা গড়ের পাগল রাজা।কাঠের বাড়ির সামনে এসে সবে দাঁড়িয়েছি,ভেতর থেকে কে কর্কশ গলায় বলে উঠলো-কে এয়েছে রে?-কেউ না অতিথি। পুরুষ গলা না মহিলা, বরঞ্চ তৃতীয় লিঙ্গের মনে হলো।এক অদ্ভুত বুড়ো এসে সামনে হাজির,চকচকে টেকো মাথা সিমুই এর মতন কিছু  বিচ্ছিন্ন সাদা সরু দাড়ি গাল বেয়ে,থুতনি বেয়ে নেমে এসেছে।মাথায় টুপি।ঠিক যেন হীরক রাজার দেশে, ফিল্মের সেই বিখ্যাত বিঞ্জানী ।
—-তো কি মতলবে?
-মতলবে।না তো। পুলিশ সুপার সাহেবের নির্দেশে একটা জিনিস দিতে এলাম।
-বেশ।তো কাকে চাই?
প্রাক্তন বিধায়ক নৌসাদ সাহেবকে।
-আমি।
—–ও আপনি। নমস্কার।আমি ঝোলা হাতড়ে বড়ো খামটি ওনার হাতে তুলে দিলাম।এবার তাহলে আসি।
-না।একটু বসতে হবে।অতিথিকে দলাই মালাই না করলে হয়।এসো ঘরে।তবে সন্ধে ছটার পরে এ তল্লাটে থাকতে বলছি না। আমার লোক গিয়ে তোমায় জীবিত বা মৃত বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দেবে।বাড়ির মধ্যে একটা মস্ত খাঁচায় ময়না পাখী। দেয়ালে লেখা—“নাটক শুরু বাসস্ট্যান্ডে, শেষ কবির বাড়ি”। এ্যা,অর্থ কি এর!
নৌসাদ সাহেব বললেন,কি কিছু বলছেন ?
দেখুন আমায় পুলিশ সুপার পাঠিয়েছেন।
ভিতরের ঘর থেকে একজনের আবির্ভাব ঘটলো।আরে এতো অবিকল জয় বাবা ফেলুনাথের বৃদ্ধ নাইফ থ্রোয়ার খেলুড়ে মগনলালের ডেরার!আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম।আরে এবার টার্গেট বোর্ড ঝুলিয়ে আমায় চাক্কু ছুড়বে না তো।
— ব্যাস, নৌসাদ সাহেব আমি চলি।
-বসবেন না?
না। আমার কাজ হয়ে গেছে।চলি।
–আমার লোক আপনায় দিয়ে আসবে স্ট্যান্ডে।
দরকার নেই।ও আমি একাই যেতে পারবো।আমি ততক্ষণে বেড়িয়ে পড়েছি।
সাড়ে চারটে বাজে।দু একজন লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে।আমিও দ্রুত পা চালাচ্ছি।ছটা কেন,যতো তাড়াতাড়ি পারি পালাবো এখান থেকে।একটা ভাড়ার গাড়ি করলেও একশোর কমে হয়ে যাবে।
পরদিন পুলিশ সুপার ডেকে পাঠিয়ে সব খবর নিলেন।আমি বললাম সব ঠিকঠাক দিয়ে এসেছি।আমি কিছু বলবার আগেই সুপার সাহেব বললেন—নৌসাদ সাহেবের শখের যাত্রাদল আছে, নাট্যকার।ভারী মজার মানুষ।ওর বাড়ি যেতে গেলে অনেক মজা।যে একবার গেছে,তার বিচিত্র অভ্যর্থনা টের পেয়েছে।
আমি মনে মনে বললাম হুঁ, বিচিত্র তো বটেই, সিনেমার শ্রদ্ধেয় রায় মহাশয়ের যে বিরাট ভক্ত তাও আমি জানি।সব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।