জোরে হাওয়া বইছে। ঘরে ঢুকে পড়ছে কালবৈশাখীর বাতাস। বৃষ্টিও শুরু হলো। কলি বুঝলো মা গরম চপ আর কফি নিয়ে ঘরে ঢুকছেন। তবু জানলা দিয়ে বাইরের মাঠের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ লাগছে। লকডাউনের দৌলতে কতোদিন পরে একটানা নিজের বাড়িতে। নিজের ঘরে।
কলিদের বাড়িতে ঢোকার মুখে রাস্তায় একটা পলাশগাছ আছে। লাইটপোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগুন রঙের ফুলে ছেয়ে যাওয়া গাছটা আপাদমস্তক ভিজে শান্ত দাঁড়িয়ে মাথা দোলাচ্ছে।
মা ডাকলেন,’ আয়, কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে । ‘
কলি সাড়া দিলো না। বাইরে বড় বড় বৃষ্টির দানা কালো রাস্তার উপর পড়ে কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। কলি চোখ বন্ধ করে ভেজামাটির সোঁদা গন্ধ শ্বাস ভরে বুকে চালান করে দিতে থাকে।
– কি রে আয় ! খাবি তো।
কলি ঘুরে তাকায়। সারাদিন পর একটু আগেই ফিরেছে মেয়েটা। ফ্রেশ হয়ে হলুদ কাফতানে ভারি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কে বলবে, ক’দিন ধরে এই মেয়েটিই জিন্স- শার্ট – বুট পরে মাঝে মধ্যেই হাই স্পিডে বাইক চালিয়ে টিম স্বজনের হয়ে সারা পুরুলিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গ্লাভস-মাস্ক – হেলমেট এ তনুকাও তখন নিজের মেয়েকে চিনতে পারে না।
এদিকে এলোমেলো হাওয়ায় জানলার পর্দা উড়িয়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকে পড়ছে ঘরে।
– জানলাটা বন্ধ করে দিই?
কলি চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘ থাক না মা। ভালো লাগছে তো ! ‘
তনুকাও এসে বসলেন। ‘ আজ খুব ধকল গেছে, নারে? ‘
– তা একটু গেছে মা ! আজ ঘাটশিলার খৈরী প্রাথমিক স্কুলে আশ্রয় নেওয়া বারোজন পরিযায়ী শ্রমিককে খাইয়ে দাইয়ে আই টি আই এর কোয়ারিন্টিন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
তনুকা কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির চোখে তাকালেন। মেয়েটা বিপদে মানুষের পাশে থাকতে পেরে নিজেকে ভুলে গেছে।
– জানো তো, মা। টিম স্বজনের অতনু সহ সকলেই খুব ভালো মানুষ। ওদের সঙ্গে কাজ করতে বেশ আনন্দ হচ্ছে।
– জানিস ! আজ অতনুর বাবা এসেছিলেন।
কফি শেষ করে কাপটি রাখতে রাখতে উত্তর দেয়,’ তাই নাকি ! হঠাৎ উনি এলেন যে ! ‘
– কথায় কথায় উনি অতনুর সঙ্গে তোর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
কলি মুখ ঝাঁকিয়ে তীক্ষ্ম চোখে তাকলো। ঝাঁকুনির তোড়ে ওর খোলা চুল ওর চোখে-মুখে এসে পড়ে। রাগত স্বরে বলে,’ মা ! তুমি ও? দুনিয়ার সবাই জানে তোমার মেয়ে ডিভোর্সি।’
– তাতে কি? ঘর তো করিস নি !
– মা ! আমার একটা চাকরি আছে। কলকাতায় স্যাটলড্। আর কিছু চাই না। তাছাড়া অতনু একজন আইডিয়াল ডাক্তার এবং আমার বন্ধু। ব্যাস।
আর কথা বাড়ানোর সাহস করেন নি তনুকা।
* * * * *
খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তনুকার। পাশের ঘরে আলো জ্বলছে। উঠে এসে ঘুম জড়ানো গলায় অবাক হয়ে বললেন,’ কোথায় যাচ্ছিস কলি? ‘
– অতনুদের বাড়ি।
– সে কি কেন?
– ওর বাবা ফোন করেছিলেন। হঠাৎ খুব জ্বর আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে ওর। কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন।