• Uncategorized
  • 0

অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় অনিন্দ্যকেতন গোস্বামী

আলোকপ্রাপ্ত

তিনদিন ধরে কারেন্ট নেই।
মোমবাতি জ্বালিয়ে খেতে বসেছিলো ওরা।
ডোমনা ওরাও, মাধু ওরাও, আর তাদের নাইনে পড়া মেয়ে ঝিমলি ওরাও। খেতে বসেছে তিনজনে মিলে একগামলা মুড়ি। তাতে না আছে পেঁয়াজ না আছে চানাচুর। কাচের শিশির তলাধরা সরষের তেলদিয়ে মাখিয়ে বসেছে খেতে।
ঝিমলি এখন শিক্ষিত। সে বোঝে, বিপদের দিনে খাবার নিয়ে টু’শব্দটি করতে নেই। বিশেষত এই লকডাউনের সময়ে।
ডোমনা কোথাও কাজে যেতে পারছে না। কেউ তাকে কাজে নিচ্ছেও না। পরশুদিন অঞ্চল থেকে কেজি’দুই চাল দিয়েছিলো। তা কাল অবধি হয়েছে। আজকে শুধুই মুড়ি। যদিও বিকল্প খাদ্য হিসেবে ওরাও পাড়ার অনেকের ঘরেই এখন মুড়ি চলছে। পেটে জামিন দেওয়ার মতন তো কিছু চাই।
শুক্ন মুড়ি চিবোতে চিবোতে ডোমনার চোখে জল এসে যায়। ঝিমলি আজ মুড়িগুলো কি আদর করে খাচ্ছে।
ডোমনা ধরাগলায় বলে ওঠে—খা মা খা। দেখি কাল মাঠে বের হুবো। অনেক জমিনে মসুর তুইলে লিয়ে গিছে। ইন্দুরের মাটি খোঁড়া দেইখেছি। টাঙ্গি মেইরে ইন্দুর ধইরে লিয়ে আইসবো কাইল।
ঝিমলি বলে—না বাবা, তুমি ইন্দুর ধইরবে না। সকলে হামাকে ইস্কুলে ইন্দুরখেঁকো আদিবাসী বইলে খেপায়। আর আমি এখন শিক্ষিত হচ্ছি না, আমাদের ও সব মানায় না…
—কিন্তু এখোন তো পেটে খিঁদে। বাঁইচবো, তো কি কইরে বাঁইচবো?
মাধু ওরাও বাপ বেটির কথা শোনে শুধু…
ঝিমলি উঠে গিয়ে তাকের থেকে একটা পুরোনো স্কুলম্যাগাজিন পেড়ে নিয়ে আসে—শোনো তোমাদের এই বই থেকে একটা গল্প শোনাই…
“অন্তরীক্ষ বোঝো তো? মানে আকাশ। দুটো শকুন তখন ডানায় ভর করে অন্তরীক্ষে দোল খাচ্ছে। অন্তরীক্ষ বলে অন্তরীক্ষ- সে অনে…ক উঁচুতে। একটা আনন্দে কোঁয়াক কোঁয়াক করছে। আরেকটা খিঁদেয় কুঁই কুঁই করে ডাকছে। একটার মাথা উঁচুতে, আরেকটার মাথা নীচে।
খিদেঅলাটা বলছে—আচ্ছা ‘ভাগাড়’ কোথায় বল দেখিনি। খিঁদেয় যে পেট চুঁই চুঁই করছে
অন্যটি তখন তাকে ধমকে বলছে—ধুর শুধু ভাগাড় ভাগাড় করিস, লোকে আমাদের ওতে মন্দ বলে, বুঝিস না?
—খিদেটা তো আর কেউ দেখতে আসছে না?
—এই তোদের মত শকুনের জন্যেই আজ শকুন সমাজ কোনোদিন উপরে উঠতে পারবে না।
—তা হলে অন্য শকুনকে বল আমার খাবার এনে দিতে।
—রাগ করিস না। এমন উঁচুতে ওঠার আনন্দ পেয়েছিস কখনো?
—না, তা অবশ্য পাইনি।
—শোন, উঁচু হল দেবতাদের জায়গা। আর ভাগাড় হলো………
একজন তখন আরেকজনকে নির্লিপ্ত সমাজ বিজ্ঞানীর মত ভাগাড় সম্পর্কে বোঝাবার চেষ্টা করছে। আর অন্যজন তখন ধীরে ধীরে তার অনুগত হচ্ছে। এবার বোধহয় শকুন সমাজের উন্নতি হবে…”
গল্প শেষ করে বাবা-ময়ের দিকে তাকিয়ে ঝিমলি বলে ওঠে—কেমন লাইগলো বটে গল্পটা বাবা? আসলে কি বলো তো, আমাদের ওরাও সমাজের……
গভীর সমাজতাত্ত্বিকের মত গল্পটা ব্যাখ্যা করতে করতে ঝিমলি এবার খিদে মারার পরামর্শ দিচ্ছে তার বাবাকে।
আসলে এমনি ভাবেই প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকে শিক্ষিত শ্রেণিরা অশিক্ষিতদের জটিল সমাজ দর্শন না শেখালে তারা খিদে যন্ত্রণা পেটে চেপে রাখার মন্ত্র পাবে কোথা থেকে ? তা সে শ্রেণিগত ভাবে নিজের মেয়েও হতে পারে… আর ঝিমলিও তো একদিন শিক্ষিতদের কাছ থেকে শিখেছিল এমনই সমাজ ভাবনা। এটাই প্রথাগত।
ডোমনা ওরাও এখন ধীরে ধীরে ঝিমলির কাছে অনুগত হচ্ছে। আর মোমবাতির ঘোলাটে অস্বচ্ছ আলো ডোমনার করোটি ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে মস্তিষ্কে।
খাদ্যতাড়িত ডোমনা এখন আলোকপ্রাপ্ত।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।