নব্বইয়ের দশক নিয়ে সব গল্পই যে রোমান্টিক আর নস্টালজিয়ায় ভর্তি, বললে পুরোপুরি সত্যি বলা হয় না। অনেক সময়ই, নব্বইয়ের ছানাপোনারা বেশ কিছু ব্যাপারে যথেষ্ট ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়েছে, আর তার একমাত্র কারণ যে কালমাহাত্ম্য, তা বলাই বাহুল্য। বেশিদূর যেতে হবে না, স্বাস্থ্যলাভ বা স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারটাই ধরুন। হ্যাঁ, স্বাস্থ্যই সম্পদ বা ‘health is wealth’ কথাগুলো তখনো চালু ছিল, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তার জায়গা ছিল ট্রান্সলেশনের খাতায়। নয়তো, যারা ফুটবল ক্রিকেট খেলে মারাদোনা বা সচিন-সৌরভ হতে চাইত, তারাই ভাবত এসব নিয়ে। আর নিরীহ ছাপোষা বাঙালি সন্তান কনফিউজড হতেই থাকত।
হবে না তো কি? তখন জিম শব্দটাই কেউ শোনেনি, সিক্স প্যাক, এইট প্যাক, সাইজ জিরো তো দূর অস্ত। ডায়েট এর ব্যাপারটাও তাই। খাদ্যপ্রিয় জাত আমরা, মোটিভেশন আসবে কোত্থেকে? তখন মোটিভেশন বলে চোখের সামনে যেসব ‘বিশ্বশ্রী'(এটা আগেও ছিল, এখনকার শ্রী দের সঙ্গে গুলোবেন না), ‘আয়রন ম্যান’ দের ছবি যোগব্যায়ামের বই বা ছোটদের পত্রিকায় দেখা যেত, তাদের বাবরি চুল, মোটকা গোঁফ, গুলি চোখ, আর কয়েকজনের মাথার সামনের খাবলা মারা টাক দেখে মোটিভেশনের বাবা ঠাকুর্দাও পালিয়ে যেত। এমনকি ঋত্বিক রোশন নামক ভদ্রলোকটিও 2000 এর আগে দর্শন দেননি, তাই গোটা নব্বই জুড়েই মোটামুটি খরা। এমনকি সিনেমার নায়ক নায়িকারাও খানিকটা চেনা লোকজনের মতোই। একটু মোটা, কালো, বিকট চুলের স্টাইল, সব চলত। আর এর পরেও যদি কেউ স্বাস্থ্যরক্ষার কথা ভাবত, সে পালোয়ানদের নাম শুনলে ভির্মি খেতই। গামা(মানে কি?) স্যান্ডো( ধুস্ ও তো গেঞ্জি, বাবা- কাকুরা পরে, ও আবার নাম নাকি?), গোবর( এ ম্যা,) এসব নাম শুনেও ভক্তি বা মোটিভেশন কোনটাই আসা সম্ভব ছিল না। নব্বইয়ের শেষদিকে অবশ্য এমটিভি চলে এসেছিল যাতে লোকজন পরিচিত হয় ডায়েট আর র্যাম্প এর মত শব্দের সাথে। কিন্তু ওসব তো মডেলরা করে, আমাদের কি? আমরা ছাত্র, পড়াশোনা করব, খেলাধুলো করব, ঘুম দেব আর রবিবার সকালে লুচি আলুচ্চড়ি, আর দুপুরে পাঁঠার ঝোলভাত খাব। স্বাস্থ্য যায়ে ভাড় মে!
কিন্তু এত সুখ সইলে তো! আবার অভিভাবকদের নাক গলানো। কি, না মেয়ে প্যাংলা হয়ে যাচ্ছে, পায়ে জোর নেই, ছুটতে পারে না, ল্যাগব্যাগ করে পড়ে য়ায়। ব্যস্, বসল গোলটেবিল বৈঠক, ঠিক করা হল যে সাইকেল আর সাঁতার শেখানো হবে। এরপরই আসল মজা।
একটা পুরোনো কবিতা অনুসারে বলাই যায়, ‘জলে না নামিলে কেহ শেখে না সাঁতার, আর সাইকেল শেখেনা কেহ না খেয়ে আছাড়’। হলও তাই। বিকেলের খেলা বন্ধ করে রোজ সুইমিং ক্লাব, টেনে হেঁচড়ে জলে নামানোর চেষ্টা। আর সকালে বাবা অফিস যাওয়ার আগে সাইকেল নিয়ে মাঠে চক্কর। আসলে ভদ্রলোক জানতেন যে নতুন সাইকেল আরোহী আর পাগলা ষাঁড় মোটামুটি একই গোত্রীয় প্রাণী, তাই প্রাথমিক ট্রেনিং গবাদি পশুদের সঙ্গে মাঠেই দেওয়া ভালো। অন্তত ধাক্কা খেয়ে তারা মানুষের মত ঝগড়া করতে আসবে না, নিজেরাই চাঁট, কি গুঁতো মেরে ‘হিসাব বরাবর’ করে নেবে। ফলাফল, অজস্র আছাড়, চোট, আঘাতের পরেও সাইকেল শিখতে খুব একটা সময় লাগল না, কিন্তু ছ মাস টানা চেষ্টা, বকাবকি, চোখরাঙানি এমনকি চড়চাপড় দিয়েও সাঁতারক্লাবের ট্রেনার কাকুরা আমাকে জলে নামাতে পারল না, ভাসতে শেখানো তো দূরের কথা। একে খেলার সময় পুরো বরবাদ, তায় খালি এদের শাসন। তাই বলাবাহুল্য ওদের রীতিমতো অপছন্দ করাটাই স্বাভাবিক ছিল। এদিকে টার্ম শেষ হতে অভিভাবকদের মাথায় হাত, স্বাস্থ্যচর্চার নীটফল গোল্লা। আবার বিপত্তারণ মধূসূদন হয়ে এগিয়ে এলো বাবা। ছ মাসেও যে কাজ ক্লাবের ট্রেনাররা করতে পারে নি, মাত্র পনেরো দিনে করে দেখিয়ে দিল। ক্লাবে ভর্তি থেকেও সাঁতার শিক্ষা হল পাড়ার পুকুরে। পরের বছরগুলোতে আবার ক্লাবে গেলাম, বেশ কিছু বছর সাঁতারও শিখলাম, কিন্তু ট্রেনাররা অপছন্দের মানুষই হয়ে রইলেন, এক আধজন বাদে। অবশ্য ওঁদের দোষ নেই, বড়দের শেখানো অনেক বেশি সহজ, ছোটদের শেখানোর যোগ্যতা সবার থাকে না।
তা সাইকেল হল, সাঁতার ও হল।খিদে বাড়ল, জোর বাড়ল কিনা কে জানে। বড়দের কথামত ভেজা ছোলা, মুগ, সয়াবিন এসবও চিবোতে হত, বেশ রোমন্থক জীব বলে মনে হত নিজেকে। এর মধ্যে স্কুলের ক্লাস উঁচু হতে থাকায় কবে যে এই স্বাস্থ্যরক্ষার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেয়েছিলাম, ঠিক মনেও পড়ে না। তখন অধ্যয়নং তপঃ চলত, পরীক্ষা দিতাম আর ওজন বাড়ত ওজনের মত। একদিন হঠাৎই চোখ খুলল, দেখলাম আশেপাশের সবাই জিম, ডায়েট, এক্সারসাইজ সব করছে, সিক্স প্যাক, সাইজ জিরো সব করে ফেলছে, আমি, বা আমার মত কনফিউজড লোকজনই একগাদা বাড়তি ওজন নিয়ে বসে আছি। আর লোকজনের প্রতিক্রিয়া? সে নাহয় উহ্যই থাক।
যাঃ ইয়ার্কি র ছলে লেখাটা শুরু করেছিলাম, এখন দেখি একটু সিরিয়াস হয়ে গেল। আসলে ওটাই সবচেয়ে বড় বিপদ। প্রতিমূহুর্তে যেখানে বিচার হচ্ছে আমাদের, আমাদের বেড়ে ওঠার, শিক্ষা দীক্ষার, পাওয়া, না পাওয়ার, সেখানে না ঘেঁটে গিয়ে উপায় কি? তাই প্রথমে নিন্দে করতে করতে হঠাৎই দেখি নব্বইয়ের বছরগুলোর প্রশংসা করারও আছে, কারণ সবকিছুর পরেও যে ওরা কাউকে মন্দ না বেসে নিজেকেও ভালোবাসতে শেখায়। সিক্স প্যাক ভালো, নিজের গোলগাল ভুঁড়ি ও মন্দ নয়।ডায়েট ভালো, কিন্তু তার চেয়েও ভালো ফুলকো লুচি, আলুচচ্চড়ি, শীতকালের নলেন গুড়। স্বাস্থ্য আজও সম্পদ, কিন্তু পারফেক্ট চেহারার বদলে সুস্থ নীরোগ থাকলেও সে সম্পদ পাওয়া যায়। তাই বা কম কি?