• Uncategorized
  • 0

ছোটদের জন্য বড়দের লেখায় সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে ঊশ্রী মুখোপাধ্যায় (নব্বইয়ের গল্প – ১৫)

আর একবার যদি….

সব গল্প‌ই একদিন না একদিন শেষ করতে হয়। চাই বা না চাই, মুড়োতেই হয় নস্টালজিয়ার নটেগাছ। কিন্তু গল্প লেখার শেষে স্মৃতির ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসা যে বড়ই শক্ত! কত কিছু লেখা বাকি রয়ে গেল! কত রকম কথা, কত স্মৃতি। যা ভেবেছিলাম, হয়ত তার খুব সামান্যই কি-প‍্যাডে ধরা গেল, বাকিটা রয়ে গেল, মনে। অধরা।
ক্লাস ফোরে পড়ার সময় প্রাইজ পেয়েছিলাম এইচ.জি.ওয়েলস এর টাইম মেশিন। দেব সাহিত্য কুটিরের অনুবাদ ছিল। গল্পটা পড়ে মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম যে টাইম মেশিন পেলেও আর যেখানেই যাই, ভবিষ্যতে কক্ষনো না। গত কয়েক সপ্তাহে এই লেখাটা লিখতে লিখতে হয়ত সেই অদৃশ্য টাইম মেশিনেই মানসভ্রমণ হল, আর মজা এখানেই যে এবারও ভবিষ্যৎ দেখতে একটুও ইচ্ছে করল না। বরং আর একবার প্রাণভরে বাঁচলাম ছোটবেলা, কৈশোর।
আমার টাইম মেশিন থামতে থামতে চলেছিল অনেকগুলো স্টপেজে। চোখের সামনে থেকে বেখাপ্পা লম্বাটে ফ্ল্যাট গুলো সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছিল একতলা-দোতলার সারি, লোহার গেটের ওপরে মাধবীলতার ঝাড়, উঠোনে টগর-জবা-গন্ধরাজ-আম-কাঁঠাল-পেয়ারার গৃহস্থী সুখ। শেষ দুপুরের রোদ আঁকিবুকি কাটছিল ঘুমন্ত মায়ের হাতের চুড়ির সাথে আদ্দেক খোলা ‘মৌরিফুল’ এর পাতায়। এরকম সময়েই, ঠিক এরকম সময়েই টুং করে বেজে উঠত সাইকেলের বেল, খাকি জামাপ‍্যান্ট পরা পিওন এসে দিয়ে যেত হালকা নীল রঙের স্ট‍্যাম্প মারা ইনল‍্যান্ড। আমার টাইম মেশিন আবার শেখালো চিঠি পড়ায় ব‍্যস্ত আমার মা বড়মার পেছনে স্ট‍্যাম্প এর লোভে ঘুরঘুর করা।
চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট শোনা যায়, আজও সন্ধেবেলা পাড়ার সব বাড়ি থেকে শাঁখের শব্দ। অন‍্যান‍্য দিন সেটা পড়তে বসার নির্দেশ হলেও, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন সুর তুলত উৎসবের। প্রায় সবকটা বাড়ির উঠোন, দালান সাজানো থাকত চালগুঁড়োর আলপনায়, ছোট্ট ছোট্ট পায়ের দাগ ফেলে লক্ষ্মী আসতেন সবার ঘরে। অনেক দিন পর আজ আবার মনে পড়ছে যে সেদিনের খিচুড়ির সঙ্গে অপূর্ব স্বাদের পাঁচমিশালি তরকারিকে ‘লাবড়া’ বলে, আবার সব ভাইবোনের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেতে ইচ্ছে করছে প্যাঁচার প্রসাদ ক্ষীরের নাড়ু।
হয়ত এতদিন পর মনেই পড়ত না রোজ বিকেলে খেলতে যাওয়ার তাড়া, তুচ্ছ কারণে ঝগড়া, ‘চিরদিনের আড়ি’ করে বাড়ি চলে যাওয়া। পরদিনই সেই বন্ধুর কাছে অপ্রস্তুত মুখে,”এই আমায় খেলতে নিবি রে”? ক‌ই, ইগোতে তো লাগছে না! টাইম মেশিন তার মানে থাকে।সত্যিই।
বাড়িতে বা পাড়ায় বিয়েবাড়ি হলেই সব ছোটরা একসঙ্গে, তাদের দিকে নজর রাখার জন্য একটু বড়রাও। তখন সব দুষ্টুমি ভুলে মটকা মেরে বড় দিদিদের সিনেমার গল্প বা ভালোলাগার গল্প শোনা আবার নতুন করে শিখতে ইচ্ছে করল। কানের কাছে হঠাৎ ফিসফিস করে মাধুরীকে বলে উঠল সঞ্জয় দত্ত,” মেরা দিল ভি কিতনা পাগল হ‍্যায়, ইয়ে প‍্যার যো তুমসে করতা হ‍্যায়”। ‘প‍্যার’ আর ‘দিল’ এর মাথামুন্ডুও না বুঝে গল্প শুনতে বোধহয় এরকমই লাগত।
সারা দুপুর গা পোড়ানো গরমের পর যখন কালবৈশাখী আসত, তখন নারকোল গাছ থেকে খসে পড়ত মোটা মোটা পাতার ঝাড়। পরদিন সেগুলোতে চড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হত। কতদিন সেরকম গাড়ি চড়া হয়নি, একদিন চড়লে হয়, কিন্তু টানবে কে? আড়াইমণি কৈলাস হলে নস্টালজিয়াও কোথাও না কোথাও রাশ টানতে বাধ্য হয়।
স্কুলের সরস্বতীপুজোর প্রথম শাড়ি পরে বড় হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে সবার হত, কিন্তু পরিবেশন করতে গিয়ে ভারি আঁচলের ধাক্কায় মাটির খুরি উল্টে জল পড়লেই দিদিদের বকুনি, এবং ‘স্বর্গ হ‌ইতে পতন’। আজকাল পংক্তি ভোজেই বসি না, পরিবেশন তো দূরের কথা। কিন্তু কোথা থেকে যেন এখনো শোনা যায়,”অ্যাই মেয়ে, তুমি কোনো কর্মের ন‌ও”।
এরকম অনেক উদ্ভট ইচ্ছে মনে আসছে, এমনকি এটাও মনে হচ্ছে যে সেই সময়টাই বাঁচছি। এখনো হয়ত প্রিয় বন্ধুর দিদির বৌভাতে কনেযাত্রীর বাসে ফিরতে ফিরতে রাত দেড়টায় তারস্বরে চ‍্যাঁচাচ্ছি,”ভূতের দেখা নাই রে, চোরের দেখা নাই”, ভূগোল ব‌ইয়ের পাতার ভেতরে লুকানো পোস্টকার্ড থেকে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন হৃত্বিক রোশন, প্রথম পাওয়া ডেয়ারি মিল্কের কাগজ লুকিয়ে রাখছি ডায়েরিতে, বৃষ্টির দুপুরে ভেজা ইউনিফর্ম পরে ফুচকাওলার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, তেঁতুলজলে বৃষ্টির জল মিশলেও ভ্রুক্ষেপ নেই। হয়ত এই প্রতিটা মুহূর্ত নতুন করে বাঁচার দরকার ছিল, এখনো আছে।’পথের পাঁচালির’ অপুও একসময় যখন ‘অপরাজিত’ হয়ে নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে এসেছিল, তখনও সে তার গ্রামের দেবী বিশালাক্ষীর কাছে চেয়েছিল তার ছোটবেলাটুকুই, যেরকম সব্বাই চায়। সারা জীবন সেই বৃত্তটুকুই সম্পূর্ণ করাই যথেষ্ট, প্রায় সবার জন্যই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।