তাহলে একটা গল্প বলি।এক যে ছিল মেয়ে। বয়স, এই তিন কি চার। বাবা-মা, জেঠু-বড়মা,কাকু-কাকিমা, ঠাম্মা, দিদি সবার ঘেরাটোপে থাকা চিন্তাহীন সুরক্ষিত জীবন। যা সামনে আসে, সব সুন্দর, ভালো। আসলে সবরকম নেতিবাচকতাকে যত্ন করে দূরে সরিয়ে রাখার দরদি হাতের অভাব নেই। কিন্তু এমন সময় কি আর বেশিদিন থাকে?
ঘটনাটা সামান্য। তুচ্ছই বলা চলে। তখন বাড়িতে বাড়িতে গান শোনার জন্য ছিল গ্রামাফোন, এল পি রেকর্ড প্লেয়ার, আর একটু বেশি ভাগ্যবানের বাড়িতে ক্যাসেট প্লেয়ার। ঐ ঠিক যেমন সাদাকালো টিভির ভিড়ে এক আধটা রঙিন। মেয়েটির বাড়িতেও একটা এল পি রেকর্ড প্লেয়ার ছিল আর তার সঙ্গে একগাদা রেকর্ড। একদিন দুপুরবেলায় রেকর্ডের ভিড় সরিয়ে একটা রেকর্ড বার করলেন মা। বললেন,’এটা শোন, ছোটদের, ঠাকুরমার ঝুলি’।ছোটদের শুনে অসীম কৌতুহলে এগিয়ে এল মেয়েটা, রেকর্ডের খাপ এর রঙিন ছবিটা দেখতে। ‘এ কি ছবি! ঠিক মধ্যিখানে একটা বীভৎস প্রাণী, বড়বড় দাঁত, লাল চোখ, হাঁ করে রয়েছে। তার দুপাশে দুটো ঐ একই রকম দেখতে একটু ছোট আকারের প্রাণী, তারাও কম বীভৎস নয়। একদমই আশেপাশের ভালো মানুষগুলোর মত দেখতে নয়। অবশ্য মানুষের মত দেখতেও দুজন ছিল, জানলার মধ্যে দিয়ে দেখা এক ঘুমন্ত রাজকন্যা আর খানিকটা দূরে ঘোড়ায় চড়ে আসতে থাকা এক রাজপুত্র। এসব কি? না, শুনতে ইচ্ছে করছে না, ভালো লাগছে না, ছবিটা কি বিশ্রী!মা প্লিজ চালিও না।’ —“দূর পাগল, রূপকথার গল্প তো, শোন, ভালো লাগবে”। আর ভালো! পিন রেকর্ডে ছোঁয়ানো মাত্রই খুব কাছ থেকে একদল হয়ত ঐ ছবির মতোই বীভৎস জীব আরো বেশি বীভৎস খোনা গলায় চিৎকার করে উঠল,”হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ”। ”প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে, এখান থেকে,ঐ বিশ্রী শব্দগুলোর থেকে, ঐ ভয়ঙ্কর ছবিটার থেকে যতদূর সম্ভব পালাতে চাই”— কথাগুলো মেয়েটার মনে এলেও এক অজানা অনুভূতি তাকে বোবা করে রেখেছিল, কারণ তখনো সে জানত না যে এই অনুভূতিরই অন্য নাম ভয়। সে ভয় আরো বাড়তে লাগল যখন সে জানতে পারল যে এই বিশ্রী জীবগুলোর নাম রাক্ষস, শুধু তাই নয় এদের একজন রানী আছে, যে সবচেয়ে ভয়ংকর, কালো ঘোমটার আড়ে উঁকিঝুঁকি মারে, তার জিভ লকলক করে, কড়মড় করে সে সতীন পুতকে চিবিয়ে খায়, এমনকি নিজের পুতকেও ছাড়ে না। ওহ্ মা গো!এসব কি শোনালে কেন শোনালে? মন্দিরে খোক্কসদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ করে ভেসে আসে কান ফাটানো চিৎকার, খোনা গলায় হাসি। শুধু লালকমল নীলকমল কেই নয়, মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করেও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় কিছু রক্তখেকো,’ ঘরে কে জাগে?’ অবশ্য এই সবকিছুর মধ্যেও জটিবুড়ির দেওয়া লোহার কড়াই খাওয়ার গল্পে যে আমোদ হয়না, তা নয়। কিন্তু তা হলেও একটা রেকর্ড মেয়েটার জীবন বদলে দিল। তখন তার বুকের মধ্যে ভয়ের বাসা। জীবনের সব কিছু আর আগের মত সুন্দর লাগছে না। রাতগুলো আর আগের মত নেই, হয়ত অন্ধকারে ঘর থেকে বাথরুমে যাওয়ার রাস্তায় তার দিকে লোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোন কালো ঘোমটায় ঢাকা দাঁতবিকটী, যার ঘোমটার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তমাখা লকলকে লাল জিভ। মেয়েটার ভয় বাড়ে, বদনাম হয় ভিতু বলে, পাড়ায় খেলতে গেলে দুষ্টু ছেলেমেয়েরা খ্যাপায়, ভয় দেখায়। আর অনেক দূরে মেয়েটাকে কাঁপতে দেখে খোনা গলায় হাসে এক রাক্ষসী রানী।
মায়ের কাছে রোজ কাঁদতে কাঁদতে ফেরে মেয়েটা। কি শোনালে আমায়, আমার যা ভালো ছিল সব চলে গেল। মা’ও অপ্রস্তুত। এরকম যে হবে তিনি নিজেও ভাবেন নি। দিন মাস বছর ঘুরেছে, ভয় কমেনি মেয়ের। এরকম তো সবার হয় না, এমনকি তাঁর বড় মেয়ের ও হয়নি। এতটা কেন হচ্ছে? বাধ্য হয়েই রেকর্ডটা সরিয়ে রাখলেন মা। মেয়ের হাতে তুলে দিলেন নীল কাপড়ের মলাট দেওয়া এক বই, সোনালী অক্ষরে লেখা,’দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রণীত ঠাকুরমার ঝুলি”। উৎসাহের চোটে বইএর মাঝখানের পাতা খুলেই আর এক বিপদ। খুলবি তো খোল লালকমল নীলকমলেরই প্রথম পাতা, আর জিভ লকলক রাক্ষসী রানীর ভাঁটার মত চোখ। বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মেয়ে। “একবার অন্তত চেষ্টা কর”— মা এর কথায় সেদিন তুলে নিলেও পড়ার সাহস হয়নি। এগিয়ে এল দিদি, পড়ে শোনাতে শুরু করল, দুধের সাগর, রূপতরাসী, চ্যাংব্যাং এর গল্প। মেয়ের চোখের সামনে এক নতুন পৃথিবী যেখানে হীরার গাছে সোনার পাখি ডাকে, রাজকন্যার সাথে গল্প করে শুক পাখি, প্যাঁচা আর বানর জিতে যায় রাজপুত্রদের হারিয়ে, আর হুলোবেড়াল ঘোড়ার পিঠে চড়ে চোর ডাকাতের সঙ্গে যুদ্ধে নামে দেড় আঙুলে ছেলে, যার তিন আঙুলে টিকি। শেয়াল পন্ডিত, শীতবসন্ত, কিরণমালা, বুদ্ধুভুতুম সব্বাই বন্ধু হয়ে যায় মেয়েটার, খালি তখনো দূরে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে থাকে রাক্ষসী রানী। ভয় যে এখনো কাটেনি।
এভাবেই কেটে গেল আরো নয় দশ বছর। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মেয়ের। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি স্কুল, বাসে চড়ে যাওয়া আসা, নতুন বইপড়া, রূপকথার জায়গা নিয়েছে ফেলুদা, কাকাবাবু, টেনিদা, পান্ডব গোয়েন্দা। এমন সময় ঠিক হল যে স্কুলে নৃত্যনাট্য হবে লালকমল নীলকমল। সেই এল পি রেকর্ডের গান, যার সুরকার ছিলেন নচিকেতা ঘোষ। ঘটনাচক্রে মেয়েটিকে দায়িত্ব দেওয়া হল পরিচালনার। ফলে একদিন সন্ধেয় আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতোই মেয়েটা ধুলো ঝেড়ে বার করল রাক্ষুসে ছবিওয়ালা সেই রেকর্ড। দিদিকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় তার হাত ধরেই বসল শুনতে। এখনো সেই আতঙ্ক, শিরশিরে অনুভূতি। কিন্তু শুনতে হবেই। একবার না, বারবার। অজস্রবার।
তা সে শুনল। যতবার শুনল ভয় কাটল একটু একটু করে। যত্ন করে নিজের গলায় তুলে নিল সেই হরবোলা আওয়াজ, রাক্ষস খোক্কসদের চিৎকার, খোনা হাসি, রাক্ষসী রানীর সংলাপ। ভয়ের পর্দা সরল, আগ্রহ বাড়ল। অনুষ্ঠানের পর আবার সে তুলে নিল ঠাকুরমার ঝুলি।
ভয়ের পর্দা সরলেও অজ্ঞতার পর্দা সরে যাওয়া তখনো বাকি ছিল মেয়েটার। আরো কবছর সময় লাগল। ততদিনে আরো অনেক বই পড়েছে সে, এগিয়ে গিয়েছে উচ্চশিক্ষার রাস্তায়। ঠাকুরমার ঝুলিও পড়েছে, অজস্রবার। আর প্রতিবার নতুন করে চিনতে পেরেছে চরিত্রদের। আজকাল তার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই রাক্ষসী রানী। সে চোখে লোভ নেই, খিদে নেই, বরং একটা চাপা যন্ত্রণা আছে। যেন বলতে চায়, “এখন বুঝেছ তো, আমি কে? আমি ঠিক কেন রাক্ষসী রানী? রাজার বুড়ো বয়সের ছোটরানী আমি, যতদিন রাজা আছে আমার ঠাটবাট ঠিক ততদিনের। রাজা গেলেই প্রাসাদের রাজনীতি গিলে খেত আমায়। হয়ত পুড়িয়ে দিত রাজার মৃতদেহের সঙ্গে, কারণ বড় ‘লক্ষ্মীরানীকে’ তো বাঁচতে দিতে হবে, সে যে লক্ষ্মী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নীতিবোধে সাজানো। আমি তো তা নই, তাই তো আমার মূলোর মত দাঁত, কুলোর মত কান, লকলকে জিভ, সে এমনিতে থাক বা না থাক। আসলে আমি স্বামী পুত্রের বাইরে গিয়ে নিজেরটা ভেবেছি, আমার লোভ রক্ত মাংসের থেকেও বেশি ক্ষমতার, যা একটা পুরুষমানুষের থাকলে তার প্রশংসা হয়। আর আমি হয়ে যাই রাক্ষসী, যাকে নিজের অস্তিত্ব, ক্ষমতা বাঁচাতে বীভৎস হতে হয়েছে। কিছুটা আমি নিজে হয়েছি, বাকিটা বানিয়েছে সমাজ, নয় তো রাজপুত্রদের জয় দেখানো যায় না। আচ্ছা বলো তো, সব গল্পই তো পড়েছ, আমি কি সেই ‘মানুষদের’ থেকেও খারাপ যারা সদ্যোজাত শিশুদের ছাইগাদায় পুঁতে দিল, বা মুখে নুন দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিল? নাকি আমি সেই ভাইদের মত যারা উপকারী ভাইকে স্রেফ ঈর্ষা র জন্যে সমুদ্রে ফেলে দিল? আসলে কি জানো, লক্ষ্মী, বেচারি, দুয়োরানীদের জন্যে আহা করতে মানুষ ভালোবাসে, আর যে নিজের জন্য কিছু চায় তার অবস্থা হয় আমার মত। আচ্ছা একটা কথা ভেবে দেখেছ কি? এই যে তুমি ছোটবেলায় এত ভয় পেতে আমায়, এটা কমল কি করে? ভেবেছ কখনো? তুমি বলবে বড় হয়েছ, সাহস বেড়েছে। তা কিন্তু নয়। ভয়ের বাস মনের অনেক গভীরে। আমার ভয় তখনই কমেছে যখন আমার থেকেও ভয়ঙ্কর কোনো দুপেয়ে জীবকে সামনে দেখেছ। তাদের কিন্তু তোমার মতোই দেখতে। এই দুপেয়ে গুলোর ভাঁটার মত চোখ না, দৃষ্টির নোংরামি ভয় ধরায়। বাসে ট্রেনে সর্বত্র ভীড়ের সুযোগ নিয়ে তোমাদের যন্ত্রণা দেয়, একা গলিতে ভয় দেখায়, ছোটবেলায় আদরের নামে অত্যাচার করে,অ্যাসিড মারে, চরম কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলে, এরাই। এরাও তো রাক্ষস, মানুষের রূপে।আমাদের মত এদের রূপ দেখতে তরাস লাগে না, বলি চিনবে কি করে?—–”
গল্পটা এতটা লিখে, চুপ করে বসে ছিলাম। কি লিখতাম! ভয় আর ভয়কে জয় করার থেকেও বড় প্রশ্ন সামনে এসেছে, রাক্ষস আসলে কে? গল্পকথার ছোটরানী? না বাস্তবের দু পেয়ে? যারা রক্ত, মাংসের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস, সাহস, সম্মান জীবনীশক্তি,সর্বস্ব খায়??? কি লিখব? হয়ত উত্তর খুঁজতে সাহায্য করবে বলেই এই সময় পাশের বাড়ি থেকে ফুড়ুৎ করে উড়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরল এক ছোট্ট পরী। সবে সে লালকমল নীলকমল এর গল্পটি শুনেছে আর ভয়ের থেকে তার কৌতুহলই বেশি।
“ও মিস, অজিত- কুসুমই তো লালকমল নীলকমল বলো? তাহলে প্রথমে ওদের রাক্ষসে খেল, আর পরে ওরাই রাক্ষসদের মারল, কি করে? ওদের কি পরে গায়ে জোর হয়ে গেছিল?”
“দূর পাগলি, তা হয় কখনো? জোর তো ওদের ছিলোই, তবে সেটা তারা প্রথমে বোঝেনি। আর তার থেকেও বেশি এটা বোঝেনি যে রাক্ষসটা কে আর তার আক্রমণ কোথা থেকে আসবে। তাই লালকমল নীলকমল হয়ে তারা নিজের শক্তি চিনেছে, সেইসঙ্গে রাক্ষসকেও। চিনতে পারলে তবেই তো রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করা যায়, এমনকি মানুষ-রাক্ষসের সঙ্গেও। বড় হয়ে বুঝবি সেটা। এখন গল্প শোন”।