ক্যাফে ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ৩০)

নবম অধ্যায়
তৃতীয় পর্ব—-
কাহিনীকার বলে চলেছে,”ভগৎ সিংজি ছিলেন নাস্তিক;ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বড় হলেও,পরবর্তী কালে,সমাজতান্ত্রিক অনুপ্রেরণায় হয়ে উঠলেন,সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধী; তাঁর মৃত্যুর সময়ও কোন রকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেননি,এমন কী ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত নেননি।তাঁর ধর্ম ছিল মানবতা, মানুষই ছিল দেবতা,তাই মানুষের জয়গান গাইতে গাইতে চলে গেলেন;যাবার সময়ও,দেশের যুবসমাজকে উদ্দীপিত করে গেলেন,বিপ্লবের বাণী শুনিয়ে, ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ ‘বলে -ঘুমন্ত জাতিকে নাড়া দিয়ে গেলেন; বলে গেলেন,’পড়,পড়,
দেশের ইতিহাস পড়,পৃথিবীর ইতিহাস পড়;শিক্ষাই গড়ে দেবে জীবনের গতিপথ,শিক্ষাই আনবে চেতনা;রেভোলিয়ুশনের অর্থ, কেবল ক্ষমতার হস্তান্তর নয়,রাষ্ট্রিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন- ই মানুষের মঙ্গলজনক হবে;দেশের মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে; মনে রাখতে হবে,রেভোলিয়ুশনের অর্থ রক্তপাত, বোমা,পিস্তল নয়;শান্তিপূর্ণ ভাবেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব, কিন্ত, সুবিধাবাদী,কায়েমী- স্বার্থের দল তো বাধা দেবেই, সহজে কোন দেশেই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়নি,তাই বোমা,পিস্তল,হিংসাও একেবারেই পরিহার সম্ভব নয়;মনে রাখতে হবে,সামাজিক অত্যাচার,অসাম্য,
আর্থিক- অসমবণ্টন ব্যবস্থার পরিবর্তনই হবে লক্ষ্য, আর তা কার্যকর করতে গেলে আমূল সংস্কার দরকার; কায়েমী স্বার্থ , সব সময় এই আমূল সংস্কারের বিরোধী,তাই সংঘাত অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে,স্বাধীনতা,মানুষের জন্মগত অধিকার, তা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না’।’কাকোরী ষড়যন্ত্র ‘ মামলায় জড়িত সন্দেহে অ্যারেষ্ট হবার (1927,মে মাস) পরই তার মধ্যে রোমান্টিক বৈপ্লবিক চেতনার পরিবর্তে, ঘটলো সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ; মার্ক্সীয় সাহিত্যের প্রভাবে তিনি হয়ে উঠলেন একজন সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক চেতনার ঋত্বিক;জীবনের গতিপথে এল আমূল পরিবর্তন। ”
“তাঁদের ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে
সারা দেশের নজর যখন ভাইসরয় আরউইন- গান্ধীজির গোল-টেবিল বৈঠকের দিকে , সবাই যখন গান্ধীজির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল,হয়তো উনি,বৈঠকে এ নিয়ে কিছু একটা করবেন, কিন্ত, না,তিনি ফাঁসির বিষয় উত্থাপনই করেননি;উল্টে,বৈঠক শেষে আরউইন এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে,গান্ধীজি বলেন,’it’s your law and order problem’.একথা আরউইন,ওঁনার জীবনকথায় লিখে রেখে গেছেন।গান্ধীজি যে বলবেন না,তা গান্ধীজি যেমন জানতেন,ভগৎ সিংজিও তা নিশ্চিত ছিলেন।বৃটিশ সরকারও নিশ্চিত ছিল,ফাঁসিই ছিল অনিবার্য পরিণতি।প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের পরই(1857সালের সিপাহী বিদ্রোহ)বৃটিশরা বুঝতে পেরেছিল,একদিন না একদিন, এ দেশ ছেড়ে যেতেই হবে; যাবার সময়,গান্ধীজির অনুগত কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা থাকলে নিজেদের অর্থনৈতিক সুযোগ- সুবিধা বজায় রাখা
সম্ভব হবে।বৃটিশ সরকার, ভগৎ সিংজি’র মধ্যে লেলিনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিল;আমূল সংস্কারপন্থী,কায়েমী- স্বার্থের বিরোধী–সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়,এমন ব্যক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে,নিষ্কণ্টক হওয়াই ছিল বৃটিশ সরকারের কাছে একমাত্র উপায়।”
কাহিনীকার বলে চলেছে,”ফাঁসির আগের দিনও সবাই দেখা করতে এলে,তিনি বলছেন, ‘ফির মিলিঙ্গে’।এখন ভগৎ,সুখদেব ও রাজগুরুর সেল শূন্য।গণ্ডগোলের আশঙ্কায়,ওদের দেহ কেটে টুকরো,টুকরো করে বস্তায় পুরে,জেলের পিছনের প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙ্গে,সেখান দিয়ে গাড়ী করে
নিয়ে যাওয়া হয়েছে হুসেনইওয়ালার,সতলুজ নদীর ধারে,Ganda Singh Wallaগ্রামের গভীর জঙ্গলে;সবে মৃতদেহের টুকরো গুলোতে কেরোসিন ঢেলে
আগুন ধরানো হয়েছে,এমন সময়,নদীর ধারে আগুনের হল্কা দূর থেকে দেখতে পেয়ে মানুষজন,রে,রে
করে ছুটে আসছে; সবাই তো মনমরা, একটা ভয়ংকর কিছু ঘটনা ঘটতে চলেছে অনুমান করেছে।মানুষজন,জেলের সামনের গেটে অপেক্ষা করছিল;কিন্ত, মৃতদেহ নিয়ে এ অসম্মান, তারা আর মানতে রাজি নয়: ধাওয়া করেছে পুলিশের লোককে; আধপোড়া দেহাংশ রেখে,বৃটিশের দালাল,ভারতীয় পুলিশ দিল, পিছুটান।
ঐ আধপোড়া দেহের টুকরোগুলো নিয়ে রাভি নদীর ধারে শহীদদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।মরদেহের কিছু অংশ,মানুষজন রেখে দেয়;সেগুলো পিতৃপুরুষদের গ্রামে ভগৎ সিং মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করা আছে।”
“জীবিত ভগৎসিংজি অপেক্ষা মৃত ভগৎসিংজি ভয়ংকর, ডানা মেলে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে,দিকে,দিকে সশস্ত্র আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছে।মৃতের প্রতি এ অসম্মান দেখেও তথাকথিত জাতির পিতা রয়েছেন নিশ্চুপ, নিরুত্তর।গান্ধীজি বলছেন, ‘দেশের যুব- সমাজ
ওদের পথ অনুসরণ করবে না’।দেশের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য প্রশংসা করেছেন,তাঁদের সম্মান জানিয়েছেন। ভির সাভারকারের প্রতি ভগৎ সিংজি’র ছিল অসীম শ্রদ্ধা;সাভারকারের মারাঠী ভাষায় লেখা First Indian War Of Independence বইটি বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে।বইটির হিন্দী অনুবাদ ছিল,ভগৎসিংজির প্রিয়;বইটিতে হিন্দু- মুসলমান, উভয়েরই অবদান স্বীকার করা হয়েছে;পরে,সাভারকারের অন্যান্য লেখার মধ্যে হিন্দূত্র ছা টাই প্রকট হয়ে ওঠে,সাম্প্রদায়িক ভাবটা প্রাধান্য পায়।হয়তো এজন্যই ,সাভারকারের দিক থেকে,ঐ তিনজন বিপ্লবীর ফাঁসির
ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তিন বিপ্লবীর ফাঁসির মাত্র ষোল বছরের মধ্যেই বৃটিশকে ভারত ছাড়তে হয়েছে।”
“হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছে,প্রত্যেকের খোলা মাথা,মেয়েরা রয়েছে কালো পোষাকে,ধ্বনি উঠেছে,’ইনক্লাব জিন্দাবাদ, ভগৎ সিং,জিন্দাবাদ, রাজগুরু জিন্দাবাদ, সুখদেব জিন্দাবাদ। ”
চলবে