শহরতলির ইতিকথা
হাজরা দম্পতির বড় মেয়ে রেনুকা, বাপের নতুন বাড়িতে এসেছে; জামাইও সঙ্গে এসেছে। জামাই’র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে
হৈমবতী বলে, “বাবা, তোমার জন্যই, আমরা এ পাড়ার বাসিন্দা হতে পারলাম।”
জামাই, দিব্যেন্দু কোনার উত্তরে বলে, “ভালোই হয়েছে, এ পাড়ার সঙ্গে তো সকলের নাড়ির টান গড়ে উঠেছে;
ঐ বাড়ির আম গাছের তলায় গর্ত করে যখন রজতকে দাঁড় করিয়ে ওর পুঁয়ে পাওয়া রোগ সাড়াবার প্রক্রিয়া চলছিল, খুবই মায়া হত; এখন দেখুন, এ বাড়িতে আসার পর, ও মোটামুটি, সুস্থ হয়ে চলতে পারছে; এ বাড়ি, আপনাদের কাছে, সৌভাগ্যের প্রতীক বলা যেতে পারে।”
জামাই, নতুন বাড়ি হতে সজীবের সাইকেলে রজতকে বসিয়ে চুঁচুড়ায় কৈরী সিনেমায় ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ছবি দেখে এলো। রজত, এই প্রথম অঞ্চলের বাইরে গেল, সিনেমা দেখলো। কয়েকদিন বেশ হইহই করে, একটা ঘোরের মধ্যে দিনগুলো কেটেছে।
মেয়ে, অন্তঃসত্ত্বা, তিন মাস চলছে, খবরে হাজরা পরিবারের খুশির হাওয়া। এর পর, আর এখন আসা যাবে না বলে, জামাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। কয়েকদিন থেকে, ওরা চলে গেল, শ্বশুর বাড়িতেই মেয়ের প্রসব হবে;
ওখানে,ওদের লোকবল আছে,বাড়িও বেশ বড়, তাই জামাই ‘র দাদার অভিমত, ওখানেই ভাই’র সন্তানের জন্ম হোক; হাজরা দম্পতিও সায় দিয়েছে।
একদিন সকাল হতে না হতেই, অবলা মুখুজ্জে এসে বললো, “দাদা,আমার ভাই ‘র স্ত্রী’র আচরন অদ্ভুৎ ঠেকছে, মনে হচ্ছে যেন কোন পুরুষ মানুষ ওর মধ্যে থেকে কথা বলছে, কেমন যেন করছে, একবার আমাদের বাড়িতে চলুন।”
ধর্মদাসমশাই, তড়িঘড়ি, অবলা মুখুজ্জের বাড়ি যেতেই দেখেন, ওপাড়ের পুকুর পাড়ের সব বাসিন্দা, বাড়িতে ভেঙ্গে পড়েছে। নতুন বৌকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে; জানলা দিয়ে, সবাই জিজ্ঞেস করছে,”কোথায় ছিলে, তোমার নাম ইত্যাদি।”অঞ্চলের ধন্বন্তরি পঞ্চু ডাক্তার রায় দিয়েছেন,মানসিক রোগ; এটা তাঁর আওতায় বাইরে, কোনো মানসিক চিকিৎসককে দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন। দিলে হবে কী!লোকে তো অবলাবাবুকে বোঝাচ্ছে, এ সব লক্ষন হচ্ছে, ভূতে ধরা; কোনো ডাক্তারের কম্মো নয়, ভূতের ওঝাই কেবল এ রোগের সমাধান করতে পারবে; নিজেদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে কথাবার্তা চালাচ্ছে। ঘরের মধ্যে থেকে নতুন বৌ’র মুখে পুরুষালি আওয়াজ আসছে,” ওরে,অনেক বকিয়েছিস, দে সিগারেট দে। “অবলাবাবুর ভাই মুখ চূণ করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠোন থেকে খোলা বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ধাপের উপর বসে আছে।
ধর্মদাস মশাই, জানলার বাইরে থেকে, নতুন বৌ’র সঙ্গে কথা বলতেই, তার মধ্যে থাকা কে যেন বলে উঠলো, “ও ধম্ম, তুই এলি কেন, দে তবে তোর চারমিনারই দে।”
“আমাকে তুমি চেন,” ধর্মদাশবাবু বলতেই, ভৌতিক গুরু-গম্ভীর স্বরে নতুন বৌ বলে উঠলো, “দূর শালা, তোকে চিনবো না, তুই তো আমার প্রতিবেশী রে; যখন রাতের বেলা ডিউটি থেকে ফিরিস, আমি তো তখন তাকিয়ে,তাকিয়ে তোকে দেখি।”
“তা তুমি কোথায় থাকো, “জিজ্ঞেস করলো ধর্মদাসবাবু।
“ওরে, ঐ বেলগাছটা দেখছিস, ঐটাই এখন আমার আস্থানা; আগে তো তোর
ভাড়া-বাড়িতে যাবার পথে যে বড় ভাঙ্গা বাড়ি, ওটাতেই থাকতাম। মুসলমান মিস্ত্রীরা এলো থাকতে; ওরা কোরান পড়তো, নামাজ পড়তো; আমার ভালো লাগতো না, আমি হিন্দু ব্রাহ্মণ, তাই ওদের এড়িয়ে, বাড়ির গায়ে যে বেলগাছ দেখছিস, ঐটা এখন আমার আস্থানা; হায় রে! গোপাল মুখুজ্জেকে এখন গাছতলায় থাকতে হচ্ছে।”
“তা, মুখুজ্জে মশাই, আপনার এ হাল হলো কেন?”
“আর বলিস না, ব্যাঙ্কের ক্যাস তছরুপ করার দায়ে, পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে, বংশের মর্যাদা রাখতে কড়িকাঠ থেকে ঝুলে পড়লাম। ব্যস, তারপর থেকেই এই বাড়ি, আর এখন বেলগাছ আমার আশ্রয়স্থল।”
“এ মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে, ও চুল এলো করে আমাকে প্রলুব্ধ করেছে, ওকে নিয়ে আমি চলে যাবো, তোরা বাপু আর আমাকে বিরক্ত করিস না।”
ধর্মদাসবাবু, ওদের গ্রামাঞ্চলে, অনেক ভূতে- ধরা লোককে দেখেছে;
ওঝার মারের চোটে, ভূত পগার পার হয়েছে; গ্রামে-গঞ্জে দেখেছে ওসব, মফঃস্বল শহরে, গিঞ্জি এলাকায় লোকের বাস, ভূতের থাকা কথা নয়; তবু, ভূত যখন নিজেই বলছে, তখন ওঝার সন্ধান চললো।
এদিকে ভূতের খবর অঞ্চলের স্কুলের ছেলেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
রঞ্জন ও ওর বন্ধুরা তো গোগ্রাসে ছায়ামূর্তি সিরিজ গিলে থাকে; দীপক- রতনলালের ফলোয়াররা তো আর দূরে থাকতে পারে না। দলবদ্ধ হয়ে, ভূতের সামনে হাজির। ওদের দেখে, ভূতরূপী নতুন বৌ, জানলার কাছে মুখ এনে বললো, কি রে ভূত দেখতে এসেছিস, ক্যাপস্টান সিগারেট এনেছিস, অ্যাঁ, খালি হাতে; ওয়াক থু!
ছেলেরা অনেক দূরে ছিল,তাই, ওদের গায়ে লাগেনি; এরকম পরিস্থিতি তো দীপককুমার বা রতনলালকে সম্মুখীন হতে হয়নি, হলে তারা কী করতো, সে নিয়ে, তারা আলোচনা করতে করতে নিজেদের বাড়ি ফিরে এসেছে।
ধর্মদাস বাবুর কারখানার লোকের মুখে সংবাদ পেয়ে, ওঝার দলবল চলে এলো; চললো, মারন- উচাটন মন্ত্র প্রয়োগ; শেষে রফা হল, গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে এলে, সে চলে যাবে। অবলাবাবু, সজীবকে নিয়ে গয়ায় গিয়ে ঐ ভূতের, ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করিয়ে ফিরে আসতে না আসতেই আবার সেই একই অবস্থা; এই মেয়েকে পছন্দ হয়েছে, অতএব একে নিয়ে যাবে। ওঝা এসে বললো,বাবা, এ ব্রহ্মদৈত্য, সহজে হবে না। তিনদিন কেউ এ সীমানার মধ্যে আসবে না; আমার লোক দেহ-বন্ধন করে চারদিকে পাহারায় থাকবে। আপনারা তিনদিন, এদিকে আসবেন না, এলে কিন্ত মারা পড়বেন। ও ক্ষেপে, যাকে পারবে, তাকেই মারবে।
চাচা, আপন বাঁচা প্রবাদ স্মরণ করে, তিনদিন ভূতে-ধরা বৌকে ঐ ওঝার দলবলের হাতে ছেড়ে সবাই ঐ তিনদিনের শেষের জন্য অপেক্ষা করেছে। রাতে হয় চীৎকার, আর্তনাদ; ধোঁয়ার চারদিক ছেয়ে, ঘরে কখনও ওঝার মন্ত্র, আবার কখনও ওর প্রধান শিষ্যের গলা শোনা গেছে। তিনদিনের মাথায় ভূতরূপী ব্রহ্মদৈত্য নেতিয়ে পড়েছে। ওঝা, যা বলছে, ভূত তাই করছে। সকলের সামনে জুতো মুখে নিয়ে, সে উঠোনের মাঝখানে গিয়ে অদৃশ্য হল। নতুন বৌ, উঠোনে অজ্ঞান; কাপড়-চোপর সব ঠিক করিয়ে ঘরে নিয়ে চললো শুশ্রুষা। কিছুদিন পরে নতুন বৌ একেবারে স্বাভাবিক; এক ফুটফুটে পুত্র-সন্তানের জন্ম দিয়ে মুখুজ্জে বংশের গরিমা বৃদ্ধি করলো।
চলবে