শহরতলির ইতিকথা
পাড়ায় ছেলেরা একসঙ্গে বিকেলবেলা কত রকম খেলা খেলে থাকে, তর্কাতর্কি হয়, বসচা হয়, একটু আধটু হাতাহাতি যে হয় না, তা তো নয়; মিত্তির মশাই ‘র আত্মীয়রা তখন ছেলেদের পক্ষ নিয়ে রে, রে করে, “বাস তুলে দেব, ভাড়াটেদের এত আর্স্পদা” ইত্যাদি বলে শাসিয়ে থাকে। নাঃ! ধর্মদাসবাবু, ওদের মত নিচে নামতে পারে না; মিত্তির মশাই ‘র বাড়িতে ভাড়া আছে; তো, আত্মীয়দের এধরনের কথা বলাই সাজে না, তবু মাতব্বরি করা চাই; নিজেদের বাড়ি আছে কি না! সবচেয়ে দুঃখের কথা, নিভাননী দেবী বা তাঁর মেয়েরাও ঐ আত্মীয়দের কুকথার কোনো প্রতিবাদ না করায়, ধর্মদাসবাবুও মনস্থির করে ফেলেছে, এ পাড়াতেই নিজের আবাসস্থল তৈরি করবে, ওদের মুখে ঝামা ঘষে, নিজের উগ্র-ক্ষত্রিয় জাতের উগ্রতা প্রকাশ করে, মোক্ষম জবাব দেবে; কয়েকশো বিঘের চাষ হয় তাঁদের দেশের বাড়িতে, হয় দুর্গোৎসব; এপাড়ার বেশ কয়েকটা বাড়ি যোগ করলে দাঁড়াবে তাঁদের ঠাকুর বাড়ি, আছে সেখানে বৈঠকখানা, গ্রামের বিভিন্ন থাকের মানুষের জন্য রয়েছে হুঁকো–সবাই, সবাইকে বয়সের তারতম্যে সম্বোধন করে -দাদা, খুড়ো, আরো কত কি! আর এরা!
একদিন দেখে, ভাড়া-বাড়ির সামনে থাকা জঙ্গল পরিষ্কার হচ্ছে; ওপাড়ার কথকঠাকুর মশাই দাঁড়িয়ে থেকে মজুরদের নির্দেশ দিচ্ছেন। ধর্মদাস বাবুকে দেখে বলেন, “এ জায়গার মালিক যারা, সব বিক্রি করবে বলে মনস্থ করেছে ; আমিই সব দেখাশোনা করি। ঐ যে ভাঙ্গা বাড়িটা দেখছো, রাস্তা থেকে ঐ বাড়িতে ঢোকার জন্য মাঝে সাতফুট মত জায়গা রয়েছে; ঐ রাস্তার ওদিকের জায়গার বিক্রির বায়নামা হয়ে গেছে; তুমি যদি এ জায়গাটা নাও, তো আমি তোমাকেই, এ জায়গা কেনার ব্যবস্থা করে দিতে পারি, এখনও কেউ বায়নামা করেনি; তুমি চল্লিশ টাকা দিয়ে বায়নামা করে, এ পাড়াতেই থিতু হয়ে যাও; দু’কাঠা দু’ছটাক মত জায়গা; সত্তর টাকা কাঠা হিসেবে জায়গা বিক্রি হচ্ছে; সব বায়নামা হয়ে গেলে, মালিকেরা এসে একদিন রেজিষ্ট্রেশন করে দিয়ে যাবে; আমি চাই, তুমি এ পাড়াতেই থিতু হও।”
“আচ্ছা,কাকা,আমি কাল আপনাকে বায়নামার টাকাটা বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবো,” বলে ধর্মদাসবাবু নিজের দিকের সদর দিয়ে ভাড়া-বাড়িতে ঢুকলেন। বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে, পরের দিন, বায়নামার টাকা দিয়ে এল; দিন কুড়ি পরে, রেজিস্ট্রেশনের দিন বাকি একশো টাকা দিতে হবে, কথা হয়েছে।
এই কথকঠাকুর মশাই ‘র রয়েছে, বাগান, পুকুর ও বড় বাড়ি; এখন তা জীর্ণ দশাতেই বলা যেতে পারে। ওনার পুর্বপুরুষেরা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন; কথকের বৃত্তি যে সম্মানজনক ও অর্থকরী ছিল, তা, তাঁর সম্পত্তির বহর দেখলেই বোঝা যায়। এখন তো আর সে সুদিন নেই; সম্পত্তি বিক্রি করে দিন চলছে; একই জমি কত লোককে যে বিক্রি করেছেন, তার প্রমাণ মেলে, যখন ক্রেতার দল এসে বাড়িতে হামলা করে। এরকম লোকের প্রতি বিশ্বাস রাখতে একটু কিন্ত, কিন্ত, লাগছে; তবে ভরসা এই যে জমিটা ওনার নয়,ভাড়া বাড়ির পাশে, যে ভাঙ্গা বাড়ি, পুজো দালান রয়েছে, তাঁদের; তাঁরা কোলকাতায় বসবাস করেন, পুরোনো জমিদার, আর এই কথকঠাকুর মশাইরা, বংশপরম্পরায় এই জমিদারদের ছত্রছায়ায় বৃদ্ধি পেয়েছেন; সুতরাং, জমিদারদের নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু করতে সাহসী হবেন না, এটুকু ভাবা যেতেই পারে, আর পাশের জমির ভাবী-ক্রেতারাও বায়নামা করেছে, আবার ওঁর নাতিও (মেয়ের ঘরের) নিভাননী দেবীর মেয়ে রমার কাছে, প্রায় দিনই সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত গল্প করে, ধর্মদাসবাবুকে বেশ.সম্মান করে, সুতরাং, এটুকু ঝুঁকি নেওয়াই যেতে পারে।
হাতে তো টাকা নেই, যা হোক দিন পনেরো সময় পাওয়া গেল। জামাই ‘র কাছে, যদি টাকাটা ধার হিসেবে পাওয়া যায় তো, আর চিন্তা থাকে না। একটা চিঠি লিখে, ধর্মদাসবাবু রঞ্জনকে মেয়ের বাড়ি পাঠালো; রঞ্জনের জামাই বাবুরা বড় চাষী, আবার কয়েক ভাই, পোষ্টাল ডিপার্টমেন্টে বিভিন্ন পোষ্টে চাকরি করে; কাঁচা টাকা, সাধারনত চাষীর ঘরে থাকে না; যাই হোক, জামাই-দা, একশো টাকার একটা কলাগাছ ছাপ দেওয়া নোট,বেশ ভালো করে তাবিজের মত করে, রঞ্জনের হাতে বেঁধে দিয়েছে, গায়ে রয়েছে ফুল হাতা জামা। রঞ্জন, এখনো সে দিনের ছবি, স্পষ্ট দেখতে পায়। জামাইদার টাকায়, তারা আজএ পাড়ায় বাসিন্দা হয়েছে; সেদিনের কথা ভাবলে তাদের কাছে, জামাইদার ঋণ অশোধ্য বলেই মনে হয়।