সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৩)

সাদা মিহি বালি

(দ্বিতীয় অধ্যায় – তৃতীয় পর্ব)

পাশের শহরের মিউনিসিপ্যালিটির পানীয় জল- প্রকল্পের উদ্বোধন হবে। জল- কলের মাঠে বিশাল, বিশাল জলাধার করে গঙ্গার জল পরিশ্রুত করার প্রক্রিয়াতে, গঙ্গার সাদা বালি অপরিহার্য; আর এ তল্লাটে, সেই ইংরেজ আমল থেকে বালির সরবরাহকারী একমাত্র ঘোষাল পরিবার। গঙ্গার দীর্ঘ নদী- পথ লিজ নিয়ে এ অঞ্চলে বালি তোলার পারমিট এই ঘোষালরাই পেয়ে আসছেন। স্বাধীনতার পর অঞ্চলের শাসকের কাছের মানুষ হওয়ার সুবাদে, ঘোষালরাই একমাত্র সাদা বালি সরবরাহকারী; তাই, এই জল- প্রকল্প উদ্-বোধন
কালে, রাঘবেন্দ্রবাবুর উপস্থিতি কাঙ্খিত । মন্ত্রী- মহোদয়, তাঁর ভাষনে, রাঘবেন্দ্রবাবুর প্রশংসায় ভরিয়ে তুললেন। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের
সংগে রাঘববাবুর সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। শাসকের গা ঘেঁষে সবাই থাকতে চায়; তাই, উমেদারদের মধ্যে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি। রাঘবেন্দ্রবাবু, ঐ মিউনিসিপ্যালিটিতে বালি সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন; ফলে, পানীয়- জল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায়,চেয়ারম্যানের উপর, শহরের অধিবাসীদের ক্ষোভ আছড়ে পড়ে। চেয়ারম্যান ও তিনি একই রাজনৈতিক দলভূক্ত; শাসকের কাছে, চেয়ারম্যান হন ভৎর্সিত। পরে, মন্ত্রী-মহোদয়ের হস্তক্ষেপে, রাঘবেন্দ্রবাবু আবার বালি সাপ্লাই নিয়মিত করায়, জল- সরবরাহ ব্যবস্থার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয়েছে।

জনসাধারণের সামনে শাসকদলকে কাজ দেখাতে হবে, জন- দরদী সাজতে হবে; তাই, পুরোনো ব্যবস্থাকে, একটু ঝাড়-পোঁচ করে, নতুন বলে লোকের সামনে উপস্থাপিত করতে হয়; স্বাধীন- ভারতে, মন্ত্রীর কাজটা প্রধানত তো এটাই। মন্ত্রী- মহোদয়, তাঁর বক্তৃতায় রাঘবেন্দ্রবাবুর নাম বারবার উল্লেখ করায়, শাসক মহলে, রাঘবেন্দ্রবাবুর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চেয়ারম্যানও, মুখে নিজের বক্তৃতায় রাঘবেন্দ্রবাবুর
প্রশংসা করলেও সেটা যে তেতো
নিম- পাতা গেলার অবস্থায়, তা সংশ্লিষ্টদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

সভা চলাকালে, রাঘবেন্দ্রবাবু, মন্ত্রী- মহোদয়কে দিয়ে জেলার মুণ্ডেশ্বরী ও দ্বারকেশ্বর নদী থেকে বালি তোলার ইজারা পাবার সুপারিশটুকু করিয়ে নিয়েছেন। জেলা- শাসকের কাছে,তিনি রাঘবেন্দ্রবাবুর
নামটা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীন
ভারতের আমলারা সব বোঝে; মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের তারাও তোয়াজ করে। এখানেই, আই-সি এস ও আই- এ- এসদের মধ্যে পার্থক্য; ব্যক্তিত্বের ফারাকে, চারিত্রিক গুণাবলীর ঔদার্যে ও ঋজু শিরদাঁড়ার পরিপ্রেক্ষিতে, বৃটিশ আমলের আমলারা অনেকটাই যে
এগিয়ে,তা বলাই বাহুল্য। আজকাল তো কত রকমে সরকারী আমলা হওয়া যায়। মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যপম’ কেলেঙ্কারি, তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রাঘবেন্দ্রবাবু, সারাদিন
মন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে থেকেছেন।মন্ত্রী- মহোদয়, জেলা পরিত্যাগ করে চলে গেলে,তিনি ডি- এম’র সঙ্গে
কথা বলে, নমস্কার জানিয়ে, রাতে বাড়ি ফিরে এসেছেন।

পশুপতিবাবু, নিজের ঘরে, ভাই- পো, রাঘবের জন্য অপেক্ষা করছেন। রাঘব, বাড়ি ফিরেছে শুনে বিছানায় গেলেন। আজ তিনি খুবই খুশি, তৃপ্ত; শৈশবের স্মৃতি- চারণ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমের মধ্যেই হ’ল ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক; একটা গোঁ, গোঁ আওয়াজ শুনে, রাঘবেন্দ্রবাবু ও স্ত্রী রমনী, ছুটে আসবার আগেই
পশুপতিবাবু, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। হয়তো বা এতদিন, আত্মগ্লানির মর্মপীড়া, তাঁকে অহরহ কুরে কুরে খাচ্ছিল; অতীতের সব কথা বন্ধুর কাছে ব্যক্ত করে, হালকা হওয়ার আনন্দ- আবেগ- উচ্ছ্বাসে, স্বপ্নের তরী বেয়ে, ঘুমের মধ্যেই তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।