শহরতলির ইতিকথা
মিত্তিরদের পুকুরের ওপারে ‘জমিদার বাগানে’, সদ্য বাড়ি করে বসবাস করতে আসা, ওপার বাংলার অবলা মুখুজ্জেকে দিয়ে সিমেন্টের জন্য দরখাস্ত লিখিয়ে ধর্মদাস হাজরা মশাই, সরকারের কাছে সিমেন্টের জন্য দরবার করেছে। অবলা মুখুজ্জে,কোলকাতায় রেলের অফিসে কাজ করেন; এ পাড়ায় নতুন এসেছেন।ধর্মদাসবাবুকে, দাদা বলে সম্বোধন করেন; বাড়ি তৈরির অভিজ্ঞতাও রয়েছে, সরকারের ঘর থেকে সিমেন্ট পাওয়ার ঘাঁত-ঘোঁত সবই জানা। সিমেন্ট, না পেলে পাকা বাড়ি সম্ভব নয়, এখন তাঁর উপর ভরসা করে আছেন, না, তাঁর কাছে কথা বলে কোন সদর্থক উত্তর মেলেনি। তাহলে—–
দিন যায়, মাস যায়, সিমেন্টের দরখাস্তের কোন উত্তর নেই, অবলাবাবুও কোন সদুত্তর দিতে পারছেন না। এদিকে, রমা-বিরূপাক্ষের ক্রিয়া-কলাপ, সীমা অতিক্রম করে চলেছে, আগুণ আর ঘি পাশাপাশি থাকলে, যা হয় আর কী! মিত্তিরদের আত্মীয়রা, বুঝেও না বোঝার ভান করে আছে, নিভাননীর দিক থেকেও কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তিনি তাঁর সান্ধ্য ভ্রমন অব্যাহত রেখেছেন; ফলে, অঘটন, ঘটতে আর বিলম্ব হল না। কিছুদিন পর থেকেই, বিরূপাক্ষের আর দেখা মিলছে না; শোনা গেল, নিভাননীর মামাতো দাদা, তাকে, এ দেশ ছাড়া করে,ভাগলপুরে, ওদের আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ধর্মদাসবাবুও বাড়ি ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন।
রমার এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসার কথা, বসতে হবে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে, কিন্ত প্রস্তুতির কোন প্রচেষ্টা চোখে পড়েনি বা কানেও আসেনি, সেই হিঃ, হিঃ শব্দ, যৌবনের উচ্ছ্বাস, ঘরের ওদিক থেকে অধিক রাত পর্যন্ত ভেসে আসা অব্যাহত। হাজরা দম্পতি, নিজেদের সন্তানদের নিয়ে রয়েছে শঙ্কিত।
ধর্মদাসবাবু, রাজমিস্ত্রি ডেকে বাড়ি তৈরির ভিত খুঁড়তে আরম্ভ করালেন। মিত্তিরদের আত্মীয়রা যে ঈর্ষাজনিত কারণে অবসাদগ্রস্থ, তা অনুমান করাই যেতে পারে। রাজমিস্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে, ভিতে মাটির গাঁথনি ও উপর দিকে চূণ-সুরকি ও কয়লার গুড়ো দিয়েই শুরু হল বাড়ি তৈরি, ঘরের দেওয়ালের ভিতর দিকে সিমেন্টের প্লাস্টার হলেও, বার দিকে হল সিমেন্টের পয়েন্টিং; বাজার থেকে চড়া দরে সিমেন্টের যোগাড় করা হয়েছে। হাতে তো টাকা নেই, তাই, থেমে থেমে কাজ । ছেলেরা, পড়াশোনার ফাঁকে জোগাড়ের কাজ করেছে; বিকেল বেলায় স্কুল থেকে এসে নিয়ম করে, ছিল আধলা-ইট ভেঙ্গে খোয়া তৈরি করা; ওগুলো ‘লিন্ টন’ করতে, ঘরের মেঝে ও ছাদের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে; ছেলেরা, হাসিমুখে তাদের উপর দেওয়া দায়িত্ব পালন করে এসেছে।
কয়েকদিন পরেই জানা গেল, রমা অসুস্থ; মফঃস্বল শহরে তো ডাক্তারের অভাব, আবার ওদের লোকবলেরও অভাব, তাই নিভাননী দেবী মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি, কোলকাতায় চলে গেছেন; সেখানে নাসিংহোমে রমাকে ভর্তি করতে হয়েছে। এবারও যথারীতি পরীক্ষায় যে অকৃতকার্য হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মদাসবাবু ও তাঁর পরিবার, কারণ বুঝতে পারলেও প্রকাশ করতে পারছেন না; এটা তো বলার কথা বা ফলাও করে প্রকাশ করার কথা নয়। বাড়ির গার্জেনরা যদি ছোটদের না পথ দেখায়,তবে তারা বিপথগামী হলে, তার দায় তো গার্জেনদের উপরই বর্তায়। শোনা গেল, পরীক্ষায় একবার বসে, সে অনুপস্থিত থেকেছে,যাতে পরের বছরে বসার সুযোগ পেতে পারে। হাজরা দম্পতির এখন একমাত্র লক্ষ্য, কীভাবে,কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ছেড়ে, নিজেদের আস্থানায় উঠতে পারে।
রঞ্জন, এবার ক্লাস সেভেনে উঠলো,সজীব ক্লাস এইটে। হাজরামশাই, বিভিন্ন জায়গায় ঋণ করে বাড়ি সম্পূর্ণ করার পথে; আর বিসি ছাদে খরচা কম; ছাদের মাঝে দেওয়া হয়েছে, ভাড়া-বাড়ির পাশের ভাঙ্গা- বাড়ির কড়িকাঠ। কথকঠাকুর মশাই ‘র কাছ থেকে খুবই কম দামে ওদুটো কেনা হয়েছে; বার্মা -শালের কড়িকাঠ, লোহার চেয়ে ভালো,রাজমিস্ত্রীর অভিমত এটাই। দুটো ঘরের পশ্চিমে খোলা বারান্দা, মাথায় করোগেট টিনের ছাউনি,মাঝে রয়েছে উঠোন,আর তারপর রয়েছে খাটা পায়খানা ও পাশে উত্তর দিকে টিনে ছাওয়া ঘেরা বাথরুম। ব্যস,এবার ভাড়া বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে হল আসা।ভাড়ার টাকা হল সাশ্রয়; ঐ টাকা দিয়ে ইট-খোলার ঝণ মেটানো চললো; নিজেদের আস্থানার অনুভূতিই আলাদা;হাজরা পরিবার, এখন এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা, মিউনিসিপ্যালিটির বোনাফায়েড ভোটার; এতদিন, তারা বসবাস করলেও ভোটার হবার যোগ্যতা ছিল না। সে সময়, কেবলমাত্র ট্যাক্স পেয়াররাই মিউনিসিপ্যালিটির ভোটার হতে পারতেন।
চলবে