শহরতলির ইতিকথা
মিত্তির মশাই ‘র বাড়ির পশ্চিম অংশের একটা পাকা ঘর, লাগোয়া রয়েছে বাইরে ঐ দিকেই প্রশস্ত খোলা রোয়াক; আর তারই উপর রাস্তার দিকে মানুষ সমান উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আচ্ছাদন-বিহীন স্নান-ঘর; রোয়াক থেকে নীচে নেমে, রয়েছে টালিতে ছাওয়া,করোগেট টিনের দরজাওয়ালা রান্নাঘর ও পাশে থাকা টিনের-ছাদের পাকা ঘর: সব মিলিয়ে, এই অংশেই রয়েছেন পুত্র-কন্যাদের নিয়ে, ধর্মদাস হাজরা মশাই, মিত্তির মশাই ‘র বাড়ির ভাড়াটিয়া। ভাড়া নেওয়া রোয়াক সংলগ্ন ঘরটার উল্টো দিকের মাঝ দেওয়ালে থাকা দরজা, রমারা ওধার থেকে বন্ধ রাখে। রাস্তার ধারের ঐ ঘর দিয়েই বাইরে থেকে রমা-শান্তির পরিচিতরা আসা-যাওয়া করে,ওদিকেও আছে, রাস্তার দিকে উঁচু রোয়াক। সন্ধ্যে/রাতে বাইরে থেকে বাড়ির সংযোগের পথ বলা যেতে পারে; অবশ্য ভিতর বাড়ির পুবে উঠোনের পরই আছে দক্ষিন দিকে দেওয়ালের সংগে গাঁথা গজাল দেওয়া বিশাল সদর-দরজা, দিনের বেলায় সাধারণত ব্যবহার হয় । দিনের বেলা খিল দেওয়া থাকলেও, বার থেকে হাতল ঘুরিয়ে ভিতরে আসা যায়; রাতে অবশ্য হুড়কো দিয়ে ভিতর থেকে বন্ধ থাকে। এ সদর, সাধারনত দিনের বেলা, পাড়া-পড়শীরা/কাজের মেয়েরা ব্যবহার করে থাকে।
ঘরের মাঝের দরজা বন্ধ রাখলেও দেওয়ালেরও তো কান আছে, না, ওদের দিকের প্রায় সব কথাবার্তাই হাজরা পরিবারের কানে আসে; কী আর করা যাবে, ভাড়া বাড়ি তো! আর এখন মিত্তির মশাই ‘র পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসায়, তাড়াতাড়ি যথা সম্ভব, নিজেদের একটা আস্তানা করার ভাবনা ধর্মদাসবাবুর মনে এসেছে।
মিউনিসিপ্যালিটির প্রায় সতেরো ফুট চওড়া রাস্তা, অঞ্চলের মেইন রাস্তা থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনে অর্থাৎ দক্ষিন দিক দিয়ে চলে গেছে, সোজা অঞ্চলের রেল স্টশন পর্যন্ত; রান্নাঘরের পাশ দিয়েই হয়েছে এ অংশের সদর অর্থাৎ বাড়ির বাইরে ঐ রাস্তায় যাওয়ার পথ। রাস্তার ঠিক ওপারে ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়ে ভরা বেশ কিছুটা পোড়ো জায়গা, তারও দক্ষিণ রয়েছে, একটা পোড়ো বাড়ি। ভাড়া নেওয়া অংশের উঠোনে আমগাছ, তার তলায় রাখা হোত কয়লার চাঙড়, দাম এত কম ছিল, যে লোকে, উঠোনেই তা রাখতো; ওখানেই টুকরো করে, সাইজ করে রান্না ঘরে নিয়ে ছিল উনুন ধরানো। টালি/ টিনে- ছওয়া রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া, কুন্ডলী আকারে উঠে আশ-পাশের বাতাস কলুষিত করে আকাশ পানে ছুটতো; ধোঁয়ার রাশির প্রকটতা না কমলে রান্নাঘরে ঢোকা ছিল দায়; তাই অনেক সময় তোলা উনুনেরও প্রচলন ছিল। তোলা উনুন, উঠোনের আম গাছতলায় ধরিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ রাখা হোত; উনুনের আঁচ উঠবার কালে, আনা হোত রান্নাঘরে; প্রায় সব বাড়িতেই ছিল এই রকম প্রক্রিয়া।.
বাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা; উত্তরদিকে বাগানে যাবার জন্য রয়েছে নাছ-দরজা; ঐ বাগানেই আছে খাটা-পাইখানা। মিউনিসিপ্যালিটির মেথর-মুদ্দাফরাস ঐ পাঁচিলের পশ্চিম দিকে থাকা সরু গলি দিয়ে পাইখানার-ডাবার মল পরিষ্কার করে, ঐ পথেই যাওয়া-আসা। ঐ গলির ওধারে রয়েছে জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত পুজো-দালান, প্রায় ভগ্নদশায়; রোজই শোনা যায়, কড়ি-বরগা খসে পড়ার আওয়াজ; আর ঐ ভাঙ্গা বাড়ির সামনের একটা ঘরে রয়েছে প্রকাণ্ড শিবলিঙ্গ, কেউ রোজ পুজো না করলেও, শিবরাত্রির দিন পাড়ার লোকে, ঘরটা একটু পরিষ্কার করে ফুল, বেলপাতা চড়িয়ে পুণ্যার্জনে তৎপর হয়, অন্যসময় পাড়ার ছেলেরা ঐ ভাঙ্গা বাড়িতে চোর-পুলিশ খেলে থাকে; সাপ-খোপের ভয় তো সব সময়। মিত্তির মশাই’র বাগানের পর উত্তর দিকে রয়েছে শরিকি পুকুর; মিত্র মশাই ‘র রয়েছে আট আনা অংশ, ঐ পুকুরেই সবাই সরে থাকে। তখন, বাড়ি বাড়ি, মিউনিসিপ্যালিটির জলের সংযোগ ছিল না। মেইন রাস্তা ছাড়া, সবই ছিল কাঁচা রাস্তা; শীতকালে, মিউনিসিপ্যালিটির জলের ট্যাঙ্ক, রাস্তায় জল ছিটিয়ে, ধুলো মারতো।
হাজরামশাই’র পরিবার তো আগে থেকেই এই পুকুরের জল, সংসারের অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে আসছে; রমারাও এ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। রঞ্জন ও তার দাদা সজীব, পাড়ার ছেলেদের সংগে এই পুকুরে কলাগাছের ভেলা নিয়ে সাঁতার শিখছে; এবার তো গঙ্গায় গিয়ে সাঁতার কাটতে হবে; ক্লাসের ফাইন্যাল পরীক্ষা হয়ে গেলে, গঙ্গায় তখন অনেকক্ষণ কাটানো যাবে। ওদের বড়রা তো, গঙ্গার এপার-ওপার করে; গঙ্গার ধারে বাস, তো গঙ্গার জোয়ার-ভাটার সঙ্গে পরিচিতিটা থাকাই হবে স্বাভাবিক, গাঙ্গের বান কেমন,সেটা না জানলে তো, অন্য ছেলেরা টিটকারি দেবে।