সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৮)

শহরতলির ইতিকথা
হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
বেলা বারোটা থেকে পরীক্ষা শুরু। দশটার মধ্যে রাজীব নৈহাটি স্টেশনে পৌঁছে যায়;বঙ্কিমবাবুর ভাঙ্গাবাড়ির চাতালে বসে,সে মনোযোগের সঙ্গে পড়ে;এদিকে লোকজন একটা বড় আসে না।মিনিট কুড়ি আগে কলেজে গিয়ে,পরীক্ষার হলে পৌঁছে যায়; না, এখন আর পড়া নয়,শুধু গভীরভাবে অধীত বিষয়ের চিন্তা করা।বাংলা পরীক্ষায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ কাব্যের অংশ,’বীরবাহুর পতন’-এ, রাবন-চরিত্র বিশ্লেষণ করতে করতে কখন যে দু’ঘণ্টা কেটে গেছে, টেরই পায়নি। বারবার কাগজ নেওয়ায়,সরোজবাবু স্যার, এসে বললেন,”ওরে,ওটায় আছে তো মাত্র ত্রিশ নম্বর, অন্যগুলো লেখ,না লিখলে তো—“। সম্বিতে ফিরে,সে আরো কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর, সময়ের মধ্যে
লিখেছে ;আর যাই হোক, নম্বর যে ভালো উঠবে না,সেটা নিশ্চিত। এর পরের পরীক্ষাগুলো সে ভালো দিয়েছে।
সরোজ স্যার,বাংলায় মোটামুটি পাশ করিয়ে দিয়েছেন, বলে বোধ হয়। বাণিজ্যিক ভূগোল ,আর্টসের ছাত্রদের কাছে ঐচ্ছিক হলেও প্রায় সবাই নিয়েছে;আর কমার্সের ছেলেদের কাছে তো কম্পালসারি। ভূগোলের স্যার, আর্টস সেকসনে বলেছেন, ” রাজীব সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে”। ব্যস, এবার ওর খাতা নেবার জন্য,আর্টসের ছাত্রীদের মধ্যে পড়েছে হুড়োহুড়ি। রাজীবও রমিত,কলেজের সামনে থাকা স্টেশনারী দোকানে,লজেন্স কিনতে গেলে,দাঁড়িয়ে থাকা আর্টসের ছাত্রীরাও
রাজীবের কাছে লজেন্স চেয়ে বসলো;রাজীব,সবাইকে একটা করে লজেন্স দিয়ে মুক্তি পেয়েছে; লজিকের ক্লাসে,প্রিন্সিপাল মশাই’র সেই উক্তি, ‘উঁহু,ওদিকে নয়,দেখবে ওরা তোমার,খুড়-শাশুড়ি,মামী-শাশুড়ি হবে,কিছুদিন পড়ে;সে ছেলেটির তখন কী অবস্থা! ,সে কথাটা মনে করে রাজীব- রমিত একটু হাসে,একটু দূরত্ব রাখার চেষ্টা করে। একটা প্রগলভ ছাত্রী তো, ভূগোলের খাতাটাই চেয়ে নিল,অবশ্য দু’দিন পড়ে দিয়ে দেবে,এ শর্তে। রমিত-রাজীব,এটা নিয়ে কোনও গুরুত্ব না দিলেও,পরে বুঝতে পারলো একটা জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে
রাজীবকে। ওর ক্লাসের ছেলেরা,ঐ মেয়েটির নাম দিয়েছে, ‘রিনা ব্রাউন’; সে সময়, ‘সপ্তপদী’ সিনেমায়,অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন,রীণা ব্রাউনের ভূমিকায় সকলকে মাত করে দিয়েছে।
কলেজের সোস্যাল ফাংশন হচ্ছে, কলেজের পাশে, রেলের খোলা জায়গায়। উপস্থিত ছাত্র সংখ্যাই তো হাজার দশেক,বিশাল প্যাণ্ডেল,কোলকাতার নামকরা সংগীতশিল্পীরা গাইছে এ সোস্যাল ফাংশনে,না,শ্যামলবাবুকে এখানে গাওয়ার জন্য বলা হয়নি। একা নতুন গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী মশাই, সকলের মন জয় করে নিয়েছেন।অধ্যক্ষ মশাই তো বলেই ফেললেন, “নির্মল,এতো জোরে গলা ছ্যাইরা গাইছো,তোমার গলা ‘ছিঁড়রা যাইবো’,তোমারে দেইখ্যাই লোকে টাকা দিব”।
নির্মলবাবু বলছেন,”স্যার, না গাইলে,খাবো কী! সবই তো আপনাদের আশীর্বাদে।”
পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়িয়ে গেছে।রাজীব, মোটামোটি সব ছেলেমেয়ের
কাছে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। এবার, কলেজ ইউনিয়নের দাদারা রাজীবের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলছে।রাজীব, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বদ্ধপরিকর;রাজীব-রমিত,রাজনীতির বাইরে থাকা সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের মত,ছাত্র-ইউনিয়ন তো ছাত্রদের কথা বলবে,বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর কথায় চলবে কেন?যাই হোক,এস-এস-ও বলে একটা ছাত্রদের দলের নেতার বক্তব্য ও ব্যবহারে নরম হয়ে প্রথম বর্ষ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ায়,শর্ত এই যে, কোনোক্রমেই সে ক্লাস কামাই করে,ঐ রাজনীতি করবে না। ঐ কলেজের বিশেষত্ব, সেক্রেটারি ও সভাপতি নির্বাচিত হবে সকল ছাত্রদের মাধ্যমে,অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ভাবে,ফলে,নির্বাচনে উত্তেজনা ওঠে চরমে। কলেজ ছাত্র -সংসদের সংবিধান অনুসারে,সেক্রেটারি/ সভাপতি নির্বাচিত হবে,দ্বিতীয় বর্ষ বা চতুর্থ বর্ষ হতে;আর অ্যাসিসট্যান্ট-সেক্রেটারি/ভাইস -চেয়ারম্যান হবে তৃতীয় বর্ষ/প্রথম বর্ষ হতে। ফলে,রাজীব জিতে হয়ে গেল অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।না,তখন পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতিতে টাকা-পয়সা নয়-ছয় করার প্রবৃত্তি ছিল না,বরং ঐ রাজনীতির দাদারা ছাত্রদের, আর্থিক সাহায্য করতো,নিজের ভাতের থালা তুলে দিতো,ক্ষুধার্ত ছাত্রের মুখে। ছাত্রদের মধ্যে ছিল,ছাত্র -সুলভ মনোবৃত্তি,আর শিক্ষকদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা।কলেজ-প্রিন্সিপ্যাল মশাই, কলেজে রাউন্ড দিতেন,বিশেষ করে,কো-এডুকেশন কলেজে তো কঠোরভাবে তা পালন করা হোত।
আর্টসের ক্লাসে তো ছেলে- মেয়ে,একসঙ্গে পড়ে;অধ্যাপক মশাই ,ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলে,ছাত্রীদেরও ক্লাস থেকে বেড়োনোর কথা; অনেক সময়,ঐ একই ঘরে পরের ক্লাস থাকলে,সেটা সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। প্রিন্সিপাল মশাই তো এই জন্যই রাউন্ডে যান। একদিন কী হল,স্যার বেড়িয়ে গেছেন,পরের ক্লাসের অধ্যাপকও তখনও আসেননি,
রতন (নামটা পরিবর্তিত) বলে একজন তো ডায়াসে উঠে,ব্লাকবোর্ডে কবিত্ব ফলাতে গেছে; ব্যস,অধ্যক্ষ মশাই, ক্লাসে ঢুকেই, ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে গেলেন,নিজের ঘরে। খবরটা দাবানলের মত রটে গেছে,নাঃ!রতনের আজই শেষ
এ কলেজ।শোনা গেল,রতনকে উনি,আজই ট্রান্সফার নেবার কথা বলেছেন,নতুবা রাস্টিকেট করবেন;রাস্টিকেট হলে,ও আর পঃবাংলার কোনও কলেজে পড়তে পারবে না।রাজীব তো নেতা, না!ওরা চিন্তা করে,কীভাবে রতনকে এ বিপদে রক্ষা করা যায়;ওরা সবাই সরোজ স্যারের শরণাপন্ন হল,স্যারকে সব সত্যটা বলে,এবারকার মত বাঁচাবার অনুরোধ করলো।এবার, রাজীব-রমিত,অধ্যক্ষ মশাই’র ঘরে গিয়ে দেখে,স্যারের টেবিলে রয়েছে,প্লেটের উপর কাপে চা ,আর দুটো বিস্কুট;স্যার বিমর্ষ হয়ে চিন্তা মগ্ন।
“আসবো স্যার”, শুনেই তাকিয়ে বললেন,”না,না, কোনো কথা নয়,ওরে ট্রান্সফার নিতে কও,ডিস্লিপিন নষ্ট হতে দিমু না”।
“আইস যখন,নাও, বিস্কুট দুইটাই খাও”, বলে রাজীবদের দিকে তাকালেন;
রাজীবরা, স্যারের মন যে কত উদ্বিগ্ন, কত ছাত্র দরদী,বুঝেই বললো,”স্যার, ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা লিখেছিল,আর কখনো করবে না,এবারকার মত ওকে ক্ষমা করে দিন,স্যার;আপনি,সরোজবাবু স্যারকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন”।
সরোজবাবু স্যারও,ঠিক ঐ সময়,অধ্যক্ষ মশাই ‘র ঘরে ঢুকতেই অধ্যক্ষমশাই বললেন, “সরোজ,বলো তো,পোলাটা,কী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাই লিখছে,কও তো?
সরোজ স্যার ,রাজীবদের দিকে চেয়ে বললেন, ” ঠিক মনে করতে পারছিনা, রবি কবি,এরকম কবিতাও লিখে থাকতে পারেন”।
স্যারও মনে হোল,ক্ষমা করার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন।বলেছেন, “যাও ওরে কও,এরকম,ভুল আর যেন না করে”।মনে,মনে স্যারেদের প্রণাম জানিয়ে,রাজীব-রমিতরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। শিক্ষক, গুরু তো এরকমই হয়!
ডাঃ সর্বোপল্লী রাধাকৃষ্ঞাণ,উপরাষ্ট্রপতি,পঃবাংলায় এসে,প্রিয় ছাত্রের কলেজে,বঙ্কিমবাবুর মূর্তি উদ্বোধন করলেন;গুরু-শিষ্য,একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন, দুই বৃদ্ধের মিলনে,যেন মনে হয়,’স্বর্গ নামিছে এ ধরণীতলে, সুশোভিত করি চারিদিক,সুগন্ধ ছড়ায়ে স্বর্গীয় পুষ্প পারিজাত’।