সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ১৭)

সাদা মিহি বালি

তৃতীয় অধ্যায় – দ্বিতীয় পর্ব শেষাংশ

দশ দিনের নোটিশে, মাধব ঘোষাল, তার দলবল নিয়ে বাড়ি- জমির দখল নিয়েছে, সৌজন্যে সরকারি ও রাজনৈতিক দাদাদের আনুকূল্য। বিল্ডিং’র পুনর্গঠন করে স্কুলঘর তৈরি হয়েছে। একদিকে প্রাইমারি সেকসন ও অন্যদিকে জুনিয়র হাইস্কুল; মাঝে মাঠ; দু’পাশে, দিদিমনিদের কোয়ার্টার ও সরু ইট বাঁধানো পায়- চলা রাস্তা, সোজা বেঁকে গিয়ে মিশেছে স্কুলের সামনে, গেটের কাছে, বাস ঢোকা রাস্তায়– মিউনিসিপ্যালিটির মেইন রাস্তার পশ্চিমে। সেখানে, তৈরি হয়েছে বড় বড় পাঁচখানা ঘর, তিনটে গেটের বাঁ দিকে ও দুটো ডান দিকে। বাঁ দিকের ঘরগুলোয় রয়েছে স্টেট ব্যাংক, অন্যদিকের একটায় বীমা কোম্পানি, অন্যটায়
স্কুলেরই অফিস। স্কুলের মেইন গেট থেকে বাস- ঢোকা প্রশস্ত পাকা রাস্তা, সোজা চলে গেছে মাঠের মাঝ বরাবর।

দিদিমনিদের কোয়ার্টারগুলোর সামনে সরু ইট -পাতা পায়-চলা
পথের ধারে সুন্দর, সুন্দর ফুলের চারা বসানো হয়েছে; রয়েছে মরসুমী ফুলগাছও। এ সব দেখ- ভাল
করার জন্য রয়েছে মজুর; অবশ্যই উদ্বাস্তু কলোনীর মাঝ- বয়সী একজন। ঠিকাদারির ঠেলা ঠেলতে যারা অপারগ, তাদেরই এই
স্কুলে বহাল করা হয়। এ স্কুলে আধুনিক আদব- কায়দা শেখানো
হয়। তাই স্কুলের বেতন বেশি; এটা পুরোপুরি বেসরকারি। বাড়ি থেকে গাড়ি গিয়ে নিয়ে আসে ছোট ছোট শিশুদের, আবার পৌঁছে দেয়। সুরক্ষার বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই, তাই গার্জেনরাও এখানে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করেন; শিক্ষা একেবারে হদ্দমুদ্দ। কী হচ্ছে, কতটা শিশু শিখছে, না জানলেও চলবে, টা- টা, বাই-বাই বলছে কি না, আদব- কায়দা শিখছে কি না, সেটাই তো আসল! আবার রয়েছে সুরক্ষা, তবে! দে গরুর গা ধুইয়ে, পাঠাও সাজিয়ে- গুজিয়ে ছেলেকে, শুধু দেখ, বাংলাটা যেন না বলে, তাহলেই হ’ল। স্বাধীন দেশের, নতুন যুগের বাবা- মা’রা, ছেলে- মেয়েকে ব্রাউন সাহেব- মেম করতে বদ্ধ পরিকর। এখানে- ওখানে গজিয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল; জয় হো স্বাধীন ভারত! ইংরেজ তাড়িয়ে ব্রাউন সাহেব- মেম তৈরির তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে; স্বাধীন ভারত
এ বিষয়ে খুবই তৎপর।

দিদিমনিরা সব আবাসিক, চাকরির শর্ত এটাই, পরিবেশও সুন্দর। স্কুল পরিচালিত হচ্ছে একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে; আর এই ট্রাস্টের সম্পাদক হচ্ছেন মাধব ঘোষাল। সরকারি আধিকারিক- দের গাড়ি প্রায়ই স্কুলের মাঠে দেখা যায়; রাতেও ঐ গাড়ি থাকে কি না, পরিচর্যায় রত মজুরের জানা নেই। সে সন্ধ্যার আগেই গেটের বাইরে চলে যায়। গেটে থাকা বাহাদুর, গেট ভিতর থেকে
বন্ধ করে দেয়।

একদিন সকাল বেলা , ফুল গাছগুলো নিড়োবার সময় দিদিমনিদের কথা মজুরটির কানে এল—–
” আরে, ঐ টেকো বুড়োটা; কাল খুব জ্বালাইছে; বুড়োটার কী দম রে! ওর বুড়িটা তো মইরাই যাইবো! এত দম এই বয়সে!”

” শালা, খুবই ভালো- মন্দ জিনিস খায়, ঘুষের টাকার তো কোন মা- বাপ নাই। ”
“ঠিক কইছ,ঐ বুড়োটাই তো মাধবদা’র সব কাজ- কর্ম কইরা দেয়। “

কথাগুলো শোনার পর থেকেই মজুরটির মাথা রাগে গমগম করছে। এর জন্যই কি ‘বিনয়- বাদল- দিনেশ’ আত্মত্যাগ করেছে,
চরিত্রহীনের দল দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! শিক্ষার আড়ালে, এতো—ব্যবসা! দেশের যুবসমাজ, আর কি মেরুদণ্ড খাড়া রেখে দাঁড়াতে পারবে? বয়স্ক মজুরটি, আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বাধীনতার অভিশাপের কথা চিন্তা করতে করতে আনমনা হয়ে যায়।
ছাত্র- ছাত্রীদের নিয়ে স্কুলে- বাস মাঠে ঢুকতেই সে সম্বিতে আসে ।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।