সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক (পর্ব – ৩)

সাদা মিহি বালি

প্রথম অধ্যায়
(
প্রথম পর্ব)

সেজ- জন, রমেন্দ্র ঘোষালকে আসানসোল অঞ্চলের কয়লা- খাদানের কাজ- কর্ম দেখাশোনার
ভার দিয়েছিলেন। এই আধা- শহর থেকে দূরের ব্যবসা ঠিক মতো চালানো সম্ভব না হওয়ার জন্য, রাঘবেন্দ্রবাবু, ভাইকে ঐ খনি অঞ্চলে,কোম্পানির গেস্ট- হাউসে থাকবার নির্দেশ দেন। ঠাকুরদা
হরিকৃষ্ঞ ঘোষাল, ইংরেজ আমলে এক সাহেবের কাছ থেকে তার পঞ্চাশ শতাংশ, অংশীদারী কারবারের অংশ কেনেন; এত- দিন, ব্যবসা ভালো চলছিলো না। মালিকেরা শহরে আয়াস করলে, খাদান অঞ্চলে থাকা, ম্যানেজার, খনি- ইন্জিনিয়ার প্রভৃতি কর্মচারী- রা তো কোম্পানিকে, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ অবস্থায় যে আনবে, তা বলাই বাহুল্য। বাবা, কাকা, নিজেদের পৈতৃক ব্যবসা, নদীর বুক থেকে সাদা বালি তোলার লিজ নিয়েই হিমসিম খেয়েছেন। নদীর প্রায় কুড়ি / একুশ মাইল–শ্রী রামপুর থেকে ত্রিবেণী পর্যন্ত নদী – পথ –তাঁদের ইজারা নেওয়া। এই বিশাল এলাকায়,তাঁরাই কেবলমাত্র নদী থেকে বালি তোলার অধিকারী; আর এই সাদা বালি, নদীর জল পরিশ্রুত করে পানীয় জল হিসেবে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। নদী- পাড়ের মিউনিসিপ্যালিটিগুলোই তাঁদের বড় খদ্দের; এ ছাড়াও বিভিন্ন ইট- খোলা, বালির জন্য তাঁদের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। খোলার মালিকরা, অনেক সময় বিভিন্ন নৌকোর সাহায্যে ভাটার সময় নদী থেকে বালি চুরি করে, তাই রাঘবেন্দ্রবাবুর কাকা, পশুপতি ঘোষাল, স্পীডবোট নিয়ে রাতে নদী পাহারা দিতেন। অনেক সময়, ভাইপো রাঘবেন্দ্রকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বয়সকালে,পশুপতিবাবু, ভীষণ ডাকাবুকো ছিলেন; রাঘবেন্দ্রের চেয়ে মাত্র দশ বছরের বড়; কালো কুচকুচে পাথরে খোদাই করা চেহারা, একেবারে ভয়- ভীতিহীন। দাদা, বটকৃষ্ণ ঘোষাল ছিলেন ভাই অন্তপ্রাণ । রাঘবেন্দ্র বাবু, পৈতৃক ব্যবসাকে আধুনিকীকরণ করেছেন; এখন যান্ত্রিক উপায়ে নদীর বুক থেকে বালি ও কাদা জল আলাদা করে সাদা বালি
নদীর পাড়ে এসে জমা হয়; সাদা মিহি বালি, শুকিয়ে গেলে সূর্যের আলোয় তার চাকচিক্যে, চোখ মেলে দেখা ভার। ভাইদের
অন্যান্য ব্যবসায়ে বসিয়েছেন; ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’, এ কথাটা সব সময় ভাইদের মনে পাড়িয়ে দেন; ‘উদ্যোগীনম্ পুরুষসিংহম্
ভূপৈতি লক্ষ্মী’,এ কথাটা ভাইদের
সব সময় মনে করান। ব্যবসায়ের
মূলমন্ত্র যদিও প্রফিট, তবে তা অন্যায় পথে নয়; যতটা সম্ভব পথটা যেন মসৃন হয়, সোজা হয়; বাঁকা পথ, কিন্তু অচিরেই রুদ্ধ হয়ে যায়; তখন আবার অন্য পথ, সেটা- ও যে বাঁকা হবে তা বিলক্ষণ। এই ভাবে চলতে চলতে, চলা- পথ বন্ধ হয়ে যায়; স্থবিরত্বে এর পরিসমাপ্তি। নদী থেকে সাদা বালি তোলা ছাড়াও, তিনি জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, হলুদ- সোনার বরণ মোটা বালি তোলার খাদান- ক্রিয়া- কলাপে যুক্ত হয়েছেন। পাণ্ডুয়া, মগরা অঞ্চলের মোটা বালির চাহিদা আকাশছোঁয়া। দেশে আবাসন শিল্প গড়ে উঠছে;এ ধরনের বালি সোনার দামে বিক্রি হচ্ছে; আবার যেহেতু এ ব্যাপারে অনেক সরকারী বিধিনিষেধ আছে, তাই এটা তিনি নিজেই দেখা শোনা করেন। দেশে
উন্নয়ন কর্ম- যজ্ঞ শুরু হয়েছে; তিনি ও তাঁর ভাইরা ‘ আগে বাড়
রাহা হ্যায়’।

অঞ্চলের বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যমণি তিনি। অঞ্চলের এম- এল- এ, বর্তমানে মন্ত্রী হয়েছে; সুতরাং, রাঘবেন্দ্রবাবুরও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলার বিভিন্ন নদীর পারাপারের ঘাটগুলো তিনি টেন্ডার ডেকে ইজারা নিয়েছেন। স্থানীয় ক্লাবগুলোর বেকার ছেলেদের, ঐ সব পারাপারের ঘাটে নিযুক্ত করেছেন। ছেলেদের কাছে তিনি একজন ‘বিশেষ দাদা’। আবার, তাঁরও দাদা হচ্ছেন দেশের মন্ত্রী, অর্থাৎ অঞ্চলের এম- এল- এ। অঞ্চলের ছেলেরা, স্বাধীন দেশের যুব- সম্প্রদায়; তো নিজের, নিজের আখের গোছাতে তৎপর। রাঘববাবু, সব বোঝেন; তাঁর বক্তব্য, “যদি ওরা জীবনে দাঁড়াতে পারে, তো সেটাই বা কম কীসের!
স্বাধীন দেশের মন্ত্রী, আমলা, ‘হামলা’, পুলিশ যদি গুছিয়ে নেয়, তবে ওদেরও হক আছে গোছানোর;তবে, আমার গাছটুকু বাঁচিয়ে আম খাক, ফল তো! সবাই, খাবার হকদার। পূর্ব- পুরুষদের কৃত- কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পাচ্ছি, এই তো ঢের।” ক্লাবের জগদ্ধাত্রী পুজোর চাঁদা দিতে তিনি বড্ড টালবাহানা করেন; পুজো- টুজোর ব্যাপারে তাঁর খুবই অনীহা। এভাবে ছেলেরা ফূর্তি করে সময় নষ্ট করবে, তা তিনি মানতে পারেন না। ছেলেদের অনেক বোঝান, কিন্তু, স্বাধীন দেশের ছেলে, কাজ করে খেতে খুব কষ্ট; তিনি সবাইকে আপ্রাণ বোঝান, তাই প্রায় কেউই আর তাঁর কাছে চাঁদার জন্য যেতে চায় না। তিনি শুধু অপেক্ষায় থাকেন, কখন ওরা, স্ব- নির্ভর, দায়িত্বশীল হবে, কখন যুবসমাজ আবার কর্মবীর হবে;দেশের সরকার সব করে দেবে, এ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তবেই কবির ইচ্ছা– দেশ আবার ‘শ্রেষ্ঠ আসন লবে’, পূরণ হবে; সে তো আর ফলবৎ হবার বিন্দু- বিসর্গও দেখতে পাচ্ছেন না। স্বাধীনতা, এখন সমাজের বোঝা বোধ হচ্ছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।