শহরতলির ইতিকথা
নৈহাটি শহরের গুরুত্ব রাজীবের কাছে,অন্যরকম;এ শহরে ‘গঙ্গা’র সমরেশ বসুর বাস,এ শহরে থাকেন গানের গাং, শ্যামল মিত্রি মশাই;আহা,এ যেন রাজীবের কাছে স্বপ্নপুরী, তারকাখচিত স্বপ্ননগরী। নৈহাটি সিনেমার পাশের রেস্টুরেন্টে, চা খেতে খেতে ভাবে,হয়তো,এই চেয়ারটাতেই বসে বসু মশাইও চা খেয়েছেন;এখান থেকেই হয়তো ‘বে-কাফে’ লেখার প্রেরণা পেয়েছেন। এবার পুজোয় তাঁর লেখা ‘রাণীর বাজার ‘,সবার মন কেড়েছে;এ মাটির একটা বিশেষ গুণ আছে,না হলে
এতো গুণী মানুষ এখানে জন্ম নেয়! রমিতও এ অঞ্চলের ছেলে নয়।স্কুল জীবন কেটেছে আসানসোলে। বাবা ট্রান্সফার হয়ে নৈহাটি স্টেশনে এসেছেন। রমিতের কাছেও নৈহাটির একটা আলাদা আকর্ষন আছে;কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমবাবুর বাড়ি,
বঙ্কিমবাবুর নামে মিউজিয়াম,সব তো দর্শনীয়, না!
সব বাঙালির কাছেই এটা তীর্থস্থান।
ক্লাস অফ থাকলে রমিত ও রাজীব বঙ্কিমবাবুর ভাঙ্গাবাড়িতে যায়,চাতালটায় বসে,একটা না-বলা অনুভূতির স্বাদ পায়;এদিকটায়, বসতি এখনও সেরকম ঘন হয়নি।
দুর্গা পুজোর পর রাজীব,কলেজে এসেছে;অফিস খুলেছে,কলেজ খুলবে কালীপুজোর পর;নৈহাটির কালী মূর্তি
বিশেষ করে,অরবিন্দ রোডের কালীপুজোর প্রতিমার আকার বিস্ময়কর,পেল্লায় উঁচু,শুরু হয়ে গেছে কালী-প্রতিমা গড়ার প্রস্ততি।লঞ্চঘাট থেকে স্টেশন পর্যন্ত রাস্তায়,বেশ কয়েকটা মূর্তি চোখে পড়ে,তবে সাজানো-গোছানো নয়; থাকবে তা প্রায় একমাস;রাস্তা দিয়ে এসময় চলা খুবই কসরতের ব্যাপার; হকাররা,তাদের পশরা বিছিয়ে বসে থাকে,খদ্দেরের অপেক্ষায়।
অফিসের কাজ মিটিয়ে,রমিত ও রাজীব কলেজের সামনে মাঠে বসে গুলতানি করছে,ওর ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরী আছে। হঠাৎই চোখ পড়ে রাস্তার দিকে; রাস্তা দিয়ে কাপড়ের কোঁচা দোলাতে,দোলাতে এক ভদ্রলোক বঙ্কিমবাবুর বাড়ির দিকে যাচ্ছেন,মাথার চুলে ঢেউ খেলানো,থাক,থাক ;ঐ সময়, ঐটাকে চুলে, আলবার্ট কাটা বলতো,বখাটে টাইপের ছেলেরা, ঐরকম চুলে ঢেউ তুলতো।ওদিকে তাকিয়ে রাজীব বলে,”দেখ,দেখ,বয়স হয়েছে,তবু চুলের বাহার দেখ”; রমিতও দেখে বলে,”ছিঃ!”
পুজোর ছুটির পর ওদের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা হবে;সে সব কিছু কথাবার্তার পর, স্টেশন থেকে ইএমউ কোচ ধরে,রাজীব ব্যাণ্ডেল স্টেশনে এলো।চার নম্বর প্লাটফর্ম থেকে সাব-ওয়ে দিয়ে এসে,একনম্বর থেকে গয়া-প্যাসেঞ্জার ধরে নিজের স্টেশনে নেমে, বাড়ি। সন্ধ্যায় আছে ট্যুইশান পড়ানো,তারপর রাতে ফিরে এসে নিজের পড়া;খুব ক্লান্তি লাগে;মনকে বোঝায়,আর ক’টা বছর তো,তারপর চাকরি,কী আরাম!ভবিষ্যতের স্বপ্ন তাকে প্রেরণা যোগায়।
পুজোর পর কলেজ খুলেছে। রমিত ও রাজীব, কলেজ থেকে নৈহাটির কাঁঠালতলায় বাংলার অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি এসেছে, স্যারকে বিজয়া দশমীর প্রণাম করতে।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখে,সেই চুলে ‘আলবার্ট’ কাটা লোকটা বসে আছে,স্যারের বাবাও স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে;এখানে লোকটাকে দেখে ওদের দু’জনেরই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।স্যারকে প্রণাম করতেই, উনি ইশারা করে ঐ লোকটিকে প্রণাম করতে বললেন।অনিচ্ছা থাকলেও স্যারের মর্যাদা রাখতে ,ওরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সারতে,লোকটি বলে উঠলো, ‘এবারের উপন্যাস ‘রাণীর বাজার ‘ কেমন লাগলো?ওনার কথায় তারা,স্যারের দিকে তাকায়;স্যার বলেন,উনিই ‘রাণীর বাজার’-উপন্যাসের লেখক। শুনে তো রাজীব- রমিত একেবারে ‘থ’,বিস্ময়াভূত।স্যারের বন্ধু,কিন্ত রয়েছে না- বলা রেষারেষি, ছোট-বেলাকার আড়ি,আড়ি ভাব, তাই উনি বন্ধুর বাবা বা স্ত্রীর কাছে এসেছেন,না, সরোজের সঙ্গে কথা বলা হবে না,এমনিই ছেলেমানুষী ভাব ওদের মধ্যে। রাজীব-রমিত,তাঁদের মধ্যে বসে থেকে ,একটা অনাস্বাদিত
শিশুসুলভ স্বর্গীয় মনোবৃত্তির আভাসে
মানসিকভাবে পরিতৃপ্ত হল।ওদের প্রিয় লেখক,ওদের সামনেই বসে, ভাববাচ্যে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে,এ এক অপূর্ব অনুভূতি।সবাই কে প্রণাম সেরে,তারা জীবনের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বাড়ি ফিরছে। ‘রাণীর বাজার ‘ উপন্যাসের শেষে,চিলে কোঠার ছাদে,ভারতমাতা এসে লেখককে বলছেন,” মহাত্মা গান্ধী যদি জাতির জনক,সুরেন বাড়ুজ্জ্যে আমার কে রে?;তোরা মায়ের নামেও কলঙ্ক দিteতে ছাড়লিনে?”
সমরেশবাবুর ‘গঙ্গা ‘ তো হালশহরের জেলে পাড়ার জীবন-চর্চার ছবি;আবার সিনেমাও হল, ঐ অঞ্চলের হুগলী নদীর দু’পাড়কে কেন্দ্র করে; বিশেষ করে,জালের খুঁটি উপড়ে
ফেলার সময়, হাতাহাতির দৃশ্যগুলো তো খামারপাড়া-সাহাগঞ্জের কাছে নদীর উপর, ভাটার সময় জেগে উঠা অস্থায়ী চড়াতেই তোলা হয়েছে;রাজীবরা তখন ক্লাশ নাইনের ছাত্র; সবাই দল বেঁধে গঙ্গার ধারে সে সব শুটিং ‘র দৃশ্য দেখেছে;’ডুবাইলি রে আমায়, ভাসাইলি রে আমায়—‘ ভাটিয়ালি সুর,এখনো রাজীবের কানে ভাসে;রাজীব, এক বিশেষ অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
(চলবে)