ক্যাফে গল্পে উমা ব্যানার্জী

মনোহরা

সুনামাদেবীর সংসারে তার কথাই শেষ কথা। ন বছর বয়সে এক বিরাট পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল এক উঠতি ঘরের ইন্জীনীয়ার ছেলের সঙ্গে। পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত স্কুল শিক্ষা। কিন্তু লেখা পড়ায় কৌতূহল থাকায় পরবর্তী কালে রামায়ন মহাভারত শেষ করেছেন বেশ মনোযোগ সহকারে। তের থেকে তেত্রিশ বছরে এগারোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। যদিও ‘পতি পরম গুরু’মতে তিনি বিশ্বাসী নন। অন্তত তার প্রত্যেক স্বভাবে তার প্রকাশ ঘটে। বাবার বাড়িতে ভাইয়েরা কেউ ডাক্তার,প্রফেশর, আইনজীবী। বড়দিদি মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই তার স্হান পিতৃগৃহে। এহেন সুনামাদেবীকে নিজের সংসারে ঐ সন্তান উৎপাদন ছাড়া বিশেষ কোন কাজ করতে হয় না। অনেক সহায়িকা আছেন ওনার জন্য। ওনার কনিষ্ঠ ছেলেটির জন্ম বড়মেয়ের ছেলের দুই মাস পর।ছয় ছেলে পাঁচ মেয়ে। বাড়িতে জলখাবারে দেরী হলে সোজা পাড়ায় কচুরীর দোকানের বেঞ্চে বসে খেয়ে চেনা পরিচিত কেউ খেতে চাইলে তাকে খাইয়ে বাড়ি ফিরে রাঁধুনী র পিন্ডি চটকান। পাড়ার লীডার।স্বামী থাকতেই দুছেলে ও চার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তবে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছে দাদারা।বড় বৌ আসাতে রাঁধুনি বিশেষ বিশেষ দিনে শুধু। বৌ যদি অপ্রাসঙ্গিক কথার উত্তর না দেয়, উনি নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বলেন ‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি,আজ তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি।’বড় বৌ চুপচাপ। শান্ত প্রকৃতির। তাই তার উদ্দেশ্যে “মুখে নেই রা,পর্বতে মারে ঘা”।আর‌ও
বলেন”শশা বেচুনি বেচতো শশা তার হয়েছে সুখের দশা”। বড় বৌ ছিল গরীবের কন্যা। মেজো বৌ একটু মুখরা। উত্তর দিলে বলতেন “কত হাতি গেল তল,মশা বলে কত জল “।রাঙাবৌ সুন্দরী। বেচারা সন্তানপ্রসব কালে মারা যায়। সুনামাদেবী বলেন “অতি বড় সুন্দরী না পায় বর,অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর “। মেজো মেয়ে আর ন মেয়ে বাপের বাড়ি এসে মার সমালোচনা করলে শুনতে হয় “চালুনি ছুঁচের বিচার করে,চালুনির পেছন ঝরঝর করে ” ছোট ছেলে একটু মা ন্যাওটা। হঠাৎ নিজের প্রয়োজনে একটু দূরে কোথাও পাঠাতে চাইলে ছেলে বেঁকে বসে। মা বলেন “মুখপোড়া–এ যেন ঘোড়ার আড়াই পা! ”
নিজের শর্তে বাঁচতেন। কুরুশে অপূর্ব ডিসাইন তুলে বেডকভার,জামা,শায়া,ড্রেসিং টেবিলের ঢাকা অর্ডার নিয়ে বিক্রি করতেন। ছেলেদের পয়সার ধার ধারতেন না।স্বামীর অবর্তমানে ছেলে বৌ নাতি নাতনী র উদ্দেশ্যে তার উক্তি “যার ধন তার ধন নয়,নেপোয় মারে দ‌ই “। মানুষের শরীর। কোনদিন কেউ ওষুধ বা খাবার নিয়ে ঘরে গেলে তাকে শুনতে হোত “পড়েছি যবনের হাতে ,খানা খেতে হবে একসাথে”।
সুনামাদেবী চলেছেন একাই ভাইদের ফোঁটা দিতে। পাড়ার হালদার গিন্নী করে দিয়েছে বড় বড় পিয়াড়ার সাইজে সাদা সাদা মনোহরা। সঙ্গে নিয়েছেন দু ব্যাগ ভর্তি ফল, মিষ্টি। একাই চলেছেন টিকিট কেটে যত্ন করে ট্রেনে উঠে হাওড়া স্টেশনে নেমে আর টিকিট খুঁজে পাননি। বেশী চেষ্টা ও করলেন না। মনোহরা,সন্দেশ,দ‌ই ছড়কুটে যাবে!! উনি দূর থেকেই দুজন চেকারকে ডাকলেন হাতের বোঁচকা রেখে। বয়স্ক মানুষ। আর সময়টা কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। হাওড়া স্টেশনে তখন সবাই এতো ছুটতো না। তো চেকার দুটো কাছে এলে তাদের বললেন সুনামাদেবী “আমার টিকিট হারিয়ে গেছে। একপাশে দাঁড়াচ্ছি। তোমাদের কাজ হলে একটু আমার কাছে এসো।” চেকার দুজন গেল ..ঠাকুমা আবার চোখ টিপছে…ঠাকুমার ব্যাগ থেকে বের হোলো একটা করে মর্তমান কলা, একটা করে জলভরা সন্দেশ আর একটা করে মনোহরা।
“নাও। খেয়ে নাও। এর দাম তোমার ঐ টিকিটের থেকে বেশী “। চেকার দুজন বিষম খেয়েছিলো কিনা সে খবর নেই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।