ঠুংরীর মূলতঃ তিনটি বিখ্যাত ঘরানা। বেনারস, লক্ষ্ণৌ এবং পাতিয়ালা। শেষটি অবশ্য খেয়াল ঘরানা, সঙ্গে পাঞ্জাবী টপ্পার ঢঙয়ে ঠুংরী গাওয়া হতো, যে ঠুংরী, তাঁর খেয়ালের মতোই বিখ্যাত করে গেছেন স্বয়ং বড়ে গুলাম আলি খান। তাঁর কথা আগেই বলেছি। তাই বেনারস ও লক্ষ্ণৌ ঘরানার কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পীর কথাই বলবো।
ইতিমধ্যেই গৌহরজানের কথা বলেছি। তিনি ছিলেন লক্ষ্ণৌ ঘরানার শিল্পী। এবার বেনারস ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী সিদ্ধেশ্বরী দেবীর কথা। তাঁকে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ডাকতেন “মা” বলে। এই নামের বইতে তাঁর জীবনকাহিনী বিধৃত আছে।
১৯০৩ সালের কাশী। বিখ্যাত গায়িকা ময়না দেবীর হাভেলী। এই হাভেলী থেকে সততই ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গীতের সুরমূর্ছনা। কখনো সারেঙ্গীর আওয়াজ, কখনো নূপুরের বোল, কখনো বা তানপুরার গম্ভীর ষড়জের সঙ্গে প্রভাতী রিওয়াজের সুর। হবেই তো! বাড়ির সব বাসিন্দারাই তো সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন। সন্ধ্যা হলে বসে মহফিল, তাতে আসেন শহরের সব রইস আদমী, রাজা জমিদারেরা। গান শুনে বাহবা ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ! পড়ে নজরানা। কিন্তু সেদিন হাভেলী নিশ্চুপ। কারণ ময়না দেবীর কন্যা আসন্নপ্রসবা কিন্তু অত্যন্ত অসুস্থ! বাঁচবেন কি না সন্দেহ! বদ্যি দেখে ওষুধপত্র দিয়ে গেছেন। দাই চিন্তিত মুখে বসে! অবশেষে অত্যন্ত দুর্বল দেহেও কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়ে একেবারে নেতিয়ে পড়লেন নয়না দেবীর কন্যা। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি সুরেলা আওয়াজে কাঁদতে লাগলো। মেয়ের কান্নায় মা প্রায় অজ্ঞান অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ডাকলেন ছোট বোন রাজেশ্বরী দেবীকে। তাঁর হাত দুটি ধরে বললেন “ম্যায় ঔর জ্যাদা জিউঙ্গী নহী। মেরে জানে কে বাদ মেরি বেটি কো তেরে হাথ সঁপ রহি হু! উনকো সঙ্গীত কি শিক্ষা দেনে কি জিম্মেদারী তেরী!” তারপর থেকে ছোট্ট মেয়েটিকে মানুষ করার ভার পড়লো রাজেশ্বরী দেবীর ওপর। মেয়েটির নাম হলো সিদ্ধেশ্বরী! সারাদিন গানের পরিবেশে ঘুরে বেড়ায় সিদ্ধেশ্বরী। কন্ঠে তাঁর সর্বদা সুর, যা প্রকাশ চায়। তারও ইচ্ছে হয় মৌসিজীর মতো গান গায়। মৌসিজীর মেয়ে কমলি, মানে কমলেশ্বরীর জন্য সঙ্গীত শিক্ষক নিযুক্ত হলো। সিয়াজী মহারাজ শেখাতে আসতেন। আড়াল থেকে চুপ করে শুনতো সিদ্ধেশ্বরী। একবারে গলায় উঠে আসতো সুর। বাড়িতে গ্রামোফোন ছিলো না। সুরের সন্ধানে সিদ্ধেশ্বরীর কান চলে যেতো আসপাশের বাড়িতে, যেখানে চোঙ্গা লাগানো গ্রামোফোনে বাজছে গৌহরজানের গান, জানকীবাঈয়ের গান! শুনে অস্থির হয়ে উঠতো মেয়েটি! কবে এমন ঠুংরী গাইতে পারবে সে? এরকম সময় একদিন, কমলি গান শিখছে আর সিদ্ধেশ্বরী লুকিয়ে শুনছেন। গুরুজী একটি টপ্পার সুর তোলানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু কমলেশ্বরী কিছুতেই সেটা তুলতে পারছে না। গুরুজীর ধৈর্য চলে গেলো! কমলেশ্বরীর পিঠে পড়তে লাগলো চড় থাপ্পড়! দৌড়ে গেলো সিদ্ধেশ্বরী। নিজের পিঠ দিয়ে আড়াল করে বাঁচালো বোন কমলিকে! নিজে মার খেলো। তারপর গুরুর রাগ শান্ত হলে বোনকে বললো “দেখ, এটা খুব সহজ!” বলে অতি সহজে একেবারে সঠিকভাবে গেয়ে শুনিয়ে দিলো সেই টপ্পার সুর! চমকিত হলেন গুরুজী! নিজে থেকে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য রাজেশ্বরী দেবীর কাছে চেয়ে নিলেন মেয়েটিকে। শুরু হলো সিদ্ধেশ্বরীর প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা।
সেই সময় ঠুংরীর ঢং পরিবর্তিত হচ্ছিলো। আগে ঠুংরীতে ভাবপ্রকাশ করা হতো অভিনয়ের মধ্য দিয়ে! চোখের কায়দায়, হাত পায়ের ভঙ্গীতে। প্রিয় মিলন ও বিরহ, রূপমুগ্ধতা এবং শরীরি মিলনের আবেদন ছিলো এর বিষয়বস্তু। রাজা জমিদার সুলতান বাদশাহকে খুশী করা ছিলো এর উদ্দেশ্য। ক্রমে যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঠুংরী যখন তবায়েফদের কোঠা বা হাভেলী থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সভা সম্মেলনে গাওয়া হতে লাগলো তখন এই ঢং-এর পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়লো। তাই বোল-বনাও ঠুংরী গাওয়া শুরু হলো, যা মূলতঃ বেনারস ঘরানাতেই উৎপত্তি হয়। এতে গানের ভাব প্রকাশ করা হতো শুধু গলা দিয়ে, সুরের বৈচিত্রে, মীড় ও পুকার দিয়ে। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর ঠুংরী ছিলো এই পূরব অঙ্গের। কখনো বা তান ব্যবহার করে খেয়াল অঙ্গে গাওয়া হতে লাগলো ঠুংরী। গানের কথাও পরিবর্তিত হয়ে রাধা কৃষ্ণ ও নানা ঠাকুর দেবতার কথা এসে পড়লো ঠুংরীতে। নানা উপলক্ষ্যে গাওয়া হতো বিভিন্ন রকম ঠুংরী – যেমন বর্ষাকালে কাজরী যাতে কৃষ্ণের বিরহে রাধার কথা বলা হতো, ঝুলনের সময় রাধাকৃষ্ণের লীলা নিয়ে ঝুলা গীত হতো। এছাড়া লোকগানের আবহে গ্রামের মানুষের জীবন নিয়ে চৈত্র মাসে গাওয়া হতো চৈতী। ঠুংরী দাদরা তালে একটু দ্রুত ছন্দে গাওয়া হলে তাকে বলা হতো দাদরা। গানগুলি খেয়ালের পাশাপাশি নানা কনফারেন্সে অত্যন্ত জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
সিয়াজী মহারাজ সিদ্ধেশ্বরীকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে এইসব গান শেখাতেন তাঁকে। পাশাপাশি রাগসঙ্গীতে খেয়াল টপ্পা তারানায় ওস্তাদ হয়ে উঠছিলো সে। এই সময় হঠাত বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় সিদ্ধেশ্বরী। সম্ভবতঃ বাড়ির অনাদর তাঁর সহ্য হচ্ছিলো না এবং সেই সময় তিনি কারো প্রেমে পড়েন। এ কথা পরে সাক্ষাতকারে নিজেই বলেছেন তিনি। পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করেন এবং তাঁর কন্যা হয়। কিন্তু তাঁর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। ফিরে আসেন সিদ্ধেশ্বরী। ততদিনে সিয়াজী মহারাজ মারা গেছেন। এরপর সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মূল গুরু হন বেনারস ঘরানার বিখ্যাত পন্ডিত বড়ে রামদাসজী। তাঁর কাছে গুরু শিষ্য পরম্পরায় শিখতে লাগলেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী।
মাত্র আঠেরো বছর বয়সে কলকাতায় একটি সঙ্গীত সম্মেলনে সিদ্ধেশ্বরী দেবী প্রথম প্রকাশ্যে গান গাওয়া শুরু করেন। সেখানে ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর মতো বড়ো বড়ো শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন। একেবারে নতুন এই মেয়েটির গলায় মল্লার ও সুহা-সুঘরাই এবং তারপর তাঁর ঠুংরী শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন এই বড়ো বড়ো শিল্পীরা! পন্ডিত ওঙ্কারনাথজীর কাছ থেকে অনেকগুলি মেডেল পেলেন সিদ্ধেশ্বরী। তাঁর এরপরের বড়ো অনুষ্ঠান ছিলো মুম্বাইয়ের অল ইন্ডিয়া মিউসিক কনফারেন্সে। সেখানেও বড়ে গুলাম আলি খান এবং ফৈয়াজ খানের গাওয়ার কথা। সেদিন তাঁর অনুষ্ঠানের শেষে এমন দরদ দিয়ে একটি ভৈরবী ঠুংরী গাইলেন সিদ্ধেশ্বরী, যার কথাগুলি হলো “কাহে কো ডরি রে গুলাল ব্রজলাল কানহাই”, যে শ্রোতারা স্তব্ধ হয়ে রইলেন। সেই অনুষ্ঠানের পর আফতাব-এ-মৌসিকি ফৈয়াজ খান আর গাইতে অস্বীকার করলেন। বললেন “এই গানের পর আর কিছু হয় না! গৌহর, মালকার পর তোমার মাথাতেই পরিয়ে দিলাম ঠুংরীর তাজ!”
রামপুর, যোধপুর, লাহোর, মাইসোর সব জায়গা থেকে গান গাওয়ার ডাক পেতে লাগলেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী। রাজামহারাজের দরবার, সঙ্গীত সম্মেলন, ন্যাশনাল প্রোগ্রাম, রেডিও কনসার্ট সর্বত্র তখন গাইছেন সিদ্ধেশ্বরী, যতক্ষণ না তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন! পূরব অঙ্গের ঠুংরীতে এই ভূমিকার জন্য তাঁকে ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রভারতীর ডি-লিট ও দেশিকোত্তম উপাধীতে ভূষিত করা হয়।
পরবর্তী জীবনে তিনি ভারতীয় কলা কেন্দ্র দিল্লীতে প্রফেসর হিসাবে যুক্ত হন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে ছাত্রছাত্রীদের শেখাতেন। তিনি বলতেন “কিউ নহী? মেরে পাস যো ধন হ্যায় ম্যায় চাহতি হু মেরে জানে কে বাদ ইস ধন কা কুছ অংশ তো ইন লোগোঁ কে পাস রহে যায়ে!” তিনি চেয়েছিলেন গান গাইতে গাইতেই যেন তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তা হয়নি। অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে তাঁর সঙ্গীত স্তব্ধ হয়ে যায় অনেকদিন। অবশেষে ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
দুজন অসাধারণ কিন্নরকন্ঠী গায়িকার কথা না বললে ঠুংরী ঘরানার কথা এবং ঠুংরীর কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। একজন হলেন আখতারী বাঈ বা বেগম আখতার এবং অন্যজন হলেন গিরিজা দেবী। দুজন দুই সময়ের গায়িকা এবং দুজনের সঙ্গেই কলকাতার যোগাযোগ নিবিড়। দুজনেই আমার বড়ো প্রিয় গায়িকা।
প্রথমে বলি বেগম আখতারের কথা। তাঁর গানের সঙ্গে আমার পরিচয় একেবারে শিশু বয়সে। সেই যে আমার বাবার অজস্র রেকর্ড এবং তাঁর মন খারাপ হলেই চলতো আখতারীর ঠুংরী ও গজল! সেই বয়সে একেবারেই তার কোন রস পেতাম না। না বুঝতে পারতাম খাস উর্দু কথাগুলির অর্থ, না ভালো লাগতো তাঁর ঈষৎ মোটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলার আওয়াজ। আমি হয়তো মাকে বলে মনের সুখে রেকর্ডে ইংরাজী বাজনার সঙ্গে গান শুনছি “অব্লাডা অব্লাডি” আর খাটের ওপর নৃত্য করছি, এমন সময় বাবা এসে গম্ভীর মুখে সেই রেকর্ড বন্ধ করে দিলেন চালিয়ে বেগম আখতার! তারপর ঘর অন্ধকার করে শুয়ে পড়লেন! এবার শোন বসে সেই গান! অনেকবার বাবাকে গিয়ে বলতাম “আমার ভালো লাগছে না, কেমন ভাঙ্গা গলা” বাবা বলতেন “উনি ইচ্ছে করেই অমন ভাঙ্গেন গলাটা, ওটাই তো ওনার স্টাইল – আহা মধু মধু! যখন বুঝবি, আর কিছু শুনতে চাইবি না!” হাঁড়ির মতো মুখ করে চলে আসতাম। তারপর ঠাকুমার কাছে গল্প শুনতে চলে যেতাম। কিন্তু কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া যাচ্ছিলো সেই গান!
ক্রমে একটু বড়ো হতে, এবং গান শিখতে শুরু করার পর নিজের মনেই রেকর্ডগুলো বার করে দেখতাম। নাম লেখা আখতারী বাঈ ফৈজাবাদী। মহিলার নাকে ঝকঝক করছে হীরার নাকচাবি! মাথার চুলে লম্বা বেণী, সারারা, কামিজ পরণে, খুব সুন্দর ঢঙ্গে মাথার ওপর কাজ করা ওড়নি লাগানো, চোখে সুরমা! সামনে শোয়ানো তানপুরা। একদিন এমন বসে বসে রেকর্ডের কভার দেখছি, বাবা বললেন “উনি শুধু গান করেন না, সিনেমায় অভিনয়ও করেন! দারুণ সুন্দরী!” আরো বেশী করে দেখতে লাগলাম। রেকর্ডে তখন বাজছে ঠুংরী “সঈয়াঁ বোলো তনক মোসে, রহিয়ো না যায়ে”, “কোয়েলিয়া মত করে পুকার, করেজুয়া লাগে কাটার”, ভাবতাম করেজুয়া লাগে কাটার মানে কী রে বাবা? কোনদিন চলতো উর্দু গজল “ও যো হম মে তুম মে করার থা তুমহে ইয়াদ হোতে না ইয়াদ হোতে”, “উলটি হো গঈ যব তকদিরেঁ” অথবা “অ্যায় মুহব্বত তেরে আনজামসে রোনা আয়া” না বুঝতাম ‘করার’ মানে, ‘তকদির’ মানে, না বুঝতাম ‘আনজাম’ মানে। কিন্তু “না ইয়াদ হোতে” অথবা “আনজামসে” কথাগুলির ওপর গলাটা বিদ্যুতের মতো খেলে যেতো, অথবা “রোনা আয়া” একটু আনুনাসিক ভাবে ভেঙ্গে যেতো, মনে হতো “রোনা আয়া” কথাটা যেন প্রাণে গিয়ে লাগলো। এরকম ভাবেই একটু একটু করে বুঝতে লাগলাম বেগমের গান! পরে তো সেই সব গান আর তাঁর বাংলা ঠুংরীর রেকর্ড হয়ে গেলো প্রাণের চেয়ে প্রিয়। “পিয়া ভোলো অভিমান” কিংবা “কোয়েলিয়া গান থামা এবার” অথবা “জোছনা করেছে আড়ি” শুনে শুনে ওই স্টাইল নকল করার কতো ঐকান্তিক চেষ্টা! মনে পড়ে অনেক পরে প্রথমবার আকাশবাণী ভবনে গেছি কী একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। ঢুকেই ওয়েটিং রুমের দেয়ালে সব মায়েস্ট্রোদের ছবি। সেখানে রবিশংকর, আলি আকবর, বড়ে গুলাম, আমীর খান থেকে কে নেই। দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। সেই ভীড়ে চোখে পড়তো বেগম আখতারের সেই তানপুরা সামনে নিয়ে বড়ো ছবিটি। গলা শুকিয়ে আসতো! ভাবতাম এদের দরবারে আমি যেন ট্রেসপাস করে ঢুকে গেছি!