ধারাবাহিক প্রবন্ধে তপশ্রী পাল (পর্ব – ১৪)

আলাপ

ভারতের বিখ্যাত খেয়াল ঘরানাগুলির সফর প্রায় শেষ করে ফেললাম আলাপের পাতায়। কিন্তু তাও শেষ হয়ে হইলো না শেষ। পড়ে রইলো সবচেয়ে পুরোনো দিল্লি ঘরানার কথা এবং কয়েকজন বিখ্যাত খেয়ালিয়ার কথা যাঁদের শুধু ঘরানা দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না, কারণ তাঁদের শিক্ষা মিশ্র ঘরানায়। বাকী আছে আমার নিজের ঘরানা বিষ্ণুপুরের কথাও! পাঠক অবশ্যই বিস্মিত হবেন যে কেন আমার নিজের ঘরানা, যেটি কিনা বঙ্গের একমাত্র ঘরানা, তার কথা এখনো এলো না? তার কারণ হলো আমি প্রধাণতঃ এতোদিন হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের “খেয়াল ঘরানা”গুলির কথা বলেছি। বিষ্ণুপুর ঘরানা ইতিহাসের বিচারে একটি “ধ্রুপদ ঘরানা”, যদিও পরে এই ঘরানায় বিখ্যাত খেয়ালিয়াগণ আসেন। সুতরাং এই ঘরানার কথা অবশ্যই বলবো তবে তার আগে দু কথা বলে নিতে হবে এই অন্য ধরণের ঘরানাগুলি সম্বন্ধে। তার মধ্যে পড়বে উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্থানি গায়নের “ধ্রুপদ ঘরানা”, “ঠুংরি ঘরানা”, বাদনের ক্ষেত্রে “তবলা ঘরানা”, “সেতার ঘরানা” এবং “নৃত্য ঘরানা”গুলি আর কর্ণাটকী সঙ্গীত। অবশ্যই বিশদে যাবো না এই ঘরানাগুলি সম্বন্ধে কারণ আমার জ্ঞান অতি সীমিত এই বিষয়গুলিতে। তবে অবশ্যই থাকবে কিছু বিখ্যাত শিল্পীর গল্প যারা অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়।
প্রথমে সবচেয়ে প্রাচীন খেয়াল ঘরানা, দিল্লী ঘরানার কথা।
আগর ফিরদৌস বার রু-ইয়ে জমিন অস্ত
হামিন অস্ত ও হামিন অস্ত ও হামিন অস্ত
ফার্সী ভাষায় এই লেখার অর্থ, পৃথিবীর মাটিতে কোথাও যদি স্বর্গ থাকে তবে সে এখানে, তবে সে এখানে, তবে সে এখানে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর সম্বন্ধে যিনি একথা লিখেছিলেন, তিনিই প্রাচীন দিল্লী ঘরানার জনক, কবি, দার্শনিক, সঙ্গীত রচয়িতা সুফী সন্ন্যাসী আমীর খুসরু। তাই প্রথমেই একটু বলি তার গল্প। খ্রীষ্টিয় তেরোশো শতাব্দীর কথা। মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের খেশ অঞ্চল, যা আধুনিক উজবেকিস্থানে পড়ে। এখানে বাস করতেন এক তুর্কী আমির সইফুদ্দিন মামুদ। সেই সময় দস্যু চেঙ্গিস খানের আক্রমণে বিধ্বস্ত হচ্ছে তুর্কি এবং সমরকন্দ! দল বেঁধে পালাতে লাগলেন এই অঞ্চলের মানুষজন! পালালেন সইফুদ্দিন মামুদও। ঘরছাড়া হয়ে এসে পৌছোলেন আফগানিস্থানের বাল্ক অঞ্চলে! পাহাড়ি মরুপ্রান্তরে কোনরকমে দিন গুজরাণ করছিলেন মানুষগুলি। ১২৫০ সাল। দিল্লিতে তখন সুলতানী শাসণ চলছে। সিংহাসনে আসীন মামলুক বংশের সুলতান ইলতুতমীস! সমরকন্দের এই উদবাস্তুরা তার কাছে প্রতিনিধি পাঠালেন আশ্রয়ের জন্য। তারা জানতেন হিন্দুস্থান শান্তির জায়গা। ইলতুতমীস ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভুত। তাই এই উদবাস্তুদের প্রতি তার বিশেষ সহানুভূতি ছিলো । তিনি তাঁদের আশ্রয় দিলেন। এঁদের কয়েকজনকে তিনি তার সভায় বড় বড় পদ অথবা জমি দিলেন। দিল্লীতে এসে বসবাস শুরু করলেন সইফুদ্দিন মামুদ। ক্রমে তিনি নিকাহ করলেন উত্তরপ্রদেশের রাজপুতানা থেকে আসা এক মুসলিম নারী দৌলত নাজকে। এঁদেরই ছেলে আমীর খুসরো জন্ম নেন ১২৫৩ সালে। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন তিনি। মাত্র নয় বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে দাদুর কাছে মানুষ হতে শুরু করেন আমীর খুসরো। কিন্তু বাবার প্রভাবে তিনি ক্রমেই ইসলাম ধর্মচর্চা, সুফিয়ানা এবং আরবী, ফার্সী ও তুর্কি ভাষায় পন্ডিত হয়ে উঠলেন। ততদিনে দিল্লির মসনদে রাজত্ব করছেন গিয়াসউদ্দীন বলবন। তাঁর সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন খুসরো। খুব ছোটবেলা থেকে কবিতা লিখতেন তিনি। নয় বছর বয়সেই তাঁর প্রথম দিওয়ান বা কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ পায়। সেনাবাহিনীতে কবিতা শুনিয়ে বিখ্যাত হয়ে গেলেন খুসরো। গিয়াসউদ্দীনের বড় ছেলে তাঁর কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে দরবারে তাঁকে কবি হিসাবে স্থান দিলেন। তখন ১২৭৬ থেকে ১২৮০ সাল। পরপর অনেকগুলি দিওয়ান প্রকাশ করলেন আমীর খুসরো। তারপর তিনি বলবনের বড় ছেলে খান মুহম্মদের সঙ্গে মূলতান গেলেন। মূলতানকে তখন ভারতের দ্বার বলা হতো। বহু বিদগ্ধ পন্ডিত, সুফী ফকির, ব্যবসায়ী ও আরবী ফারসী বিশারদের সঙ্গে খুসরোর দেখা হয় এবং তিনি বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি ছন্দমিলের কবিতা বা দহলভি লিখতে শুরু করেন, যেগুলি পরবর্তীকালে সুর দিয়ে গানে রূপান্তরিত হয়। তাঁকে “হিন্দুস্থানের কোকিল” উপাধী দেওয়া হয়। এরপর মামলুক বংশের পতন ঘটান জালালউদ্দীন খিলজী এবং খিলজী বংশের শাসণ শুরু হয় দিল্লিতে। জালালউদ্দীন খিলজীও কবিতার ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর দরবারে সম্মানের সঙ্গে স্থান পেলেন খুসরো। খুসরোকে আমীর উপাধী তিনিই দেন। খিলজী বংশের পর তুঘলক বংশের সময়ও সুলতানদের সভায় আমীর খসরুর সমাদর কিছুমাত্র কমেনি।
আলাউদ্দীন খিলজীর মৃত্যুর পর ১৩১৬ সালে তিনি সুফী সন্ত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সঙ্গীতের দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়েন। ইনি সেই বিখ্যাত নিজামউদ্দীন আউলিয়া, যার নামে অসংখ্য খেয়াল বন্দিশ আজও গাওয়া হয়। যেমন গুর্জরী টোড়িতে আধারিত –
অব মোরি নইয়া পার করো রে
হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া
দুঃখ দালিদ্র সব দূর কর নেহার
তানরস খান কি লেহো খবরিয়া
গঞ্জসকরকে হো লড়াইয়া
এই গঞ্জসকর ছিলেন নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সমসাময়িক। দুজনের মধ্যে গানের লড়াইও প্রচলিত ছিলো। আছে তানরস খানের কথাও। কে তিনি? বলা আছে এই সংখ্যাতেই। দেখুন বন্দিশের মধ্যে কিভাবে ধরা থাকতো তখনকার সাঙ্গীতিক পরম্পরা।
নিজামউদ্দীন আউলিয়া হিন্দু মন্দিরের কীর্তনের সঙ্গে সুফি সঙ্গীতের মিশ্রণ আরবী, ফার্সী, তুর্কী এবং ভারতীয় হাভেলী সংগীতের মিশ্রণে তিনি এক ধরণের সুফি ধর্মীয় সঙ্গীত, কাওয়ালীর জন্ম দেন। এই গান অনেকে মিলে গাওয়া হতো। প্রধাণ গায়ক আল্লার বন্দনা, কঠিন স্বরবিস্তার এবং বিচিত্র তানকর্তব করতেন এবং বাকীরা তাঁর গানে সম্মিলিত ধরতাই দিতো হাততালি দিয়ে। খুসরোর যে সব ছাত্রেরা কাওয়ালী গানে বিশারদ হয়ে উঠলেন, তাঁদের নাম হলো কাওয়াল বাচ্চোঁ। এই কাওয়াল বাচ্চোঁদের গানই দিল্লি ঘরানার সূচনা বলা যায়। এরপর ক্রমে আমীর খুসরো তারানা ও ত্রিবট নিয়ে আসেন সঙ্গীতে। তারানা হলো এক ধরণের বন্দিশ যেখানে কথার পরিবর্তে দিরদির তানা নানা আলানি আলানি ইত্যাদি ধ্বনি সমন্বয় ব্যবহৃত হয় ছোট খেয়ালের মতো । এগুলি গেয়েই তানকর্তব করা হয়। তিনিই এই পদ্ধতিগুলির জনক বলা হয়। আমীর খুসরোর আরেকটি বিশাল কীর্তি হলো গজল। মধ্য প্রাচ্যের সঙ্গীত অবলম্বনে নজম এবং নগমার তিনিই স্রষ্টা। সেগুলিতে সুরারোপ করেই রচিত হতো গজল।
এ ছাড়া সেতার বাজনাটিও নিয়ে আসেন আমীর খসরুই!
আমীর খুসরো প্রচুর বন্দিশও লিখেছেন এবং সৃষ্টি করেছিলেন বেশ কিছু রাগ। প্রধাণত সুলতানদের সভায় দুই ভাই মীর হাসান সাওয়ন্ত কাওয়ালী ও এই ধরণের গানগুলি গাইতে থাকেন এবং তাঁর ভাই হাসান কলাবন্ত গাইতেন হাভেলী সঙ্গীত। এই দুইয়ের মিলনে এঁদের বংশধররাই দিল্লী ঘরানার সঙ্গীতরীতির বর্তমান রূপের প্রবর্তন করেন। ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী এবং বন্দিশ রচয়িতা ছিলেন তানরস খান।
বর্তমানকালে এই ঘরানার বিখ্যাততম ওস্তাদদের মধ্যে পড়েন উস্তাদ ইকবাল আহমেদ খান। তিনি খেয়ালে ৩৫ রকমের মল্লার রাগ এবং ৪২ ভাবে বাহার গেয়ে বিখ্যাত হন। উস্তাদ ২০১৪ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমী পুরস্কার পান। খেয়াল ছাড়াও ঘরানার পরম্পরা অনুযায়ী তিনি কাওয়ালী কলাম গজল ঠুংরী দাদরা ভজনে পারদর্শী। এছাড়া তিনি আমীর খুসরোর সময়ের আরবী ইরানী বয়েত গানগুলিও করেন, যেগুলি এখন একেবারেই অপ্রচলিত। তিনি চাঁদ কেদার, চাঁদ কল্যান, চাঁদ ভৈরব এবং চাঁদকৌশ রাগের সৃষ্টি করেন। খেয়াল ঢং এ গজল পরিবেশন করেও উস্তাদ বিখ্যাত হন। তিনি প্রথম বাহাদুর শাহ জাফর পুরস্কার পান, আমীর খসরু গোল্ড মেডেল লাভ করেন। এছাড়াও প্রিয়দর্শিনী পুরস্কার এবং রাজীব গান্ধী সদ্ভাবনা সম্মান পান। ১২০০ বছরের পুরোনো দিল্লী ঘরানার ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই উস্তাদের লক্ষ্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।