এবার বলি আর এক বঙ্গরত্নের কথা, যাঁকে আমরা হারিয়েছি কিছুদিন আগে। তাঁর কথা প্রথম কেমন অদ্ভুত ভাবে শুনি, সে প্রসঙ্গে বলি, আমার কাকা কাকীমা দুজনেই সঙ্গীতপ্রিয় এবং দীর্ঘদিন সঙ্গীতচর্চার করেছেন। কাকা ভালো তবলিয়া হওয়ার সাথে সাথে খেয়াল খুব ভালো গাইতেন। তাকেও আমি হারিয়েছি কয়েক বছর হলো। কাকীমা শিলং রেডিওর নজরুল, আধুনিক ও অসমিয়া গানের শিল্পী ছিলেন বিবাহপূর্বে এবং পরে দুজনেই আকাশবানীর বহরমপুর স্টেশন থেকে পারফর্ম করেছেন বেশ কয়েকবার। ব্যাবসা উপলক্ষ্যে কাকা বহরমপুরে থাকতেন, কিন্তু তাঁদের মূল নেশা ছিলো গান বাজনা। স্থানীয় শিল্পীদের সাথে জমজমাট গান বাজনার আসর বসাতেন নিজেদের বাড়িতে এবং নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন বিভিন্ন হলে। বহরমপুর যাওয়ার পর কাকা কাকীমা বেশ কিছুদিন উস্তাদ এ দাউদ খাঁর কাছে মার্গসঙ্গীত শিক্ষা করেছিলেন।
কাকা মাঝে মাঝেই কলকাতা এলে আমাদের বাড়িতে উঠতেন। কাকা এলেই আমিও কাকার সঙ্গতে গান করতাম। এমনই একদিন কাকা বললেন “জানিস, গুরুজী সেদিন এক ছাত্রের গান শোনালেন। আমাদের মুর্শিদাবাদেই থাকেন তিনি। নাম শ্রী অরুণ ভাদুড়ি! অসাধারণ লাগলো গলাটি। অপূর্ব সুরেলা গলা । গুরুজী বললেন যে ছেলেটি এতো ভালো গাইছে যে শীগগিরি ওর নাম মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। গুরুজী ওকে বারবার বলছেন কলকাতা গিয়ে সঙ্গীতগুণিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, কিন্তু উনি মুরশিদাবাদ ছেড়ে যাচ্ছেন না। বলে কাকা ওঁর একটি রেকর্ডিং এর টুকরো শোনালেন! আমি চমকে উঠলাম, যেমন চমকে উঠেছিলাম প্রথম অজয় চক্রবর্তীর গান শুনে! কী সুরেলা মন্দ্র কন্ঠ! কী সুন্দর রাগদারী!
এরপর একদিন সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমীর অ্যানুয়াল প্রোগ্রাম দেখতে গেছিলাম ওঁদের টালিগঞ্জের অডিটোরিয়ামে। কয়েকজন নতুন স্কলারের পর গাইতে উঠলেন অরুণ ভাদুড়ি! চমকে উঠলাম নামটি শুনে! এই তাহলে সেই অরুণ ভাদুড়ি যার কথা কাকার কাছে শুনেছিলাম! ততদিনে তিনি এস আর এর স্কলার এবং রামপুর ঘরানার ইশতিয়াক হুসেন খানের কাছে এস আর এ তে শিখছেন। এ ছাড়াও কলকাতায় এসে প্রথমে উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খান এবং পরে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা করেন তিনি। প্রথমেই নজর কাড়ে তাঁর সুন্দর সৌম্যকান্তি! গোটা চেহারায় বাঙ্গালিয়ানার এক দারুণ ছাপ। পরণে ঘিয়ে পাঞ্জাবী ও ধুতিতে মানানসই এক বনেদিয়ানার ছাপ! গানের মধ্যে অতিরিক্ত কালোয়াতি বা কায়দা করার কোন চেষ্টা নেই। কিন্তু সুর লাগাতেই যেন সুরের মূর্ছনায় ডুবে গেলাম। এমন অনায়াস রাগের চলন খুব কম শিল্পীর গায়নেই পাওয়া যায়। অদ্ভুত সুন্দর গতকারী ও বোলতানের প্রয়োগ!
ক্রমে তাঁর নাম গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়লো। সেই সময় সব বড় খেয়ালের সমারোহগুলি মাতিয়ে রাখতেন মূলতঃ তিনজন কলকাতার শিল্পী। অজয় চক্রবর্তী, অরুণ ভাদুড়ি এবং উস্তাদ রশিদ খান! বাঙ্গালী খেয়াল শিল্পীদের এমন রমরমা সেই প্রথম! তবে পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর মতোই পন্ডিত অরুণ ভাদুড়িও শুধু খেয়ালে সীমাবদ্ধ রাখেননি নিজের গায়কীকে। তিনিও বাংলা রাগপ্রধাণ, ভজন, নজরুলগীতি ইত্যাদি বেশ কটি ধারার গান গাইতেন বিভিন্ন আসরে এবং বেশ কটি রেকর্ডও আছে তাঁর লঘু সঙ্গীতের। খেয়ালের মতোই তা সমান মনোগ্রাহী। এর বেশ কিছু গানই পন্ডিতজীর নিজের রচিত। লেখালিখিতেও তাঁর সমান আগ্রহ ছিলো। বেশ কিছু ছোটগল্প, এমনকি “অষ্টরাগিনী” নামে একটি উপন্যাসও তিনি লিখেছিলেন।
এস আর এ তে পরবর্তীকালে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন অরুণ ভাদুড়ি। নতুন প্রজন্মের অনেক খেয়ালিয়াই এস আর এ তে পন্ডিতজীর কাছে শেখার সুযোগ পেয়েছেন।
আমি তাঁকে বেশ কয়েকবার শুনি ডোভার লেনে। আজও যেন কানে বাজে মধ্যরাতে তাঁর গাওয়া মালকোশ বন্দিশ “তু সুন্দর সুঘর বালমা”। বেরিয়ে এসেও কতক্ষণ কতদিন যে আনমনে গুণগুণ করেছি সেই সুর! এমনকি আজও।
পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন “অরুণদার সঙ্গীতে নিঃশর্ত সমর্পণ ও নিয়মানুবর্তিতা ছিলো তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ! অরুণদা ও আমি প্রায় একই সঙ্গে এস আর এ তে স্কলার হিসাবে যোগ দিই। এস আর এর ভিতরে একটি চালাঘরের বারান্দায় আমরা একসাথে সঙ্গীত সাধনা করতাম। অরুণদা কখনো রেওয়াজে ফাঁকি দিতেন না এবং অসম্ভব সময়ানুবর্তী ছিলেন। সঙ্গীত রচয়িতা হিসাবে তিনি প্রায় জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের মতোই ভালো ছিলেন। আমি তাঁর বেশ কটি রচনা গেয়েছি, যা বাংলা রাগপ্রধাণ হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। তাঁর খেয়াল বন্দিশগুলিও ভারী সুসংবদ্ধ এবং একেবারে আলাদা ছিলো। তিনি লিখবার সময় বন্দিশের ফাঁকে ফাঁকে জায়গা রাখতেন, যেখানে স্বরবিস্তার লেখা থাকতো।“