হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরানার এই সফরে ঘুরে এলাম গোটা ভারতবর্ষ। এবার ফিরবো বঙ্গদেশে, আমার নিজের শহর কলকাতায়। বলবো এমন দুজন বিখ্যাত খেয়ালিয়ার কথা, যাদের সঙ্গীতে শুধু বঙ্গদেশ মুগ্ধ নয়, মুগ্ধ তামাম ভারতবর্ষ এবং সঙ্গীতরসিক বিশ্ব। তাঁরা দুজনে শুধু নিজেরাই গান করেননি সঙ্গীতকে ছড়িয়ে দিয়েছেন এক বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে। তাই দুজনেই সঙ্গীতের দুই প্রতিষ্ঠান বলা যায়। তবে দুজনের শিক্ষাই মিশ্র ঘরানায়, তাই কোন একটি ঘরানার বাঁধনে বাঁধা যায় না তাঁদের সঙ্গীত।
সেটা আশির দশকের শেষের দিকে কোন একটি সময়। বাড়িতে তখন সবে রঙিন টিভি এসেছে। বাংলা চ্যানেল একটিই। দূরদর্শন কেন্দ্র কলকাতা। তবে তার অনুষ্ঠান বৈচিত্রের অভাব নেই। ভালো গানবাজনা এবং নাচ তখন নিয়মিত দেখা যেতো এই চ্যানেলে। আজকের মতো মেলোড্রামাটিক সিরিয়াল এবং রিয়েলিটি শো সর্বস্ব হয়ে পড়েনি টিভির জগত। সম্ভবতঃ পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিলো, তাই সন্ধ্যাবেলা পড়ার চাপ ছিলো না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ বাংলা রাগপ্রধান গানের অনুষ্ঠান হচ্ছিলো কলকাতা দূরদর্শনে। একজন সুপুরুষ চেহারার ভদ্রলোক, মাথায় ঘন চুল বাঁ দিকে সিঁথি কেটে আঁচড়ানো, চোখে চৌকো ফ্রেমের চশমা, পরণে পাজামা পাঞ্জাবী, একটি হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছেন। সঙ্গে শুধুই তবলা সঙ্গতে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। প্রথমেই কন্ঠের মন্দ্র আওয়াজ ও লাবণ্যে চমকে উঠলাম! কে ইনি? আগে দেখিনি তো! “চরণে বাজে মঞ্জির রিনিঝিনি” গাইছেন টোড়িতে একটি বাংলা রাগপ্রধান! কী মুন্সিয়ানা গায়কীতে, কী বৈচিত্রময় চলন গানের, জায়গামতো অপূর্ব বিস্তার, মূহূর্তে তিনসপ্তক ছুঁয়ে যাওয়া বোলতান! আমরা তখন শাস্ত্রীত সঙ্গীতের একেবারেই শিক্ষানবীশ ছাত্রী বলা যায়। আহা, যাহা দেখিলাম ও শুনিলাম, কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল! নামটি ভেসে উঠলো “অজয় চক্রবর্তী”। কে এই অজয় চক্রবর্তী? এ কোন স্বর্গীয় কিন্নরকন্ঠ! সত্যিই চমক লাগলো! তখন রেকর্ডের যুগ শেষ হয়ে সবে বোতাম টেপা টেপ রেকর্ডার ও ক্যাসেট টেপের যুগ! পুজোর সময় গানের সন্ধানে মেলডিতে গিয়ে দেখি তাঁদের কাচের ঢাকা ক্যাবিনেটে বেশ কটি ক্যাসেট সেই ব্যক্তির! সবই বাংলা রাগপ্রধানের। কিনে ফেললাম দু তিনটি ক্যাসেট আর তারপর বহুদিন বুঁদ হয়ে রইলাম সেই গানে! “কূল ছেড়ে এসে মাঝদরিয়ায় পিছনের পানে চাই”, “হোলি খেলিছে শ্যাম কুঞ্জ কাননে” কতো গান! যেমন কথা, তেমনি সুর, তেমনি যন্ত্রানুসঙ্গ। পড়ে পড়ে দেখলাম পিছনে, অনেকগুলি গানেরই রচনা ও সুর গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। আবার শিল্পির নিজের ও তার ভাইয়ের রচনা ও সুরারোপনও আছে।
এরপর এলো টিভিতে তাঁর সাক্ষাতকার। এই প্রথম জানলাম তাঁর সম্বন্ধে। কিন্তু তখনো তাঁর খেয়াল সেভাবে শুনিনি। সেটি শুনেছি আরো অনেক পরে। তাঁর বাংলা রাগপ্রধান গানের কথা যখন এলো, তখন এই প্রসঙ্গে একটি গল্প না বললেই নয়, যেটি শ্রদ্ধেয় মান্না দে তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন । এইরকম সময়েই অর্থাৎ আশির দশকের শেষের দিকে একবার মান্না দে কলকাতায় তাঁর বাড়িতে এসেছেন, কলকাতায় কোন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। সন্ধ্যাবেলা নিজের ঘরে তানপুরা নিয়ে বসে রেওয়াজ করছেন, এমন সময় খবর এলো একটি ছেলে দেখা করতে চায়। তিনি রেওয়াজের সময় একটু বিরক্তই হলেন, তবু ডেকে পাঠালেন। ছেলেটিকে দেখে অবাক হলেন মান্না দে। ছেলেটি বললেন “আমি আপনার গানের অন্ধ ভক্ত। আপনাকে ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করি।“ বলে ভক্তিভরে প্রণাম করতে গেলেন মান্না দে কে। মান্না দে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনি কি দূরদর্শনে গত সপ্তাহে মালকৌশ গাইছিলেন?” ছেলেটি বললেন “হ্যাঁ”। মান্না দে বললেন “আমি শুনেছিলাম অনুষ্ঠানটি! দাঁড়ান মশাই, আপনি আমাকে প্রণাম করবেন কী? আমারই উচিত আপনাকে প্রণাম করা! অমন গান বহুদিন শুনিনি মশাই! আপনি কার ছাত্র? কোথায় শেখেন?” গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের নাম শুনে করজোড়ে প্রণাম করে মান্না দে বললেন “ভবিষ্যতে গোটা ভারত আপনার গানের ভক্ত হবে, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি! আমি আজ থেকে আপনার গুণমুগ্ধ ভক্ত!” শুনে লজ্জায় প্রায় মাটিতে মিশে গেলেন ছেলেটি। যিনি যতো বড়ো গুণী তিনি তত বিনয়ী! এতোটুকু ইগো ছিলো না মান্না দের মতো অতোবড়ো একজন গায়কের! অনেক ছোট একজন উঠতি গায়ককে স্বীকৃতি দিতে কোন কার্পণ্য করেননি। এইভাবেই নক্ষত্রসম ছিলো অজয় চক্রবর্তীর উত্থান!
তবে প্রত্যেকটি উত্থানের পিছনেই থাকে অনেক কষ্ট, অনেক আত্মত্যাগ, অনেক সাধনা এবং অবশ্যই বিরল প্রতিভা। প্রথমে একটু বলি সেই পিছনের ইতিহাস। অজয় চক্রবর্তীর পিতা অজিত চক্রবর্তী ও তাঁর পিতামাতা বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলা থেকে দেশবিভাগের সময় সব খুইয়ে এই বঙ্গে এসে পৌঁছন। কলকাতার কাছেই শ্যামনগরে বসবাস শুরু করে পরিবারটি। সহায় সম্বলহীণ পরিবারটির দৈনিক খাওয়াপরার সংস্থানও ছিলো না। অজিত চক্রবর্তী নিজেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ভালো গাইতেন। খুব ইচ্ছা ছিলো গৌরিপুর এস্টেটের সভাগায়ক এনায়েত খাঁ সাহেবের এর কাছে শিখবেন। কিন্তু তাঁর পিতা গান্ডা বাঁধার টাকাটুকুও দিতে পারেননি। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা তিনি ছেলের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন যে করে হোক। ছোটবেলা থেকেই অজয় নিজে নিজেই যে কোন গান তুলে নিতেন এবং বিভিন্ন ধরণের গান করতেন। তার মধ্যে ছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল, শ্যামাসঙ্গীত বাংলা আধুনিক যে কোন গান ভালো লাগতো তাই কন্ঠে নিতে তাঁর কোন অসুবিধা হতো না। একবার প্রেমানন্দ তীর্থস্বামী মহারাজ বাচ্চা ছেলেটির গান শুনে ভবিষ্যতবানী করেন যে সে বড় হয়ে খুব বড় গায়ক হবে। সেই কথা শুনে অজিত চক্রবর্তী স্থির করেন যে করে হোক ছেলেকে প্রকৃত সঙ্গীত শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা করুণ। এই সময় অজয়ের কাছে অনেক প্রলোভন আসতে লাগলো বিভিন্ন পাড়ার অনুষ্ঠানে গান শুনিয়ে পয়সা রোজগারের অথবা সিনেমায় গান গাওয়ার। কিন্তু তাঁর বাবা কঠোর ভাবে সে সব প্রলোভন থেকে তাঁকে দূরে রাখলেন।
তাঁর প্রথম গান শেখা শুরু বাবার কাছেই এবং তারপর পান্নালাল সামন্তর কাছে। এরপর তিনি তাঁর গুরু কানাইদাস বৈরাগীর কাছে নিয়ে যান অজয়কে এবং তিনি আবার তাঁর গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে নিয়ে যান । অজয় চক্রবর্তীর প্রকৃত মার্গসঙ্গীত এবং রাগপ্রধান শিক্ষা শুরু হয় গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছেই। তাঁর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে শিখতে লাগলেন অজয়। গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত ডোয়ার্কিন হারমোনিয়াম কোম্পানীর স্রষ্টা দ্বারকানাথ ঘোষের পৌত্র। তিনি দারুণ ফুটবল খেলতেন ও ছবি আঁকতেন। কিন্তু ফুটবল খেলতে গিয়ে চোখে আঘাত পেয়ে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তখন তিনি সংগীতে মনোনিবেশ করেন। তিনি সংগীত শিক্ষা করেন গিরিজাপ্রসাদ, রামপুর ঘরানার দবীর খান ও সাগীর খানের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফারুকাবাদ তবলা ঘরানার মসিত খানের কাছে তবলা শিক্ষা করেন। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান এবং অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর সব শিক্ষা উজাড় করে দিতে লাগলেন অজয় চক্রবর্তীকে। সেই সময়েই কলকাতার সংগীতমহলে এবং রেডিও ও টিভিতে অজয়ের আত্মপ্রকাশ। তিনি একদিকে খেয়াল, অন্যদিকে উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও বিশেষতঃ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ রচিত বাংলা রাগপ্রধাণ গান গেয়ে ততদিনে বেশ নাম করে ফেলেছেন। এই সময় অজয়ের জীবনে এক পট পরিবর্তন ঘটলো।
গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ আমেরিকার পেনিসিলভেনিয়া থেকে ডাক পেলেন সেখানে বসবাস করে সেমিনার ও সঙ্গীত শিক্ষা দেবার জন্য। অজয় হঠাত একদিন শিখতে গিয়ে শুনতে পেলেন গুরু অন্ততঃ বছর কয়েকের জন্য আমেরিকা চলে যাচ্ছেন! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো অজয়ের। তিনি এবং তাঁর গুরুভাইরা সবাই প্রার্থনা করতে লাগলেন কোনভাবে যেন গুরুজীর না যাওয়া হয়। শোনা যায় তাঁরা বিভিন্ন মন্দিরে গিয়ে পুজো দিতে লাগলেন, ঘন্টা বাজিয়ে দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। কিন্তু ভবিতব্য কে টলাবে? জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের যাওয়া স্থির হয়ে গেলো। হঠাত একদিন তিনি অজয়কে ডেকে বললেন “তোমার জন্য আমার একটি অন্য পরিকল্পনা আছে। তোমার জন্য আমি গুরু ঠিক করে ফেলেছি।“ অজয় তাঁর পায়ে ধরে বললেন “আমি আপনার কাছে ছাড়া আর কারো কাছে শিখতে চাই না।“ জ্ঞানপ্রকাশ বললেন “আমি কী করে পেনিসিলভেনিয়া থেকে তোমাকে শেখাবো? আর আমি না থাকলে কি তোমার শিক্ষা গান বাজনা বন্ধ হয়ে যাবে? মন দিয়ে শোন, আমি পাতিয়ালা ঘরানার মুনাওয়ার আলি খান সাহেবের কাছে তোমাকে পাঠাবো শেখার জন্য।“ অজয় জানতেন যে মুনাওয়ার আলি সাহেব উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের পুত্র এবং বিখ্যাত শিল্পী। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন “তিনি কি আমাকে শেখাবেন?” জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর হাতে মুনাওয়ার আলির নামে একটি চিঠি লিখে তাঁকে পাঠালেন।
পিতার সঙ্গে অজয় চক্রবর্তী এলেন পার্ক সার্কাসে মুনাওয়ার আলির বাড়িতে। তিনি তখন অন্য ছাত্রদের শেখাচ্ছিলেন। বাইরে বসে অজয় দেখেন দেয়ালে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি সাহেবের অনেক ছবি। সেই বিখ্যাত আড় টুপি এবং বিশাল গোঁফ নিয়ে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন উস্তাদজী। অজয়ের বুকে কম্পন শুরু হলো। তিনি শুনেছেন পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীত এবং বড়ে গুলামের গান! অপূর্ব সেই সঙ্গীত কিন্তু তিনি তো এই ধারার সঙ্গে পরিচিত নন, পারবেন কন্ঠে সেই হরকত, সেই কায়দা আনতে? তিনি শুনলেন ভিতরে মুনাওয়ার সাহেব গাইছেন বড়ে গুলামের একটি বিখ্যাত ঠুংরি “কাটে না বরহ কি রাত”! আহা কী দরদ সেই গানে! মনে মনে মাথা নত করলেন। শিক্ষা শেষে বাইরে এলেন মুনাওয়ার আলি। অজিত চক্রবর্তী বললেন তাঁর ছেলে শিখতে চায় উস্তাদজীর কাছে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের চিঠি দিলেন। মুনাওয়ার আলি বেশ হাসিখুশী সৌম্য চেহারার। ভয় খানিকটা কাটলো অজয়ের। তাঁর পিতা জিজ্ঞাসা করলেন “আপনি কি আমার ছেলের গান শুনবেন?” মুনাওয়ার আলি বললেন “না না, জ্ঞানজী যাকে চিঠি লিখে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তাঁর গান সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমি শেখাবো আপনার ছেলেকে। কিন্তু রোজ ওকে আসতে হবে কিন্তু। নইলে এই শিক্ষাদান সম্পন্ন হবে না।“ রাজী হলেন পিতা পুত্র। অতঃপর দক্ষিণার কথা। মুনাওয়ার জিভ কেটে বললেন “না না, জ্ঞানজীর পাঠানো ছাত্রের কাছে আমি কিছু নেবো না। খালি গান্ডা বন্ধনের জন্য একবাক্স মিষ্টি, অন্ততঃ একটি বস্ত্র, হাতে বাঁধার সুতো ইত্যাদি নিয়ে এলেই হবে। পরদিন থেকে মুনাওয়ার আলির গান্ডা বদ্ধ শিষ্য হলেন শ্রী অজয় চক্রবর্তী। কীভাবে তিনি সেই ঘরানার গায়কী রপ্ত করেছিলেন তা আমি শুনেছিলাম তাঁর অনেক বছর পরে ডোভার লেনে।
সেবার মধ্যরাত্রে ডোভার লেনে অজয় চক্রবর্তীর গান। হলে মাছি গলার জায়গা নেই এমন ভীড়! অজয় চক্রবর্তীর বিরাট ছাত্রছাত্রীর দল, অন্যান্য বহু সঙ্গীত শিল্পী, গুণমুগ্ধ, বহু বিদেশী এসে ভীড় করেছেন হলে। ততদিনে দেশে বিদেশে অজয় এক বিরাট নাম! হলে হঠাত গুঞ্জন শুরু হলো! অজয় চক্রবর্তী নাকি বিশেষ পোশাকে এসেছেন! অবশেষে বেশ খানিকক্ষণের অপেক্ষার পর অজয় চক্রবর্তী মঞ্চে প্রবেশ করলেন। পরণে হুবহু বড়ে গুলাম আলির মতো সালোয়ার, লম্বা কালো কোট, পকেটে পকেট ঘড়ি, মাথায় আড় টুপি, মস্ত গোঁফ রেখেছেন, চোখে এঁকেছেন সুর্মা! বিরাট চেহারা এবং ভুঁড়ি! তিনি শুধু গলায় নয়, চেহারাতেও ঘরানার পরম পুরুষকে অনুসরণ করতে শুরু করেছেন, গানে যাতে সেই মেজাজ আসে। দেখে তখন বেশ মজা লেগেছিলো। তারপর শুরু হলো গান। আগের খেয়াল গায়নের ধারা অনেকাংশে বদলে গেছে, পাতিয়ালা ঘরানার ঢংএ চঞ্চল খেয়ালের প্রকৃতি, দ্রুত হড়ক তান এবং ঘরানার বিখ্যাত বন্দিশ শোনালেন। শোনালেন বড়ে গুলাম সাহেবের বিখ্যাত কয়েকটি ঠুংরি। তবে সত্যি বলতে কি সেই প্রথম টিভিতে দেখা ছেলেটিকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেললাম সেদিন।
যাই হোক মুনাওয়ার আলির কাছে বেশ কয়েক বছর শেখার পর আবার পরিবর্তন আসে অজয়ের সাংগীতিক পরিমন্ডলে। হঠাত তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বিজয় কিচলু সাহেবের। তিনি তখন আই টি সি তে আছেন। রবি কিচলু ও তিনি মিলে সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমী তৈরীর পরিকল্পনা করছেন। এরপর প্রচুর স্কলারশিপ, যা তিনি ভাবতেই পারেননি, তাই নিয়ে সেই অ্যাকাডেমীর প্রথম স্কলার হিসাবে সেখানে যুক্ত হন অজয় চক্রবর্তী। তিনি পান বিরাট এক প্ল্যাটফর্ম, পরিচিতি এবং বহু শ্রোতার প্রশংসা। সেখানে গিয়ে তিনি এক সর্বভারতীয় পরিবেশ ও গুরুদের পান, যা তাঁকে বাংলার গন্ডির এমনকি দেশের গন্ডির বাইরে বেরোনোর সুযোগ করে দেয়। তাঁর জীবনে এক বড় পরিবর্তন আসে যা প্রায় রূপকথার মতোই। এখানে থাকাকালীন তিনি চন্দনা চক্রবর্তীকে বিবাহ করেন। কিন্তু এই খ্যাতি ধরে রাখতে তাঁকে আরো আরো অনেক বেশী পরিশ্রম এবং এমনকি সারা রাত্রিব্যাপী রেওয়াজ করতে হয়। সঙ্গীতপিপাসু অজয় যেন সব রস শুষে নিতে শুরু করলেন সেখান থেকে। তিনি শুনতে পেলেন লতাফত হুসেন খান, হীরাবাঈ বরোদেকর, নিবৃত্তিবুয়া সরনায়েক, এ টি কানন এবং নিসার হুসেন খানকে। এরা সবাই তখন ওখানে গুরু হিসাবে যুক্ত। তাঁর চোখের সামনে দেখেন রশিদ খানের উত্থান, যার গান শুনে তিনি অভিভূত হতেন। এর সঙ্গে তিনি আত্মীকরণ করতে লাগলেন আমীর খানের গায়কীও। বিশেষ ভাবে দ্রুত ও অতিদ্রুত তান শিক্ষার জন্য যেতে লাগলেন এস আর এর বাইরে সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও। তৈরী হলো আজকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেয়ালিয়া অজয় চক্রবর্তীর সম্পূর্ণ নিজস্ব গায়নরীতি যা বিভিন্ন ঘরানার নির্যাসে এবং সাধনায় প্রস্ফুটিত।
এরপর আরো বহু বহুবার ডোভার লেনে, বিড়লা সভাঘরে, রামকৃষ্ণ মিশনের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে শুনেছি তাঁর গান। প্রতিবারই যেন এক নতুন ভাবে নতুন বৈচিত্রে গায়নের প্রচেষ্টা দেখেছি তাঁর মধ্যে। এমনকি এক সময় গুরু বালমুরলীকৃষ্ণর সংস্পর্শে এসে কর্ণাটকী সঙ্গীত শিক্ষা করতে শুরু করেন এবং সেই সঙ্গীতের তিল্লানা ইত্যাদি নিজের গায়কীতে নিয়ে আসেন।
ক্রমে তিনি এস আর এর অন্যতম প্রধান গুরু হিসাবে শিক্ষাদান শুরু করেন। শিক্ষাদান পর্বেই তিনি বুঝতে পারেন যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এতো শান্তি পাওয়া যায় কারণ এর মধ্যে মিশে আছে এক আধ্যাত্মিকতা, নিষ্ঠা, চিন্তন, পরিশ্রম ও আহুতি। পরবর্তী প্রজন্ম এবং ছাত্রছাত্রীরা যেহেতু আর ঘরানা এবং গুরুকূলের স্পর্শ পাচ্ছে না, তাই তাঁদের মধ্যে এই জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া বড়ই প্রয়োজন। সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা ঠিকই, কিন্তু তাঁকে কষ্ট দিতো একটি ব্যাপার, যে গুরু যা বলবেন তাই বেদবাক্য রূপে মেনে নিতে হবে, কোন প্রশ্ন করা যাবে না, এই ছিলো নিয়ম। কিন্তু প্রশ্ন না করলে নতুন চিন্তন আসবে কোথা থেকে? সঙ্গীত এগোবে কী ভাবে? এই সব নানা চিন্তা থেকে তিনি একসময় এস আর এ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর নিজের বিশাল সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান শ্রুতিনন্দন তৈরী করেন। আজও সেখানে তিনি, তাঁর স্ত্রী এবং আর এক বিখ্যাত খেয়ালিয়া, তাঁর কন্যা কৌশিকী দেশিকন তাঁর নিজস্ব শিক্ষায় শিক্ষিত করে চলেছেন এক বিশাল ছাত্রকূলকে।
তিনিই প্রথম বাঙ্গালী গায়ক যিনি পদ্মভূষণ লাভ করেন। পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী পুরস্কার এবং বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিংগার অ্যাওয়ার্ড । পৃথিবী বিখ্যাত হলগুলিতে গান শোনানোর সুযোগ হয় তাঁর, যেমন কার্নেগী হল, রয়াল অ্যালবার্ট হল, কেনেডি সেন্টার, থিয়েটার দে লা ভিলে, কানাডায় আগা খান মিউসিয়াম ইত্যাদি। আজ তিনি এক লিভিং লিজেন্ড।