প্রবন্ধে তপন মন্ডল

আত্মসমালোচনা
মানুষের অভ্যন্তরীণ উপলব্ধি হলো আত্মসমালোচনা। কোন কর্মের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধই হলো আত্মসমালোচনা। মানুষ তার অন্তর দর্পণে ন্যায় অন্যায়ের বিচার বিশ্লেষণ করে যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। ভুল সংশোধন করে নতুনভাবে চলতে শেখে।
উপনিষদে বলা হয়েছে ‘আত্মানং বিদ্ধি’, অর্থাৎ নিজেকে জানো। আত্মজিজ্ঞাসাই মানুষের সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা।
ব্যক্তির আত্মসমালোচনালব্ধ সিদ্ধান্ত নেতিবাচক বা ইতিবাচক দুইয়েই হতে পারে। অবশ্য ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উপর এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করে । বুদ্ধিমান, সৎজন, মিতভাষী, দয়ালু ,যুক্তিবাদী, ধার্মিক ব্যক্তি সর্বদা আত্ম সমালোচনায় নিমগ্ন হন। অভ্যন্তরীণ মনো দর্পণে বারবার প্রশ্ন তোলেন কর্মের নৈতিকতা ও অনৈতিকতা সম্পর্কে। নাস্তিকপন্থী বা অসামাজিক ব্যক্তিবর্গ কোন কালেই আত্ম সমালোচনার বশবর্তী হন না।
কর্মক্ষেত্রে আমরা কখনো কখনো নিম্নতর ব্যক্তি অথবা দায়িত্বশীল কর্মীর উপর বীতশ্রদ্ধ হই। অকারনে বা পরাশক্তির উস্কানিমূলক ইন্ধনে প্রভাবিত হয়ে উগ্র মূর্তি ধারণ করি এবং অত্যুক্তি কথনে মানহানি বা মারধরে উদ্যত হয়ে থাকি। দিগ্বিদিক জ্ঞান তখন থাকে না। আজ সমাজের বুকে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে। লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে মানবতার দোহাই দিয়ে অজস্র অন্যায় করে থাকে পরাশক্তি। পরনারীর প্রতি আসক্তিতে সার্বক্ষণ মেতে থাকে রাক্ষসে হীন মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা। এরা আত্মসমালোচনা তো দূরের কথা দিবারাত্রি সুরার গোলাম হয়ে বরঞ্চ আরও অন্যায় কর্মে প্রবৃত্ত হয়।
আজকাল পরনিন্দা বা পরচর্চা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমরা সারাক্ষণ মানুষের ভুল ধরতেই ব্যস্ত। অপরের দুর্বল দিক গুলি নিয়ে সমালোচনা করি। হাসাহাসি করি। অপরের দোষ ত্রুটি দেখে উপহাস করি। মানুষের কুৎসিত রূপ নিয়ে তাচ্ছিল্য করি। কথাবার্তার জড়তা বা আঞ্চলিক ভাষাকে অপমান করি। অশিক্ষিত ব্যক্তিকে অযৌক্তিক প্রশ্ন করে নিজেকে জ্ঞানী বলে প্রতিপন্ন করি। নিজেদের দোষ ত্রুটি দেখতে পাই না। বর্তমান সমাজে এটি দগদগে ক্ষত তৈরি করেছে।
The hardest work in the world is to cleanse yourself. And the easiest thing is to criticize others.
ভাগবত গীতা, কোরআন, বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ গুলিতে মানুষের আত্ম সমালোচনার বিষয়টি উল্লেখিত। মানুষের কর্মে ভুল ত্রুটি অবশ্যম্ভাবী। মানুষ দৈনন্দিন কর্মজীবনে হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে হাজারও ভুল ত্রুটি করে বসে। কিন্তু নিভৃতে বসে যদি দৈনন্দিন কর্মজীবনের আত্ম সমালোচনা করা যায় তবে যথার্থ ভুল সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। সংশোধনের সুযোগ পেতে পারি।
প্রাচীন সাহিত্যে ঋষি বাল্মিকীর পূর্ব জীবন সম্পর্কে জানা যায়। পূর্ব জীবনে বাল্মিকী একজন দস্যু ছিল। পরবর্তীতে নানাবিধ কারণে দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে নিজের আত্ম সমালোচনা দ্বারা সত্যের উপলব্ধিতে নিজেকে নিমগ্ন করেন। হিংসার জীবন ছেড়ে সত্য উপলব্ধি করেন। প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ রামায়ণের জন্ম দেন।
গৌতম বুদ্ধ একজন সামন্ত রাজা ছিলেন। সাংসারিক জীবনে তিনি মানুষের নানাবিধ জীবন যন্ত্রণার কারণ উপলব্ধিতে মেতে ওঠেন। মনে একাধিক প্রশ্নবান বিদ্ধ করে। এক সময় সংসারের জীবন পরিত্যাগ করে মহান সত্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। হিমালয়ের পাদদেশে নির্জনে আত্ম সমালোচনায় বসেন। একসময় তিনি মহান সত্য উপলব্ধি করেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ আত্ম সমালোচনা করে, ব্যক্তিগত মঙ্গলার্থে । এ সমস্ত মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই সমস্ত মানুষ আত্ম সমালোচনা দ্বারা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে নিজেকে মানবিক করে তোলে। নিজের ভুল ত্রুটি শুধরে নিজেকে সংশোধন করে। শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলে।
মহান ব্যক্তিরা জগত ও জীবের মঙ্গলের জন্য ধ্যানস্ত হয়। শোষণ, শাসন , অন্যায়, অবিচার, অনাচার, দুর্নীতি, উৎপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানব আত্মসমালোচনায় বসে। জগতের প্রত্যেকটি ব্যক্তির মঙ্গলে আপ্রাণ চেষ্টা করে । জগতের মঙ্গল কামনায় ছুটে বেড়ান দেশ দেশান্তরে। এরা মহামানব। নিপীড়িত মানুষের প্রতি ঐকান্তিক সহানুভূতি দান করে মহামানব । দান করে জীবনমুখী বাণী ও আদর্শ। বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, গৌতম বুদ্ধ, হযরত মুহাম্মদ, যীশু খ্রীষ্ট, প্রমুখ মহামানব উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ । যুগে যুগে এমন মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে জীব ও জগতের মঙ্গলে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে সেবা, ত্যাগ ,তপস্যার দ্বারা মানব মুক্তির পথকে প্রশস্ত করেছেন।
সাধারন মানুষ দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটায়। এতটাই কর্মব্যস্ত থাকে যে, আত্মসমালোচনার সময় তাদের কাছে থাকে না। তবে প্রত্যেক মানুষের উচিত একটি নির্দিষ্ট সময় বিশেষ করে রাত্রিতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে সারাদিনের ভুল ত্রুটির বিচার বিশ্লেষণ করা। নিজের ভুল ত্রুটিগুলি শুধরে নেওয়া। ভুল ত্রুটি সংশোধন করতে পারলেই জগত সুন্দর হয়ে উঠবে। আত্ম সমালোচনায় শুদ্ধ চৈতন্যের বিকাশ ঘটাবে। হিংসা, পরনিন্দার পরিবর্তে মানুষের মধ্যে উদারতার উন্মোচন ঘটবে। আত্ম সমালোচনা ভবিষ্যৎ সাফল্যের সিঁড়ি স্বরূপ । আত্ম সমালোচনা আত্ম সংশোধনের চাবিকাঠি। আত্ম সমালোচনাই পারে মানুষের ভেদাভেদ, আত্মঅহংকার ঘুচিয়ে আগামী ভবিষ্যতের সুন্দর সুখময় শ্রেষ্ঠ জগৎ গড়ে তুলতে।