ক্যাফে প্রবন্ধে তন্ময় কবিরাজ

কবিতা আজ অসহায়

২১শে মার্চ পালন করা হয় কবিতা দিবস। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় পালন করা হয় কবিতা উৎসব। শহর গ্রামের কবিরা জড়ো হোন, কবিতা পড়েন, কবিতার সুবাদে চেনা জানার পরিবেশ তৈরি হয়।কিন্তু কবিতার এতো আয়োজন থাকা সত্বেও কবিতা কি আজ দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছে? প্রকাশের এখন অনেক মাধ্যম।কবিতা এতটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে যে তার সর্বজনীন আবেদনের সত্তাকে সে অগ্রাহ্য করছে।সামাজিক মাধ্যমে কেউ কবিতা পোস্ট করছে,কেউ একক ভাবে বই প্রকাশ করছে,যাঁদের একক ভাবে ক্ষমতা নেই তাঁরা প্রি বুকিং করার নামে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।একদল উঠতি ছেলে এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং তরুন কবি লেখকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। অথচ এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। দুর্নীতি প্রশয় পাচ্ছে। কবিতায় এখন মুখোরোচক রঙিন ক্যানভাস প্রাধান্য পায়। মানুষের ভাবের থেকে চোখের সৌন্দর্য্য বেশি। কবিতা পড়তে হবে না, স্ট্যাটাস দিতে হবে তাই প্রেজেন্টেশনটাই আসল। গ্রাফিক্স ডিজাইন কি নেই কবিতায়!একটা কর্পোরেট মনোভাব।তবু কবিতা ধুঁকছে, এক শ্রেণীর কবি আর্থিক কষ্টে ভুগছেন, তাঁরা কবি সত্তাকে বিক্রি করে বেছে নিয়েছে অন্য পেশা। বেশির ভাগই কবিতা প্রকাশে আগ্রহী,কবিতার গুণগত মান নিয়ে চিন্তিত নন।তাই হাজার কবিতার ভেতরে সত্যিকারের কবিতার জন্ম হচ্ছে না বা হলেও কেউ তার খবর পাচ্ছে না, যা চিন্তার। কবিতার ভাষা, উপমা এমন জায়গায় যাচ্ছে যা সেই কবি ছাড়া আর কেউ হয়তো বুঝতে পারবে না। ফ্রান্সিস বেকনের সেই হিউমার অফ স্কলার বা ডেপুটি রেখে পড়ার মত ব্যাপার। কবিতা তো জীবনের কথা বলবে, কবিতায় উঠে আসবে জীবনের ঘাত প্রতিঘাত থেকে আর্থ সামাজিক পরিবেশ। কবিতা শুধু যে ওয়ার্ডওয়ার্থের আবেগের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ তা নয়, কবিতার ভেতর রয়েছে ম্যাথু আরনরলডের বিবেকের সাপেক্ষে ক্রমাগত শব্দ কাটাকুটির থিওরি, যাতে কবিতা আরোও বেশি করে জীবনের কাছে আসতে পারে। বেকন বলেছিলেন, মানসিক রোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করে কবিতা, আমাদের ভাবায়, ভাবনার শিকড়েই লুকিয়ে থাকে দর্শন।বাস্তবে তা হচ্ছে কই? কবিতায় ভাবনার অভাব। নিজ কবিতার উপর রয়েছে দম্ভ,সমালোচনা শোনার ক্ষমতা নেই।কবিতার মেধা যাই হোক তাকে প্রচার করতে হবে – এটাই ধারণা।কবি যদি আরোও এক কদম বেশি ভাবতে পারতো হয়তো নির্বাণের সন্ধান পেত কিংবা সত্যকে আপেক্ষিক হলেও খুজেঁ বার করতে পারতো।কিন্তু গন্তব্যের আগেই চলে এলো শব্দ, উপমা। কবিতাও শেষ হয়ে গেল।কেউ তার কথা জানলো না। কবিতা রয়ে গেল সত্য থেকে বহুদূরে। বিজ্ঞানে কত ভুলের গবেষণা হয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গবেষণা হয়,একটা তত্বকে আরও আধুনিক করার চেষ্টা চলে অবিরত। আজকাল কবিতায় সেই ইনট্রসপেকশন আবেদন কোথায়? কবিতার শেষে কবির আক্ষেপ নেই, বরং রয়েছে তৃপ্তি।তাই আরো ভালো বা উন্নত কবিতার চাহিদা নেই।সাবেক জীবন জীবনকেই ভালবেসে কাটিয়ে দিত সময়। তখন এতো বিচ্ছেদ ছিল না ,স্বাধীনতার সুখ ছিলো না ।আজ এতো স্বাধীনতা ,এতো বিকল্প যে মানুষ কোনো বিন্দুতে স্থির নেই,সে স্থান পরিবর্তন করছে ক্ষণে ক্ষণে, তাই তার বিন্দু দর্শন হচ্ছে কিন্তু সিন্ধু দর্শন হচ্ছে না। আক্ষেপ নেই বলেই সদ্যজাত কবিতাই আপলোড হচ্ছে বা প্রকাশ পাচ্ছে। আবেদনহীন সেইসব কবিতা তো মৃত, মানুষ যেমন সাড়া দেয় না, তেমনি কবিও ভুলে যান তাঁর কবিতাকে। কবিতার এই রকম সস্তা দাবি তো ছিল না আগে। রবীন্দ্রনাথের কথা নাই বা বললাম,তিনি তো প্রতিষ্ঠান। জীবনানন্দ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁদের কবিতা বহন করছে আপামর বাঙালির আবেগ, চলমান সময়।এতো বছর পরেও হেমন্তের কোনো পোস্টম্যান বনলতা সেনের কথা বলে যায়। উত্তাল বর্তমান সময়ে সেটা রাজনীতি হোক বা সামাজিক, বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ, কবিরা চুপ। তাঁরা তাঁদের মতোই করেই শিল্প চর্চা করছে যাঁর প্রভাব পড়ছে না কোথাও।কবি স্বপ্ন দেখায়, মৃত সমাজে তিনিই তো স্বপ্নের ফেরীওয়ালা, তিনিই ইউলিসিস, অথচ বর্তমানে বাংলার এক শ্রেনীর কবিরা আদর্শ বিক্রি করেছে, রঙ দেখে শব্দ বসাচ্ছে – ওরা হলে সরব আর আমরা হলে নীরব।মানুষ দেখছে,কেউ কথা রাখেনি, হয়তো কেউ কথা রাখে না। শিরদাঁড়া শুধু ছিল কবিতার রেটরিকে,বাস্তবে তো শাসকের কাছে মাথা নত করার কৌশল।কে বলেছিল শুধু কবিতার জন্য অমরত্ব ত্যাগ করতে পারি , আজ জাতিস্মর তাঁরা কোথায়? তাঁরা আবার ফিরে আসুক। কলম থেমে গেছে। কবিতার ঘরে আজ মানুষের কথা নেই। বেকার যুবক ধর্না দিচ্ছে, মা বোনের সন্মান যাচ্ছে, ভাতার বিনিময়ে নাগরিক আজ ক্রিতদাসে পরিণত হচ্ছে, কবিতা যেন রোমান সম্রাট নিরো, কথা বলে না। এই তো বছর দশেক আগেও সুনীল ,শঙ্খ বার্তা দিয়েছিলেন, বন্ধু আমি তোমার পাশে আছি।আমি কবি – এই অহংকারই শেষ করে দিল কবিতাকে। কবিতা যেমন প্রান্তিক মানুষের ঘরে যাচ্ছে না, তেমনই প্রান্তিক মানুষের কবিতাও প্রকাশ্যে আসছে না। বিভেদ প্রকট হচ্ছে। শোনা বা পড়ার ক্ষমতা কম, বলার ক্ষমতা বেশি। হটাৎ আবেগে উপচে পড়া শব্দে কবিতা হয়না, আবেগে অস্থির ঘোলা জল স্থির হলে গভীরতা মাপা যায়, চেনা যায়, দেখা যায়, বুঝে শুনে লেখা যায় আসল ঘটনার কথা। শঙ্খ ঘোষের দু চারটে শব্দের ভেতরেই থাকতো প্রতিবাদ ,যা সেদিনের মিডিয়ার শিরোনামে হতো।মানুষ তাঁকে ভরসা করতো। তাঁর ডাকে মানুষ নেমেছে রাজপথে। পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন।মানুষ বিশ্বাস করে ঘর ছেড়েছে।মানুষ জানে,তিনি প্রতারণা করবেন না।কারন তিনি কবি, তাঁর ধর্ম মানুষ, তাঁর ঈশ্বর কবিতা,তিনি অসহায় মানুষের সঙ্গে কোনোদিন রাজনীতি করেননি। এখন সেসব অলীক। সারদা প্রসাদ, মোহিনীমোহনরা জাতির বিকাশে যে কাজ করেছেন আজও তার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। ভুটানের লেখিকা কুঞ্জুং চোদেন সাহিত্যের বিকাশে লাইব্রেরি খুলেছেন, ভাষাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। বাংলা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে কিন্তু বাংলা ভাষাকে সে যত্ন করেনা। নন্দলাল বসু শিল্পবোধ তৈরি না হওয়ার জন্য তিনি শিক্ষিত মানুষকেই দায়ী করেছিলেন। কারন শিক্ষিত তথাকথিত কবিরা সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কবিতা আরোও সাধারন জীবনের বাইরে গিয়ে অবসরের বিনোদন বা ধনীর বিলাসিতা হয়ে যাবে।রবীন্দ্রনাথ থেকে বুদ্ধদেব বসু তৎকালীন অনেক অনামী কবিদের আবিষ্কার করেছিলেন , সযত্নে তাঁদের মূল্যায়ন করেছিলেন, তাঁদেরই অন্যতম জীবনানন্দ দাশ। কবিকে “পল্লীকবি”, “বিদ্রোহী কবি” এসব তকমা দিয়ে তাঁদের কাজের সার্বিক চর্চা হয়নি।যার বড়ো প্রমাণ জসীমউদ্দীন, কুমুদ রঞ্জন মল্লিকরা। সাহিত্যেও চেনা ছকে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে নতুন নতুন কাজ হয় সেগুলোও বাইরে আসে না, চর্চা হয়না। শুধু মধ্য মেধার বিজ্ঞাপন চলছে চারদিকে। তাঁরা শুধু তাঁদের কথাই বলছেন। ফলে মানুষ কবিতার উপর আস্থা হারাচ্ছে। দীনেশ দাস, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা আজ কোথায়? মানুষ যখন কাঁদছে তখনই যদি কবিরা মানুষের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে কবে দাঁড়াবে?এর পরেও বিতর্ক হবে পাঠক কবিতা পড়ে না,বই পড়ে না।কবি যদি পাঠকের কথা না ভাবে পাঠক কেন তাঁর কষ্টের পয়সা খরচা করবে?ভালো কাজ করলে মানুষ তাঁকে আজ না হলে কাল সম্মান দেবে।প্রবীণ কবি, লেখকরা মুখ খোলেন না বিতর্কে জড়ানোর ভয়ে। তাঁরা সন্মান নেবেন কিন্তু নাগরিক কর্তব্য পালনে তাঁদের দ্বিধা।আজ সময় এসেছে কবিতাকে বাঁচানোর।কবিতা সুখের কোলবালিশ নয়,মানুষের মুখপাত্র কবিতা। ফ্রয়েড যে গোপন মনের হদিস দিয়েছিলেন, কবিরা তারই শব্দরূপ বহন করে।কবিতা সাবালক।সে পরিনত। কবির হয়ত প্রথাগত শিক্ষার দরকার নেই,কিন্তু চেতনার দরকার।সবাই কবিতা লিখলেও, কবিতার স্বার্থে সবাই কবি নয়,কেউ কেউ কবি। লাতিন আমেরিকা, ফ্রান্সে একদিন কবিতা ছিল চেতনার দোসর। সময় কথা বলেছে কবিতায়। যুদ্ধের অস্থির পরিবেশে কিটস, শেলীর মত কেউ পলাতক হয়েছেন, কেউবা শিল্প বিপ্লবের হার্ড টাইমসে দেখেছে নগ্ন ডোভার বিচ তাও সেই কবিতায়।প্রেমের রসায়নের শরীর মনের সমন্বয়ে এসেছে শেক্সপিয়ার আর জন ডান। আবার পদাবলীর বুকে স্থান পেয়েছে প্রাচীণ বাংলা। কবির ভাবনায় জাতির জাগরণ, সমৃদ্ধি ঘটবে চেতনার,মেধার।আজ বিজ্ঞান যদি তার সুফল দেশের আর্থিক বিকাশে সাহায্য করতে পারে,তাহলে কবিতা তাঁর চেতনা বিকাশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের দর্শনের জন্ম দিতে কেন পারবে না?শুধু রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের আটকে থাকলে তো চলবে না। কবিদের তাই যেমন নিরপেক্ষ নির্ভীক হওয়া দরকার, তেমনি সজাগ থাকাও দরকার যাতে মানুষ সত্য মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারে।সবাই আশা করে সেদিন আসবে । অক্টিভিয়া পাজ লিখেছিলেন, “সামওয়ান স্পেলস মি আউট”।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।