শহর থেকে গ্রাম বা মফস্বলে গেলে কারো কারো নতুনদা সিন্ড্রোম দেখা যায়, কেউ কেউ আবার বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা হয়ে থাকেন। আমার বাবা বহুদিন দ্বিতীয়টা হয়েই ছিল। এমনিতে এই ভদ্রলোকের জীবনকাহিনী পাঠ করলে দুটো খুব পরিষ্কার ফেজ দেখতে পাই।
এক- অত্যন্ত লাজুক, গুটিয়ে থাকা গ্রামের লজ্জা না ভাঙ্গা কিশোর
দুই- প্রায় সম্মোহক বাচন ক্ষমতার এক ক্যারিস্মেটিক চরিত্র।
আমার না থাক, তাঁর আবার একটা অলৌকিক জন্মকথা ছিল। ঠিক জন্ম নয়, নবজন্মকথা। ডাক্তার জবাব দিয়ে যাবার পর ছ বছরের বালকটিকে ফেলে আসা হয়েছিল বোলসিদ্ধি বুড়োশিবের থানে। সেখানে সে চোখ মেলে চায়। বোলসিদ্ধি মানে যার বোল বা বাক সিদ্ধ। বুড়োশিবের থানে বাবা শুধু নবজন্মই পায়নি, অসামান্য বাচন ক্ষমতাও পেয়েছিল!
দাদু ছিলেন প্রথমে মার্টিন বার্ন, পরে গ্র্যান্ড হোটেলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের মিছিলে হাঁটার জন্যে চাকরি যায়। অফিসে গিয়ে টেবিলে বরখাস্তর চিঠি দেখে কারণ জানতে চাওয়ায় সাহেব বস বলেছিল আস্ক গান্ধী! গান্ধীভক্তি এতদূর ছিল যে দাদুর প্রথম পুত্রের ডাক নাম ছিল গান্ধী। হায়, কি কন্ট্রাস্ট, বাবার ডাক নাম ছিল ভজা। বাবা বলত বাংলা সিনেমার সব চাকরের নাম নাকি ভজা। ছোট থেকেই অসুখবিসুখে ভোগা বাবা ম্যাট্রিকে কোন রকমে পাস করে। এই ছেলেকে দাদু কলকাতায় এনে পড়াতেই চায়নি। সেটা সম্ভব হয়েছিল ঠাকুমার জেদে। বীণাপাণি নামের এই মহিলার জিভে সত্যিই সরস্বতীর বাস ছিল। জয়নগর –মজিলপুরের তর্করত্ন বাড়ির মেয়ে ঠাকুমার বিয়ে হয় ছ বছর বয়সে। সম্পূর্ণ নিরক্ষর, কিন্ত আশ্চর্য স্মৃতিধর এই মহিলা ইংরেজি বাংলা সংস্কৃত – যা শুনত, হুবহু মুখস্থ করে ফেলত। একবার কলকাতায় এসে ট্রামে চড়েছে। পাশে এক মেমসাহেব। ঠাকুমা তার অনাবৃত বাহুতে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেখেছিল রঙটা কাঁচা না পাকা! মেম সকৌতূকে চাইলে অতঃপর তাকে ইম্প্রেস করার জন্য ছেলেদের মুখে শোনা প্যারীচরণ সরকারের ‘ফার্স্ট বুক অব রিডিং’ থেকে আউড়ে দিয়েছিল ‘ওয়ান ডে আই মেট আ লেম ম্যান ইন আ লেন ক্লোজ টু মাই ফার্ম’ দিয়ে শুরু হওয়া গোটা অনুচ্ছেদ। তো এই ঠাকুমা দাদুকে বলেছিল মেজ ছেলেকে কলকাতার কলেজে ভরতি করিয়ে দিতে। ‘আমার ভজা গড়িয়ে গড়িয়েও ওপরে উঠবে’ তখন দাদু মানে বরদাপ্রসাদ ভটচায্যি গান্ধীর পাল্লায় পড়ে বড় চাকরি খুইয়েছেন। বৃহৎ পরিবার টানতে গিয়ে তাঁর হিমশিম অবস্থা।এই কিশোর তখন দুপুরে প্রেসে কাজ করত, তারপর নাইট কলেজে পড়ত। বাড়িওলা রাত দশটায় আলো নিভিয়ে দিত বলে রাস্তার আলোয় পড়াশনা করত। এই বিদ্যাসাগরীয় জেদই হয়তো তাকে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেসি প্রথমবারেই উত্তীর্ণ করে। তাও আবার প্রথম তিনের মধ্যে সর্বভারতীয় মেধা তালিকায়।
যাই হোক কলকাতা ছেড়ে এসে প্রথম প্রথম তো সে খুব বিরক্ত। এক বছরের মাথায় ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠে আসা। তখন রোজই বাড়ি বিক্রি করে কলকাতা ফিরে যাবার হুমকি। এখানে মানুষ থাকে? কোন কালচার নেই। তার ওপর বর্ষায় রাসমাঠের জলকাদা ভেঙ্গে আপিস করা। এখানে একটু ভূগোল ফলানো যাক।
বরাবর বাড়ির ঠিকানায় লিখে এসেছি রাসমাঠ রথতলা। বন্ধুরা হাসত। রাস্তার নাম কই?বাড়ির নম্বর? কিন্তু এই ঠিকানায় দিব্যি চিঠি চলে আসত। চিঠি আসার সেই অলীক সময়ে। আর বরাবরের মত চৈতন্যে জড়িয়ে গেল দুই ঈশ্বরীয় শব্দ- রথ আর রাস।
সামনের মাঠে তিনশো বছরের বেশি পুরনো রথ দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি। তার সামনে রাসমঞ্চ।মঞ্চের বাঁদিকে নহবতখানা, তার গা ঘেঁষে দুধারে পাম গাছের সারি দেওয়া পথ ক্যানিং রোডে উঠেছে। মঞ্চের ডানদিকে রায়চৌধুরী বাড়ির সিংহ বসান দেউড়ি। তার সোজাসুজি কোশাঘাট, শিবমন্দির। এই ঘাট নাকি একসময় আদিগঙ্গার সঙ্গে জোড়া ছিল। এখানে কোশানৌকো ভিড়ত।ঘাটের ধারে একটা খুব পুরনো বকুলগাছ। এই শিবমন্দির পৃথিবীর নির্জনতম জায়গা, এর পেছনদিকটা লুকোচুরি খেলার পক্ষে আদর্শ।
এইরকম স্থানিকতায় বাবা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এখানে কফি হাউস নেই, নতুন কবিতা লিখে কাউকে শোনানোর নেই। অতীতে বাড়ির লোক জনকে কবিতা শোনাবার চেষ্টা করে দেখেছে, তাতে বেজায় খরচ। ছোট ভাই দেশে মার কাছে থেকে পুংশাসন ছাড়া বখে যাচ্ছিল, তাকে সেজন্যে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। কিন্ত সে স্কুলে না গিয়ে টালিগঞ্জে স্টুডিওপাড়ায় ঘোরাঘুরি করে নায়ক নায়িকার অটোগ্রাফ সংগ্রহের চেষ্টা করে। কথিত আছে যে ফিল্মে অবতরণের আশায় সে নিজের নাম দিয়েছিল লাভলিকুমার। সেই লাভলিকুমার একদিন যখন সুলতা চৌধুরীর অটোগ্রাফ এনে হাজির হল, তখন তাকে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিতে গিয়েও বাবা সামলে নিয়েছিল। কারণ অনেক সময়ই সে ছিল বাবার কবিতার একমাত্র শ্রোতা।একটা কবিতা পিছু সে একটা সিনেমার টিকিট কিংবা একটা ফিশফ্রাই কিংবা দুটোই নিত শুনেছি।
যাই হোক, বাবা ত রোজই বাড়ি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে। এমন সময় বিপদহরণ মধুসূদন দেখা দিলেন। নাম, কি আশ্চর্য, গোবিন্দ! সে হচ্ছে সেই ছিছি হাসিরানি আনা বেলেঘাটা সরকারের ছোটকাকা। আমাদেরও কাকু হয়ে উঠতে তার সময় লাগল না। মফস্বলের অচেনা দ্বীপে কাকু হয়ে উঠল বাবার ম্যান ফ্রাইডে।
আমাদের পরিবারের ইতিহাসে যেমন, তেমনি বাড়ির ইঁট কাঠের ইতিহাসেও কাকুর ভূমিকা অপরিসীম। প্রথমে সদর দরজা দিয়েই শুরু করা যাক। আগেই বলেছি রাসমাঠের অপর প্রান্তে রায়চৌধুরী বাড়ির দেউড়ি। এঁরা শুনেছি বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের শাখা। কাকু বাবাকে বোঝাল ‘দাদা, আপনার বাড়ির দরজাটা যেমন তেমন হলে চলে না। ওই রায়চৌধুরীদের দেখিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি…’
সেই দরজার পেছনে যে পরিমাণ টাকা ঢালা হয়েছে, তাতে একটা ঘর উঠে যায়। আর এ সমস্তই অফিস লোনের ক্ষেপে ক্ষেপে আসা টাকায়। দেউড়ি নহবতখানা মিলিয়ে যে জিনিস দাঁড়াল, তা চোরদের ঢোকার পক্ষে দারুণ ইইজার ফ্রেন্ডলি। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হলেও মানুষটা আদৌ বিষয়ী ছিল না, বাড়ি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে প্রচুর রোদ হাওয়া খেলে (চোরেদের স্বর্গরাজ্য আর কি!)। যার ফল দাঁড়াল এপার ওপার দেখা যায় না, লম্বাটে ইস্কুল বাড়ি, যেখানে ওপর নিচ মিলিয়ে ষাটখানা জানলা দরজা। বিশ্বাস করুন গুনে দেখেছিলাম একদিন। তাই হয়তো একবার লিখেছিলাম জানলাসমগ্র গান গায়। তাই হয়তো বাড়ি মানে আমার কাছে এখনও বাড়ির বাইরেটা, রোদ, হাওয়া, জানলাসমগ্র!
যাই হোক কাকুর দৌলতে বাবা ধীরে ধীরে দ্বীপবাসী হচ্ছে। কাছ দিয়ে জাহাজ চলে গেলেও রুমাল নাড়াতে ভুলে যায়। একদিন কাকু কয়েকজন যুবককে নিয়ে এল। তারা একটা সাংস-কিতিক পোগগাম করতে চায়, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা একটা ক্লাব খুলতে চায়, যার শুরুয়াত হবে ওই সাংস-কিতিক পোগগাম দিয়ে। বাবা এ অঞ্চলে সংস্কিতির ভগীরথ হবে, এটা আশা করেই তাদের আগমন।
শুনেছি বাবার সৌজন্যে কলকাতার নামকরা গায়ক গায়িকা তো বটেই, দু একজন চ্রিত্রাভিনেত্রীও এসেছিলেন নামমাত্র বা বিনা পারিশ্রমিকে। কে জানে এর পেছনে শ্রীমান লাভলিকুমারের হাত ছিল কিনা। বাবা সভাপ্ তিত্ব করেছিল বোধহয়, আর প্রধান অতিথি রায়চৌধুরী বাড়ির এক বিশিষ্ট জন। তাঁকে আবার উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে দিতে হয়েছিল এবং তিনি সাধারণত তিনখানার নিচে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতেন না!
সব মিলিয়ে অনুষ্ঠান জমে গেছিল সন্দেহ নেই। আর নিজের বাড়ি করার বেলায় না হোক, এই বিষয়ে বাবা বেশ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল। কারণ সেই যুবকেরা যখন তাদের ক্লাবের একটি নাম দেবার আবদার করেছিল, বাবা একটুও না ভেবে বলেছিল ‘সাময়িক সংঘ’। তথ্যের খাতিরে বলা ভাল, সাময়িক সঙ্ঘের সেটাই প্রথম এবং শেষ অনুষ্ঠান!