• Uncategorized
  • 0

ছোটদের গল্পে তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য

মেছো ভূতের গল্প

নদীর ধারের শেওড়া গাছে মেছো ভূতের বাস। আগে আগে সে জেলেদের নৌকা থেকে রোজ মাছ নিয়ে নিত। এখন জেলেরা ঠিক করেছে যে শেওড়া গাছের নিচে তারা নিজেরাই ভূতের জন্য মাছ রেখে আসবে যাতে ভূত আর তাদের নৌকায় এসে উৎপাত না করে। সেই মত জেলেরা তাদের পচে যাওয়া পড়ে থাকা মাছ সব শেওড়া গাছের নিচে রেখে আসে।
এদিকে মেছো ভূতের ভারি মজা। পুরনো পচে যাওয়া গন্ধ বেরোনো মাছ রোজ গাছের নীচেই পেয়ে যাচ্ছে, তার আর চাই কি? সে তখন ভাবল ‘আচ্ছা, জেলেদের সব মাছ যদি পচে যায় আর বিক্রি না হয়, তাহলে ত আরও পোয়া বারো! তখন সব মাছই তারা আমার কাছে দিয়ে যাবে।’ সে তখন একটা মতলব ঠাওরাল। একদিন রাতে গিয়ে গ্রামের মাছের বাজার লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে এল। পরদিন মাছের ব্যাপারীরা এসে দেখে তাদের দোকানপাট সব ভেঙেচুরে রেখে গেছে কারা! তাদের ত মাথায় হাত। সেদিন মাছের বাজার মাথায় উঠল, তারা সবাই মিলে দোকানপাট সারাই করতেই তাদের দিন গেল। জেলে বেচারাদের মাছ আর বিক্রি হল না, সব পচে গেল। সন্ধ্যাবেলায় তারা অগত্যা সেই পচা মাছগুলো মেছো ভূতের শেওড়াগাছের নিচে রেখে এল। তাই না দেখে মেছো ভূত গাছের ওপর ধিনতা ধিনা নাচতে লাগল। সারা রাত প্যাঁ হো প্যাঁ হো করে সে বিকট সুরে এমন গাইতে লাগল, যে গ্রামের লোকের ঘুম এল না।
দুদিন পর মাছের বাজারে আবার সেই এক কাণ্ড! রাতে যেন কে দোকানপাট ভেঙে চুরে দিয়ে গেছে। ব্যাপারীরা তখন সকলে মিলে পরামর্শ করতে বসল। প্রথমে তারা ঠিক করল পায়ের ছাপ থেকে হানাদারকে ধরবে। কিন্তু অনেক খুঁজেও কারো পায়ের ছাপ তারা মাটিতে পেল না। তারপর তারা হাতের ছাপ খুঁজতে লাগল। তাতেও তারা কিছু পেল না। তারা ভারি ফাঁপড়ে পড়ল তখন। শেষে ঠিক করল মোড়লের কাছে যাবে।
মোড়লমশাই সব শুনে বললেন ‘ এ ত দেখছি ভুতুড়ে কাণ্ড! গণৎকারকে খবর দিই তবে’। তখনই পাশের গাঁয়ের গণৎকার ঠাকুরকে খবর দিতে লোক গেল।
গণৎকার চলে এল। তাকে প্রথমে বাজারে নিয়ে যাওয়া হল। সব দেখে শুনে গণৎকার মাথা নেড়ে বলল ‘হুঁ।’ তারপর চোখ বুজে মাথা উঁচিয়ে মন দিয়ে নাকে বাতাসের গন্ধ শুঁকতে লাগল। সকলে চেয়ে রইল সেদিকে। গন্ধ শোঁকা শেষ হলে সকলে বলল ‘ কিছু বুঝলে ঠাকুর’? গণৎকার বলল ‘ এ ত নির্ঘাৎ মেছো ভূতের কাণ্ড।’ ‘ তাহলে এখন কি হবে?’ বড় বড় চোখ করে সকলে জিজ্ঞাসা করল। এক জেলে বৌ বলল ‘ ঠিক ত, এর আগের বার যখন বাজারে এমন কাণ্ড হয়েছিল, সেই রাত্তিরে মেছো ভূতের চ্যাঁচানি গানে আমাদের ঘুম আসেনি। খুব ফুর্তি ছিল সে রাতে ওর। গণৎকার তখন তার পুঁটলি থেকে একটা কড়ি বের করল। সেটা কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে একটা মন্ত্র পড়ল। শেষে কড়িটা ছুঁড়ে দিল ওপর দিকে। কড়িটা মাটিতে পড়ে গড়াতে শুরু করল। কড়ি গড়াতে গড়াতে যেদিকে, গণৎকার ঠাকুর সেদিকে; আর তার পিছন পিছন গোটা গাঁয়ের লোক।
কড়ি গড়াতে গড়াতে এসে থামল শেওড়াগাছের নীচে।
গণৎকার বলল ‘ আনো খড়।’ খড় চলে এল। শেওড়াগাছের নীচে খড় বিছিয়ে তাতে ধুনো দিয়ে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া দিয়ে গণৎকার মন্ত্র পড়তে লাগল। এইভাবে অনেকক্ষণ মন্ত্র পড়ে সে বলল ‘ এই গণ্ডি দিয়ে কেটে দিলাম, আর ভূত এসে উৎপাত করতে পারবে না। কিন্তু তোমরা এর ধারে কাছে মোটেই আসবে না। তাহলে কিন্তু গণ্ডি মুছে যাবে। ‘ এই উপদেশ দিয়ে গণৎকার চলে গেল।
যা কথা সেই কাজ। কেউ আর শেওড়াগাছের কাছে যায় না। কেউ সেখানে আর মাছ দিয়েও আসে না। ভূতের উপদ্রব আর রইল না।
এদিকে হয়েছে কি সেই জেলে বৌয়ের ভারি মায়া হল মেছো ভূতের ওপর। বেচারা মেছো ভূতটা আটকা পড়ে আছে, খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না, না জানি কত কষ্টে আছে। এমনি সব ভেবে সে একদিন করল কি, কয়েকটা শুঁটকি মাছ যত্ন করে ভেজে শেওড়াগাছের নীচে রেখে এল মেছো ভূতের জন্য। আর কোথা যায়, গণৎকারের গণ্ডি ত গেল তক্ষুনি মুছে- আর মেছো ভূত ছাড়া পেয়ে এক লাফে বেরিয়ে এল। এসেই মাছ ভাজা গুলো পেয়ে ফুর্তিতে নাচতে লাগল।
খানিকক্ষণ পরে সে ঠিক করল আর জেলে নৌকায় বা বাজারের ধারেকাছে যাবে না। অনেক শিক্ষা হয়েছে। সে মোড়লের বাড়ি যাওয়া ঠিক করল।
মোড়লের একটা ছোট মেয়ে ছিল। তার পোষা বেড়াল ছিল। মেছো ভূত গিয়ে দেখে মেয়েটা সেই বেড়ালকে মাছ খাওয়াচ্ছে। সে গিয়ে মোড়লের মেয়েকে বলল ‘ মাঁছ দেঁ না, আমাকেও দেঁ’। মেয়ে ভূত দেখে ভয় পেল না, হেসে ফেলল। মাছ দিল। মেছো ভূত মাছ পেয়ে ভারি খুশি।
মেছো ভূতের সাথে মোড়লের মেয়ের ভাব হয়ে গেল। বেড়ালের সাথে সে মেছো ভূতকেও পুষতে লাগল। মেয়ে কিন্তু কাউকে কিছু বলেনি। মেছো ভূত মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, তার পড়ার সময়ে জানালার ওপর বসে থাকে, খেলার সময়ে দূরে গাছে উঠে বসে থাকে- এমনিধারা আর কি।
একদিন হল কি, মোড়লের মেয়ে ইস্কুলে গেছে। মেছো ভূতও গিয়ে ইস্কুলের গাছের ডালে উঠে বসে আছে। ইস্কুলের নতুন মাস্টারমশাই পড়াতে এসেছে। মোড়লের মেয়ের পেন্সিলটা কেড়ে নিয়ে একটা দুষ্টু ছেলে মাস্টারমশাইকে ছুঁড়ে মারল। ভীষণ রেগে মাস্টারমশাই সেটা তুলে বললেন ‘ এই পেন্সিল কার?’ ভয়ে সবাই চুপ। তখন মেয়েটা আস্তে আস্তে বলে ‘ আমার মাস্টারমশাই’। আর কোথা যায়, মাস্টারমশায় ভীষণ রেগে জ্ঞানশূণ্য হয়ে শাস্তি দিয়ে দিল তাকেই। বেচারি বিনা দোষে শাস্তি পেয়ে ভারি মনমরা হয়ে গেল। মেছো ভূত সব দেখল দূর থেকে।
কয়েকদিন বাদে সেই নতুন মাস্টারমশাই একটু রাত করে ফিরছে গ্রামের রাস্তা দিয়ে। যেই বেলগাছের তলায় এসেছে, ওপর থেকে ধপাস করে একটা কাঁচা বেল তার মাথায় এসে পড়ল। মাস্টারমশাই তৎক্ষণাৎ বেহুঁশ হয়ে সেখানেই পা ছড়িয়ে পড়ে গেল। বলাই বাহুল্য যে মেছো ভূতের কাজ। সে তখন মাস্টারমশাইয়ের পাঞ্জাবি আর ধুতি খুলে বেলগাছে ঝুলিয়ে দিল।
পরদিন ভোরে গাঁয়ের লোকে দেখল নতুন মাস্টারমশাই ঐ অবস্থায় পড়ে আছে রাস্তায়। তখনই সব তাকে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরাল। মাস্টারমশাইয়ের ঐ অবস্থা কি করে হল কেউ পারল না বুঝতে। সকলে বলল বেল পড়েই মূর্ছা গেছে। কিন্তু কাপড়গুলো ওখানে কে ঝোলালো সেটা কেউ বুঝতে পারল না। অনেক কসরৎ করে আঁকশি দিয়ে ওগুলো নামানো হল। ততক্ষণ মাস্টারমশাইকে একটা গামছা দেয়া হয়েছিল পরতে। যাইহোক, ওগুলো নামিয়ে বেলকাঁটা ছাড়িয়ে মাস্টারমশাইকে দেয়া হল।
একটু তফাতে ঝোপের আবডালে গিয়ে মাস্টারমশাই কাপড় পরলেন।
কাপড় পরে এসেই বাবা গো মা গো চিৎকার। কাপড়ে প্রায় দুই গণ্ডা কাঠপিঁপড়ে ছিল বেলগাছের। তারা কামড়াতে লেগেছে। মাস্টারমশাই গড়াগড়ি দিতে লাগল মাটিতে যতক্ষণ না পিঁপড়েগুলো রেহাই দিল।
দূর থেকে মেছো ভূত একটা বাড়ির চালে বসে সবই দেখছিল পা ছড়িয়ে। অনেকদিন পর কাউকে জব্দ করে বেশ মজা হয়েছিল তার।
তারপর থেকে ওই মাস্টারমশাই রাগের মাথায় ইস্কুলের কাউকে কোনো শাস্তি দেয় নি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।