ক্যাফে গল্পে তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য

অস্তরাগ
(১)
নীর নাহি ধরে আঁখিতে
না পারি জীবন রাখিতে
হারায়েছি পিয়া দহিতেছে হিয়া
শমন ঝঞ্ঝা আসিলা
পরাণ তাহার নাশিলা
বিহগী একেলা শাখীতে।
হানিলা মরণ কঠোর
বিঁধিলা পরাণ ভ্রমর।
(২)
রতন ভাবিয়া পীরিতি রাখিনু
যতন করিয়া হৃদি মাঝে-
দেখিত সকলে লালিমা তাহার
বদন রাঙিত ভরা লাজে।
এ মরণকালে হারাইল নিধি
নিদারুণ সাজা লিখিলেন বিধি
রোদন ভরিল ব্যথিত পরাণে
অশেষ মাথুর সুর বাজে।
(৩)
অরুণ কিরণ আসিল বনেতে
পিয়া আর নাহি আসিবে
অধরা স্বপন পুড়িল মনেতে
তরুণী জীবন ভাসিবে।
ভসম হইয়া গেছে সেই জন
তথাপি অনল দহে অনুখন।
তাহারই তরে যে কুসুম বিকশি
বিঁধিছে স্মরণ মরমেতে পশি।
উপবনে আজ যত পাখী গায়
কেমনে তাহারা তাহারে ভুলায়
গগনে চাহিয়া শমনেরে কয়
কবে এ পরাণ নাশিবে।
এই তিনটে গান গাইল রেবেকা আজকের অনুষ্ঠানে। আর কিছু সে গাইতে পারেনি। গানগুলো দাদুর লেখা, গাওয়া, সুর দেওয়া। টপ্পা আঙ্গিকের গান। দাদু প্রসিদ্ধ পুরাতনী গানের শিক্ষক ও গায়ক। অনেক ছাত্র তাঁর।
খবরটা এসেছে দুদিন আগে। তমাল আর নেই। মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে অবশেষে ঢলে পড়েছিল তমাল। বিদেশের হাসপাতালে। রেবেকার কিছুতেই বিশ্বাস হয় নি। তারপরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। দাদু কে লুকিয়ে চিলেকোঠার ঘরে চলে গিয়েছিল। কান্না পাচ্ছিল খুব। তমালের মৃত্যুটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। ছয় বছরের অপেক্ষার কোনো মূল্য দিল না তমাল। সত্যিই চলে গেল। একটা অবলম্বন যেন সরে গেল চিরতরে। ভিতরটা যেন খালি খালি হয়ে গেল রেবেকার।
ছয় বছরের অপেক্ষা। কত আপত্তি ছিল তমালের বাড়িতে। রেবেকার বাবা বিদেশী- খ্রিষ্টান। মা বাঙালি। দুজনেই মারা গেছেন। রেবেকা ছিল দাদুর কাছে। দাদুর প্রিয় ছাত্রী।
অনুষ্ঠান থেকে ট্যাক্সি তে ফিরছে ওরা। দাদুর গা ঘেঁষে রেবেকা। দাদুর মুখে কোনো কথা নেই। দাদু রেবেকার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। অসহায় দৃষ্টিতে অন্যদিকে চেয়ে আছেন। চকিতে চাইলেন একবার রেবেকার মুখের দিকে। দুজনের চোখেই বড় করুণ দেখাল একে অপরের দৃষ্টি।
রাতের খাবারের সময় নীরবতা
ভঙ্গ করলেন দাদু। ‘ শোন একটা কথা শুনবি?’
রেবেকা মুখ তুলে তাকাল। দাদু বললেন ‘আজ অনুষ্ঠানে উৎপল এসেছিল। উৎপলকে মনে আছে? গান শিখেছিল ক’ বছর?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘ ও কদিনের জন্য দেশে এসেছে। তোর গান খুব ভালো লেগেছে ওর। ডাকব ওকে?’
রেবেকা মাথা নাড়ল।
-‘ওর এখনও বিয়ে হয়নি-বুঝলি? হায়ার স্টাডিজ এর জন্য বাইরে থাকে, ওর মা বলছিল আর কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে ফিরে আসবে। ওর দেশের ওপর খুব টান। কটা দিন অপেক্ষা করলে যদি….’
অপেক্ষা শুনেই চমকে তাকাল রেবেকা। আবার একটা অপেক্ষার সূচনা? মাথা নীচু করে তাকিয়ে রইল সে। বেশি কিছু চিন্তা করতে পারছে না। মনটা শোকে পাথর হয়ে আছে যেন।