ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ৮

আমেরিকার ডায়েরি – ৮
।। ১৭ অগাস্ট, শনিবার ।। অপরূপ মেরিল্যান্ড- ওশান সিটি ।।
ভোরের বৃষ্টি রাস্তা ধুয়ে দিয়ে গেছে। ঘুম ভেঙ্গে উঠে হোটেলের জানলা দিয়ে দেখলাম, বল্টিমোরের রাস্তা কি সুন্দর পরিষ্কার হয়ে আছে। ফুটপাতের সবুজ গাছগুলো জলে ধুয়ে আরও সবুজ সতেজ হয়ে হাসছে। নাম জানি না গাছগুলোর। কেমন ঝিরিঝিরি পাতার ঝাঁকড়া সবুজ গাছ। সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে দেখে মনে হলো এরা বনসৃজনের গাছ। রোড সাইড প্ল্যানটেশন। শহরের মাথার ওপর আকাশ। আকাশকেও বড় সুন্দর লাগছে। একদম নীলিমায় নীল!..
কাল রাতে হোটেলে ফিরে মেরিল্যান্ড নিয়ে ডুলুং সোহম অনেক হোমওয়ার্ক করেছে। ওয়েদার রিপোর্ট চেক করেছে। গুগুল সার্চ করে রোড ম্যাপ ঠিক করে নিয়েছে কারণ আজ আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাব মেরিল্যান্ড ওশান সিটি । বল্টিমোর থেকে মেরিল্যান্ড ওশান সিটি পৌঁছাতে তিন ঘন্টার ড্রাইভ। রাস্তা তো চমৎকার। সুতরাং এই ছোট্ট লংড্রাইভ খুব উপভোগ করব।
আমাদের হোটেল BREXTON এর কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টে খুব ভালো আয়োজন গতকালও ছিল না। আজও নেই দেখলাম। বস্টনের LA QUINTA র ব্রেকফাস্ট ছিল অপূর্ব। অনেক অপশন ছিল। এখানে মাত্র কেক, কুকিজ, ফ্রুট জুস ও ফল । চা কফি আছে। কিন্তু দুধ, কর্ণফ্লক্স, ডিম সেদ্ধ বা ওমলেট কিছুই নেই। যাই হোক তাই খেয়ে নিলাম আনন্দ করে। খাওয়া নিয়ে খুব ক্রিটিকাল হলে ভ্রমণে বিড়ম্বনা বাড়ে।
বল্টিমোর শহর থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে গেলাম। মেরিল্যান্ডের বড় শহর বল্টিমোর। এখানকার ইনার হারবার খুব বিখ্যাত। এবং বল্টিমোরের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটিরও সুনাম রয়েছে। আমাদের পরিচিত একজনের মেয়ে জন্স হপকিন্সে পি এইচ ডি করছে।
আমেরিকার হাইওয়ে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। যেমন সুন্দর তার রাস্তা, তেমন সুন্দর দু’পাশের দৃশ্য ও নির্জন জনপদগুলো। এক একসময় ভাবছিলাম, পথের ধারে এমন সুন্দর নির্জনতায় ওরা দিনের পর দিন থাকে কি করে! এক একটা বাড়ি থেকে পাশের বাড়িও অনেকটা দূরে। আর পাড়া বলতে তেমন কিছুই নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা বাড়ি রয়েছে কেমন যেন দ্বীপের মত। কি আত্মকেন্দ্রীক দিনযাপন ওদের। শুধু বিত্ত আর বৈভব দিয়ে জগতের যাবতীয় জাগতিক সুখ কিনে নিয়ে ওরা উদাসীন সুখী মানুষের দল। তাই মনে হয় ওরা কথা এত কম বলে। কথা না বলতে বলতে কথার চাষ ওরা ভুলে গেছে! শুধু একটু খানি ঠোঁট ফাঁক করে” হাই বা হ্যালো…,” খুব বেশি হলে “হ্যাভ এ নাইস ডে,” বা “হ্যাভ আ গুড ওয়ান…” বলে কেমন যেন এড়িয়ে চলে যায়!..
জানি না আমরা অহেতুক বেশি কথা বলি কিনা এই সাউথ এশিয়ার মানুষজনরা! বাঙালিরা তো একটু বেশিই কথা বলি। আড্ডাবাজ নামই
জুটে গেছে আমাদের। প্রাত্যহিক জীবনে একটু আত্মকেন্দ্রীক, একটু নিজের মধ্যে নিজে থাকতে পারলে হয়তো একটা অন্য আনন্দ উপভোগ করা যায়। সেটা দার্শনিক হতে পারে, স্পিরিচুয়াল হতে পারে, বা ক্রিয়েটিভ আনন্দও হতে পারে। আসলে তার জন্য যে জীবন দরকার, সেই কোয়ালিটি লাইফ তো আমাদের সকলের নেই। জীবনযাপনটাই এত উদ্বেগ ও সংঘর্ষময় যে কেউ একটু বেশি চুপ করে থাকলে বলি, “কি রে মন খারাপ নাকি? চুপ করে আছিস যে। কি চিন্তা করছিস!..”
মেরিল্যান্ড ওশান সিটির দিকে সুন্দর এগিয়ে চলেছি। আবহাওয়াও একদম দিলদরিয়া। আকাশ বাতাস হাসছে। মাঝে এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। কিন্তু সে বৃষ্টি উপভোগের। যাকে বলে একদম “রিমঝিম গিরে শাওন, সুলগ সুলগ যায়ে মন…”
মেরিল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা অঙ্গরাজ্য।প্রথম যে তেরোটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, মেরিল্যান্ড ছিল তাদেরই অন্যতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য আটলান্টিক অঞ্চলের মধ্যে মেরিল্যান্ড অবস্থিত। মেরিল্যান্ডের রাজধানী -ANNAPOLIS।
মেরিল্যান্ড নামটি হয়েছে গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের রাজা চার্লস এর স্ত্রীর নাম থেকে। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল রাণী হেনরিয়েটা মারিয়া। ১৬৩২ সালে সেই রাণীর নামে নামাঙ্কিত হয়েছিল এই উপনিবেশ রাজ্য “মেরিল্যান্ড”। এই রাজ্যের প্রধান শহর বল্টিমোর। আমরা বল্টিমোর থেকেই গতকাল ঘুরে এসেছি ওয়াশিংটন ডিসি। আজ চলেছি মেরিল্যান্ড-ওশান সিটির পথে। আমেরিকার বৈচিত্র্যময় সেরা রাজ্যের মধ্যে মেরিল্যান্ড একটি। মেরিল্যান্ডের পূর্বে ডেলাওয়্যার ও আটলান্টিক মহাসাগর, পশ্চিমে পশ্চিম ভার্জিনিয়া, উত্তরে পেনসিলভানিয়া,আর দক্ষিণে আটলান্টিক মহাসাগর ও ভার্জিনিয়া।
মেরিল্যান্ডের জনসংখ্যা কমবেশি মাত্র সাত লাখ। অথচ কি বিশাল তার আয়তন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। তাই এরা সব ধনীর দেশের রাজপুত্র রাজকন্যাদের মত বেঁচে থেকে জীবনকে উপভোগ করে। গান গায়, “Life is a wonderful gift…We celebrate whole life…”
আমরা তৃতীয় বিশ্বের অলি গলিতে বসে বড় বড় চোখ করে ওদের দেখি- আর গুণ গুন করি,
“মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, ইয়ে পাতলুন হিন্দুস্তানি, সর পে লাল টোপি… ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি!” এই সব গেয়ে হেসে দিব্যি কাটিয়ে দিই একটা জীবন!..
হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে এপথে হঠাৎ হঠাৎ পথের ধারে FARMERS’ MARKET চোখে পড়ল। কিন্তু সেগুলো সবই রাস্তার ওপারে। হাইওয়েগুলো চার লেন, ছয় লেন হয়। ডিভাইডার থাকে বহু দূরে দূরে। তাই চট করে গাড়ি থামিয়ে যেতে পারলাম না। সোহমকে বললাম, “খেয়াল রেখো। এপারে চোখে পড়লে গাড়িটাকে একটু দাঁড় করিও। ফার্মাস মার্কেট কেমন দেখব।”
আমাদের গাড়ি যত এগিয়ে চলেছে রাস্তার দু’পারের কান্ট্রিসাইডের দৃশ্য দেখছি, আর মনে মনে বলছি, বাহ্! কি সুন্দর নিরালা নির্জন সব জনপদ। আবার প্রয়োজনীয় সাপোর্টসিস্টেমগুলোও মাঝে মাঝে আছে দেখতে পাচ্ছি। ব্যাঙ্ক, হসপিটাল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, পেট্রোল পাম্প, বড় হোটেল সবই আছে এপথে। কাঙ্ক্ষিত নির্জনতা ও প্রশান্তির সাথে এসবও পাওয়া খুব দরকার। সেই কারণেই মনে হয়, মেরিল্যান্ড এত জনপ্রিয় আমেরিকানদের কাছে। বিশেষ করে কাছের তিন বড় শহরের মানুষজনরা মেরিল্যান্ডকে মনে করে সেকেন্ড হোম। কাছের তিন বড় শহর হলো- ওয়াশিংটন ডিসি, ফিলাডেলফিয়া ও নিউইয়র্ক।
সোহমের চোখে পড়ে গেছে এপারের এক ফার্মাস মার্কেট। গাড়ির গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে আমরা চলে গেলাম ফার্মাস মার্কেটের কাছে। তবে এটা একশো ভাগ ফার্মাস মার্কেট নয়। একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। তার একটা অংশ নিয়ে ফার্মাস মার্কেট। তাই দেখলাম সব কিছু কিন্তু মন ভরলো না। আমি ভেবেছিলাম আমেরিকান চাষীদের সাথে সরাসরি একটু কথা বলতে পারব। হাতে তুলে ওদের চাষ করে ফলানো জিনিসগুলো দেখব। নতুন অভিজ্ঞতার আনন্দ নেব। সেটা হলো না। টাটকা জিনিসগুলো দেখলাম। ভুট্টা, টমেটো, আলু, পেঁয়াজ, বড় বড় লংকা, বেগুন, ব্রোকোলি সবই সাজিয়ে রাখা রয়েছে। পাশে দামও লেখা ডলারে। সুতরাং আমি মনে মনে কনভার্ট করে যখন ভাবছি, ভেবে শিউরে উঠছি, বাবারে একটা পুচকে বেগুন ৮৩ টাকা!..ওদের কাছে এক ডলার কিছুই নয়!..ওরা তো ডলার করে আয়, ডলার দিয়ে খায়!..
ওশান সিটি -মেরিল্যান্ডে অনেক কিছু দেখার আছে। কিন্তু সব তো আর একদিনে দেখা সম্ভব নয়। বাছাই করা কয়েকটা জিনিস দেখব আমরা। তাই প্রথমেই চলে গেলাম ASSATEAGUE STATE PARK দেখতে। আমেরিকায় সর্বত্র স্টেট পার্ক রয়েছে। ওরা শহরের মধ্যে সুন্দর সুন্দর পার্ক তৈরী করে রেখেছে। ওদের এই পার্ক কালচার বা পার্ক প্রীতির প্রশংসা করতেই হয়।
আমাদের গাড়ি পার্কিং এ রেখে Assateague Island Visitor Center এ গেলাম। এখানে নাম এন্ট্রি করে টিকিট নিতে হলো। ভিজিটর সেন্টারে একটি মিউজিয়াম রয়েছে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এই ভিজিটর সেন্টার। কাঠদিয়ে বানানো পায়ে চলার এক লম্বা পথ BOARDWALK রয়েছে সমুদ্র দর্শনের জন্য। পথের দু’পাশে ম্যানগ্রোভ জাতীয় ছোট ছোট ঝাঁকড়া অনেক গাছ দেখলাম। আমরা সমুদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আটলান্টিক মহাসাগরের বাতাস বুক ভরে নিলাম। বড় অপূর্ব লাগছিল আটলান্টিকের জল। কোনও ভাবেই তুলনা করা যায় না, কিন্তু নিজের দেশের কথাও খুব মনে পড়ে যায়। আমাদের সুন্দরবনে গেলে কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে ঠিক এমন অনুভূতি হয় বঙ্গোপসাগরকে দেখে। দুটোই তো মহাসাগর। আমি সৌভাগ্যবান মুসাফির, এই সব মহাসাগরের কাছে এসে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবতে পারছি। আমাদের সুন্দরবনও তো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা নিয়ে বিশ্বখ্যাত এক পর্যটনকেন্দ্র।
ভিজিটর সেন্টারের মিউজিয়ামটা ছোট্ট, কিন্তু সুন্দর। এক ঝলক দেখে নিতে ভালো লাগল। এখানে কিছু লিফলেট পেলাম যেগুলো ইনফরমেশন হিসেবে খুব কাজে লাগল।
এবার আমরা গাড়ি নিয়ে চললাম অ্যাসাটিগ স্টেট পার্কের ভেতরে। সমুদ্র তীরবর্তী বলে এখানে অনেক লম্বা লম্বা ঝাউ গাছ দেখলাম। সমুদ্রের বাতাসে ঝাউগাছগুলো দুলছে। চোখের সামনে এক বিস্তৃত তৃণভূমি ও বিশাল জলাশয়। কি অপূর্ব লাগছিল দেখতে। আমি কেনিয়া বা তানজানিয়া যাই নি, কিন্তু ছবিতে দেখা সেই সব জায়গার সাথে খুব মিল পাচ্ছিলাম এখানে এসে। অ্যাসাটিগ বিখ্যাত এখানকার ‘বুনো ঘোড়াদের’ জন্য । সেই সব ঘোড়াদের আপনমনে ঘাস খেতে দেখলাম। এই ঘোড়াদের কেউ বিরক্ত করলে, বা কিছু খেতে দিলে সেটা দন্ডনীয় অপরাধ। পানিশমেন্ট পেতেই হবে। তাই দূর থেকে দেখো, ছবি তোলো।
অ্যাসাটিগ স্টেট পার্কে অনেকগুলো TRAIL ROUTE আছে। যেমন Marsh Nature Trail, Forest Nature Trail, Dunes Nature Trail। এই ট্রেইলগুলো করতে পারলে একশোভাগ আনন্দ উপভোগ করা যায়। সব কটা ট্রেইলই লোভনীয় এবং রোমাঞ্চকর।
আমরা Old Ferry Landing এ দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় চারপাশের দৃশ্য দেখলাম। চোখ- মন জুড়িয়ে গেল। দেখলাম আমেরিকান বহু পর্যটক সপরিবারে এই ট্রেইলগুলোতে চলে গেল। ওরা সব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। গাড়ি ভর্তি নিজস্ব ইকুইপমেন্ট ও পোষাক। ওদের গাড়িতে রয়েছে নিজস্ব বোটও। সেগুলো অ্যাসেম্বল করে বানিয়ে নিয়ে সুন্দর ভেসে চলে যাচ্ছে জলযাত্রায় বহুদূরে। সত্যিকারের রোমাঞ্চ উদযাপন ওরা করতে জানে। এবং সপরিবারে করে। আমরা ফেরিতে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখলাম আর দেখলাম মজার জিনিস ফিশিং। বড়শি ফেলে মাছ ধরছে অনেক পর্যটক। মাছ কি পাওয়া যায় জানতে পারলাম না। দেখলাম বাচ্চারাও বড়শি ফেলে মাছ ধরার আনন্দে মেতে আছে। এখানকার বিখ্যাত নাকি নীল কাঁকড়া!
Old Ferry Landing এ সময় কাটাতে বেশ লাগে। একদম ৩৬০ ডিগ্রি- দৃষ্টি বহুদূরে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। এদেখায় বড় তৃপ্তি। আজকের দিনটা ছিল রোদ ঝলমল। কিন্তু গরম লাগছে না। অনকেটা সময় এখানে কাটিয়ে এবার আমরা চলে গেলাম National Seashore Entrance Station এ। গাড়ি পার্কিং এ রেখে বালিয়াড়ি দিয়ে সমুদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানে সমুদ্র মানেই তো আটলান্টিক মহাসাগর। অগাধ জলরাশি। এক একটা দুরন্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতে। বহু পর্যটক সমুদ্র স্নানে মেতে ঢেউয়ের তালে তালে নাচছে, ডুব দিয়ে স্নান করছে। ডুলুং সোহম পা ভিজেয়ে মজা করতে গেল। আমি সৈকতে দাঁড়িয়ে আটলান্টিকের সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে উপভোগ করলাম। এই সৈকতে আমেরিকান পরিবারগুলো সানবাথ নিচ্ছে। কেউ কেউ মগ্ন হয়ে বই পড়ছে। কেউ কেউ রঙিন ছাতার তলায় বসে সমুদ্রের সাথে একান্তে কথা বলছে।
এই সিশোর দেখে এবার আমরা Assateague Island থেকে বেরিয়ে এলাম। এই আইল্যান্ডে চাইলে টেন্ট ফেলে রাত্রিযাপনও করা যায়। ফিশিং, সুইমিং করা যায়। বারবিকিউর আনন্দ উদযাপন করা যায়। সেজন্য বিশেষ অনুমতি লাগে।
অ্যাসাটিগ আইল্যান্ড খুব ভালো লেগেছে। এমন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেভরা সমুদ্রঘেরা দ্বীপে আসতে পেরে বড় আনন্দ পেলাম। তাই মন খুশির মেজাজে আরও এক নতুন জায়গায় এগিয়ে চললাম। এর নাম -America’s Coolest Small Town BERLIN।
বার্লিন শুনলেই মনে হয় এখানে বার্লিন!.. হ্যাঁ এ হলো আমেরিকার বার্লিন! আমি আমেরিকার যে কটা জায়গায় ঘুরলাম ইতিমধ্যে এমন ইউরোপীয় নাম অনেকগুলো পেয়েছি। যেমন সিরাকিউজ যাওয়ার সময় পেয়েছি রোম, আমস্টারডাম। বস্টনে পেয়েছি CAMMBRIDGE STREET। আমেরিকাতে তো বিশ্বমানুষের বসতি, তাই ইউরোপীয় বা আরও অন্য দেশের লোকজন এখানে এসে তাঁদের মত করে শহরের নামগুলো করে নিয়েছিলেন। তাই এমন অনেক শহরে নামের আগে শুধু নিউ বসিয়ে দিয়েছে যেমন নিউইয়র্ক, নিউ অরলিন্স। নিউ ইংল্যান্ড।
বার্লিন শহর অ্যাসাটিগ থেকে সামান্য পথ। বড় অপূর্ব রাস্তাঘাট। মন ভালো হয়ে যায়। হুশ করে চলে এলাম বার্লিন। শহরের চিলন্ড্রেন্স পার্কের কাছে ফ্রি পার্কিং পেয়ে গাড়ি রাখতে সুবিধা হলো। এক মুঠো শহরটা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। মনে হচ্ছিল এত পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, এত শান্ত জীবন, এত নির্জনতা যে শহরে থাকে তার নামই তো হওয়া উচিত- America’s Coolest Small Town।
এই ছোট্ট শহরটায় বাড়িঘর, চার্চ, স্কুল, পার্ক, সুন্দর সুন্দর রেস্টুরেন্ট, হোটেল, শপিং করার বাহারি দোকান আছে। প্রত্যেক বাড়ি সংলগ্ন বাগানে রং বেরংয়ের কত ফুল। সাদা, লাল, গোলাপি এই তিন রংয়ের ফুরুশ খুব চোখে পড়ল পথে ও বাড়ির বাগানগুলোতে। এই বার্লিনের বাড়িগুলোতে ইউরোপীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখা যায়। ডুলুং সোহম একটা ফুলের দোকানে ঢুকে কিনল দুটো ইন্ডোর প্ল্যান্ট Fittonia, Venus- Fly Trap।
বার্লিনের পথের ধারে ওদের রাজনৈতিক সমর্থন এর একটা করে প্ল্যাকার্ড লাগানো দেখে বেশ মজা লেগেছে। আমেরিকার শহরে রাস্তায় ও দেওয়ালে রাজনৈতিক কোনও পোস্টার বা ফেস্টুন, ব্যানার এসব চোখে পড়ে নি। চোখে পড়েছে মাটিতে গাঁথা এরকম ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড- RE- ELECT- ORRIS, Town Council District -2। সারা পাড়ায় হয়তো এই একটাই প্ল্যাকার্ড।
বার্লিন থেকে এবার চলে এলাম আমাদের আজকের শেষ স্পট- ওশান সিটি। আসার সময় আটলান্টিকের ওপর এক মস্ত সেতু পেরোলাম। সেতুর তলা দিয়ে বড় বড় জাহাজ যাচ্ছে। বন্দরে অনেক লঞ্চ। তীরে ছোট বড় অনেক হোটেল। খুব জমজমাট ওশান সিটি। আমরা গাড়ি মিউনিসিপ্যাল পার্কিং এ রেখে চলে গেলাম সৈকতে। এখানে পার্কিং লটে নিজেরা কার্ড পাঞ্চ করে পেমেন্ট করো। গাড়ি রাখো। সময় হলে নিয়ে যাও। কেউ দেখার, বলার নেই!…
সৈকতে গিয়ে মানুষের ভিড় দেখে অবাক হয়ে গেলাম। লাল নীল হলুদ সবুজ কালো সাদা রকমের কত মানুষ! পায়ে হেঁটে চলার একটা সুন্দর রাস্তা আছে BOARDWALK । সে রাস্তা দিয়ে আবার ট্রলি করে পর্যটকরাও বেড়াচ্ছে। হৈ হৈ আনন্দে সবাই মেতে। যেন এক কার্নিভ্যাল চলছে।
দূরে আটলান্টিকের জলে সমুদ্রস্নান করছে বহু মানুষ। ছোট বড় ঢেউ এর সাথে ওরা কেমন খেলা করছে। ডুব দিয়ে ভেসে উঠছে। সান বাথ নিচ্ছে কিছু মানুষ। ওদের সান বাথ মানে আমাদের চোখে একটু যেন বেমানান লাগে। প্রকাশ্যে এমন করে শুয়ে বসে থাকা আমাদের সমাজে খুব স্বস্তিদায়ক দৃশ্য নয়। কিন্তু ওদের যাপনে এটা ভীষণ স্বাভাবিক রৌদ্রস্নানের আনন্দমুহূর্ত। এদেশে এসে এসব দেখতে দেখতে একসময় চোখ ও মন অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আজ আমাদের লেট লাঞ্চ। সময় মত খাওয়া হয় নি। এবার খেলাম। চটজলদি Subway থেকে কিনে Chicken Wrap। এই রোল জাতীয় খাবারটা পেট ভরানোর জন্য খুব ভালো। খাওয়া শেষ করে সৈকতে বসে আটলান্টিকের জলরাশি দেখছি, মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখছি। আমাদের দেশের সৈকত শহরগুলোতেও মানুষের এমন উপচে পড়া ভিড় ও খাবার দোকানগুলোতে ভিড়ের চেহারা প্রায় এক।
আমার সমুদ্র কোনদিনও একনাগাড়ে বেশিক্ষণ দেখতে ভালো লাগে না। একটু একঘেয়ে লাগে। আর সৈকতের ভিড় তো একদম পারি না নিতে। খুব নির্জন সৈকত ভালোবাসি। গতবছর আমাদের ঘরের কাছের পুরুষোত্তমপুরে গিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত নির্জনতা ও বঙ্গোপসাগরের ঢেউ দেখে ভালো লেগেছিল।
ডুলুং সোহম হাঁটছে। আমি একজায়গায় চুপ করে বসলাম। সামনে অনন্ত জলরাশি। আটলান্টিকের জলোচ্ছ্বাস। নিজের মনে বসে আটলান্টিকের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার প্রিয় একটা গান মনের দোতারায় গুন গুনিয়ে এলো- “আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো…আমি শুনেছি তোমরা নাকি এখনো স্বপ্ন দেখো, এখনো গল্প লেখো, গান গাও প্রাণ ভরে…” কতদিন আগে শোনা মৌসুমী ভৌমিকের এ গান আজ হঠাৎ প্রাণে বেজে উঠল । সত্যিই তো আমার এই জীবনে আমিও তো এখনো গল্প লিখি, গান গাই, গান শুনি… আর ভালোবাসি এমন করে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে। বিশ্বভুবনটাকে দেখতে, নীল জল দিগন্ত ছুঁতে..। আর “নিজের জন্যে বাঁচা নিজেকে নিয়ে…” হ্যাঁ, জীবন কখনো কখনো এমন পর্যায়ে হঠাৎ চলে যায়! সাজানো গোছানো জীবন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।তবু চেষ্টা করেছি “অন্যর জন্যও” বাঁচতে!.. “অন্যভুবন” গড়েছি। অন্য ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে চলেছি।…
বড় একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল সৈকতে। আটলান্টিক হাসছে। বেলাশেষের আলোয় আটলান্টিকের জলকে বড় মায়াবী লাগছে। একটু পর বল্টিমোরে ফিরে যাব। বল্টিমোরে অদ্য শেষ রজনী!..
আগামীকাল চলে যাব ভোরের আলোয় বল্টিমোর এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে বিমান ধরব। চলে যাব শার্লট, নর্থ ক্যারোলাইনা। তারপর আবার সেখান থেকে সড়কপথে সাউথ ক্যারোলাইনার কলম্বিয়ায়। ওখানে ডুলুং এর ইউনিভার্সিটি। সেই শহরে কাটবে কটা দিন-রজনী!..থাকব ওর নতুন অ্যাপার্টমেন্টে। কটা দিন একটু বিশ্রাম নেওয়া হবে। শহরটাও ঘুরে ঘুরে দেখব। তারপর আবার শুরু হবে সেকেন্ড রাউন্ড ভ্রমণ। যাব ইন্ডিয়ানাপোলিস ও শিকাগো।
থার্ড রাউন্ডও আছে!..
নিউ অরলিন্স, মায়ামী, সাভানা, চার্লসটন!..এ হবে আমার একলা ভ্রমণ।
আমেরিকায় এসেছি আজ ১২ দিন হয়ে গেল!..
এখনো এক মাস থাকব এই মহাদেশে।…
শুভসন্ধ্যা। ওশানসিটি। মেরিল্যান্ড।
পড়ছি। চলুক। অপেক্ষা ।