ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ৮

।। জাপানের ডায়েরি ।।
আইচি সমুদ্র সৈকতের গা ঘেঁষেই ইরাগো রিসর্ট। কাল সন্ধেয় এখানে পৌঁছেই ভালো লেগে গিয়েছিল। রিসর্টের রিসেপশন থেকে ঘরের চাবির সঙ্গে জাপানিদের নিজস্ব রাত- পোষাক কিমোনো পেলাম। তিন পার্টের এই পোষাকটি বেশ সুন্দর। মজা করে পড়েও নিলাম। ডিনারে ডাইনিং হলে গিয়ে দেখি অনেকেই পড়ে এসেছেন।
আমাদের ঘরটা ছিল একদম সমুদ্রমুখী। এই ঘর- বারান্দা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের সৌন্দর্য খুব উপভোগ করেছি। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে গল্প করে মহাসাগরের অন্ধকারের রূপ-ঐশ্বর্য দেখেছি।
আজ ঘুম থেকে উঠে আবার সেই সমুূদ্রের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম, প্রতিটা দিন নতুন নতুন কত কিছু দেখছি, জানছি। স্মৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই যেন মনের অতলে আছড়ে আছড়ে এসে পড়ছে বিদেশ ভ্রমণের কত অভিজ্ঞতা, কত অজানাকে দেখার আনন্দ, কত জানার মধুর স্মৃতি।
আজ সকাল সকাল বেরনোর অত তাড়া নেই। তাই একটু আয়েশ করে ধীরে সুস্থে ব্রেকফাস্ট করলাম সকলে। ডাইনিং হলে বিশাল আয়োজন ছিল। বুফে ব্রেকফাস্ট। কতরকম খাবারের অপশন। নিজের পছন্দের খাবার খুঁজে খেয়ে নিলাম।
ইগারো রিসর্টের রিসেপশনে দেখলাম সাইকেল রাখা রয়েছে। ঘন্টা প্রতি ভাড়া দিয়ে আইচি সৈকতের আশপাশে ঘুরে আসা যায়। দারুণ সুন্দর সাইক্লিং করার জায়গা এটা। আমার তো খুব লোভ হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই। সাইট সিয়িং এ একটু পরেই চলে যেতে হবে। তাই সাইকেলটাকে একবার ছুঁয়ে দেখলাম। পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুললাম। এগুলো নিছকই সখ মেটানো।
আমাদের বাস চলে এলো রিসর্টের লবিতে। এবার বেরিয়ে পড়া। এবেলা আইচির চারপাশ ঘুরব। প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জল, আর বালুতটে অসংখ্য ঢেউ আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম আজকের প্রথম স্পট – স্ট্রবেরি ফার্ম হাউসগুলোর দিকে।
এই পথটা বড় অপূর্ব। চারপাশে কৃষিজমি। ফসলের রাশি রাশি হাসি নিয়ে খেতখামারগুলো ঝলমল করছে। বাঁধাকপি প্রচুর হয়ে আছে। টম্যাটো, ব্রোকলি, লংকা চোখে পড়ল। বুঝলাম জায়গাটা একদম আদর্শ কৃষিকর্মের জন্য। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম স্ট্রবেরি ফার্মের কাছে। আমাদের গাইড কাওয়াসাকি আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তাই আমরা বাস থেকে নামামাত্রই একজন জাপানি তরুণী এগিয়ে এসে ওয়েলকাম করে নিয়ে গেলেন ফার্মের কাছে। সাদা প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোয় লতানো স্ট্রবেরি গাছে টকটকে লাল সুন্দর সুন্দর স্ট্রবেরি ভর্তি হয়ে রয়েছে। সেই তরুণী আমাদের প্রত্যেকের হাতে কাগজের প্লেট দিয়ে বললেন, আমরা যত খুশি তুলে খেতে পারি। কিন্তু নিয়ে যেতে পারব না এবং যেন নষ্ট না করি। কাগজের প্লেটে আবার মিল্ক মেড দেওয়া ছিল। ফলে টাটকা রসালো স্ট্রবেরিগুলো তুলছি আর মিল্ক মেড মাখিয়ে খাচ্ছি। বড় বড় গোটা চারেক স্ট্রবেরি খেয়ে নিলাম মনের আনন্দে। তারপর কে যেন বলল, “বেশি খেয়ো না। স্টমাক আপসেট হতে পারে!..”
এমন সতর্কবাণী শোনার পর ব্যাক গিয়ার দিলাম। না আর নয়। কিন্তু লোভ তখনও ছিল! স্ট্রবেরি ফার্মে ভিজিট করার অভিজ্ঞতা এর আগে আমার একবার হয়েছিল, মহাবালেশ্বরে। সেবার পরিবার ছিল সঙ্গে। মেয়ে তখন অনেক ছোট। বাপ-বেটিতে মজা করে খেয়েও ছিলাম। কিন্তু আজকের এই স্ট্রবেরিগুলো গুণমানে অনেক বেশি ভালো।
স্বল্প সময়ের এই Strawberry farm visit and getting the opportunity to pick and eat strawberry এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। আমাদের এই ২৬ জনের দলে প্রায় সবাই সিনিয়র সিটিজেন। কিন্তু স্ট্রবেরি ফার্মে মজা করার সময় ভীষণ ছেলেমানুষী আনন্দে সবাই মেতে উঠেছিলাম। ভ্রমণ এই অনাস্বাদিত, অপ্রত্যাশিত আনন্দগুলো বারেবার উপহার দেয়!..
এবার আমরা যাব আজকের দ্বিতীয় স্পট দেখতে। গাড়ি গড়াতে শুরু করল। যাচ্ছি শিজুওকার বিখ্যাত রেপসিড ফুলের বাগান দেখতে। স্ট্রবেরি ফার্ম থেকে বেশি দূরে নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম রেপসিড বাগানে। যাওয়ার পথটা একদম গ্রামীণ নির্জনতা ও নিসর্গে অপরূপ হয়ে ছিল। পথের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে লম্বা সৈকত- নীল জলের প্যাসিফিক ওশান। রেপসিড বাগানে পৌঁছে সত্যিই চোখে সর্ষেফুল দেখেছিলাম! যদিও রেপসিড ও সর্ষে ফুলের মধ্যে তফাত আছে। এই হলুদ ফুলের রেপসিড বাগান দেখে চোখ মন জুড়িয়ে যাবেই। অনেকটা জায়গা জুড়ে হলুদ ফুলের বাগান। তার পেছনে প্রশান্ত মহাসাগর। সামনে বৃত্তাকারে সবুজ পাহাড়। আর মাথার ওপর আকাশও কি সুন্দর নীল! আমরা বাস থেকে নেমেই যে যার মত হারিয়ে গেলাম হলুদ বাগানে। ছবি তোলার এক দারুণ পটভূমি। এই বাগানের রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে হলুদ চিঠি ফেলার একটা বাক্সও দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে। জাপানের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয় এমন সাজানো সুন্দর চিঠির বাক্স রাখা থাকে। এর আগে প্রথম দেখলাম কিওটোতে। তারপর দেখলাম মিয়াজিমায়, এরপর পার্ল আইল্যান্ডে। এখন দেখলাম শিজুওকার এই রেপসিড বাগানে।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এখানে Rapeseed Blossom Festival হয়। সে নাকি দারুণ রঙিন উৎসব। পর্যটকের ঢল নামে। রেপসিড বাগানের মধ্যে দিয়েই পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম সৈকতে। প্যাসিফিক ওশান তখন নীল জলে ডুবে আছে। রোদ ঝলমলে দিন। তাই সাগর পারে দাঁড়িয়ে এক অন্যরকম আনন্দে মন মেতে উঠেছিল। এই রেপসিড বাগান দেখা সত্যিকারের একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির আপন হাতে সাজানো এই বাগান, এর চারপাশের নিসর্গ, সমুদ্র, পাহাড়, নীল আকাশ সব নিয়ে মন হারানোর মায়াবন শিজুওকার এই হলুদ ফুলের বাগান।
একবেলার ভ্রমণ শেষ করে এবার আমরা এগিয়ে চললাম এক মিউজিয়াম দেখতে। অভিনব মিউজিয়াম। এমন মিউজিয়াম আগে কখনো দেখি নি। পথে খানিক বিরতি নিয়ে নিজেদের পয়সায় লাঞ্চ করলাম। আজ সেটাই ছিল কথা। এই প্যাকেজ ট্যুরে আমাদের তিনটে লাঞ্চ নিজেদের ইয়েন ভাঙিয়ে খেতে হয়েছে। জাপানের সস্তা বা মধ্যবিত্ত বাজাটের দোকান হলো “7Eleven”এখানে চা, কফি, কেক, বার্গার তুলনামূলক একটু দাম কম। Family Mart ও আছে জাপানে, কম বাজেটের দোকান। আমেরিকায়ও এমন কয়েকটা সস্তার দোকান দেখেছিলাম -Mc Donald’s, Burger King, Dunkin Donuts, Panda, Subway, Wendy’s। আমার চল্লিশ দিন আমেরিকা ভ্রমণে এই সব দোকানগুলো খুঁজে বের করে নিজের বাজেট অনুযায়ী খাবার খেয়ে পেট ভরিয়েছি।
আমরা যাচ্ছি এখন Suzuki Museum দেখতে।
জাপানের বিখ্যাত গাড়ি তৈরীর কারখানার মিউজিয়াম। সুজুকির সঙ্গে আমাদের মারুতির গাঁটছড়া বেঁধে ছোট গাড়ি একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তখন ছোটগাড়ি বলতেই আমরা বুঝতাম মারুতি- সুজুকির গাড়ি। এই মিউজিয়ামটা দেখে বেশ আশ্চর্য হয়েছি। সুজুকির গাড়ির ইতিহাস, তার বিবর্তন ও সুজুকির কত রকম গাড়ির মডেল সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা রয়েছে। ভীষণ অত্যাধুনিক এক শোরুমের মত এই মিউজিয়াম। ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালোই লাগে। আমার নিজের গাড়ি হলো গিয়ে Wagoner. সুজুকি কোম্পানির গাড়ি। এই গাড়ির প্রথম মডেল থেকে আজকের নতুন মডেলও সাজানো আছে দেখে বেশ লাগল। তার ওপর এক একটা এমন আশ্চর্য নতুন ছোট গাড়ির মডেল দেখলাম, যেগুলো আমাদের দেশে দেখি নি। গাড়ি দেখার কারখানা ও মিউজিয়াম বেড়ানোর মধ্যেও একটু বৈচিত্র্য আছে। বিচিত্র এই পৃথিবী। তার বৈচিত্র্যও হরেকরকম। মুসাফির মন নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ালে দেখা ও জানার জগৎ বিস্তারিত হয়।
আজকের শেষ ভ্রমণে ছিল- একটি পাতা দুটি কুড়ির সবুজ বাগানে! জাপানের চা গ্রামে বেড়ানো। পথের ধারেই এই চা বাগান ও চা গ্রাম। আমাদের দেশের অনেক সুন্দর সুন্দর চা বাগানের কাছে এটা হয়তো কিছুই নয়। জাপানীরা চা নিজের দেশে তেমন ভাবে উৎপাদন করতে পারে নি। শ্রীলংকার চা দেখেছি জাপানে খুব বিক্রি হয়। এই চা বাগানের লাগোয়া একটা ছোট্ট চা মিউজিয়াম ও চা বিক্রির দোকান রয়েছে। বাগান বেড়ানো শেষ করে ছোট্ট কারখানা- মিউজিয়ামটাও দেখে নিলাম। তারপর চা কাউন্টারে ঢুকে হরেক রকম চা দেখলাম। খাতির করে বিনা পয়সায় গ্রিন টিও টেস্ট করাচ্ছেন সকলকে। আমিও খেলাম। অনেকেই চা কিনলেন। চা চকলেটও পাওয়া যাচ্ছিল। চা আইসক্রিম। বেশ মজার। বিকেলটা এখানেই কেটে গেল। দিনশেষে সূর্য অস্ত যাচ্ছে দেখলাম চা বাগানের শেষ প্রান্তে। কমলা রঙের নরম আলোয় সবুজ চা বাগানটাকে তখন বেশ লাগছিল। প্রতিদিনই সূর্যাস্ত দেখছি। ভ্রমণও শেষ হয়ে আসে এই সময়। শরীর ক্লান্ত থাকে।
এবার সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। ঠান্ডা বাতাস বইছে। মনে হচ্ছিল কাছাকাছি কোথাও বুঝি বৃষ্টি হয়েছে। আজকের মত ভ্রমণ শেষ। এবার ফিরে চলো রাত ঠিকানায়। আজ থাকব সিজুওকা শহরে। শিজুওকা শহর থেকে অল্পদূরেই জাপানের বিখ্যাত মাউন্ট ফুজি ও লেক আশি।
গাড়ি ছুটছে। সারাদিনের পথশ্রমে সকলেই কম বেশি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। আজও ক্লান্ত শরীরে বাইরে ডিনার করে হোটেলে ফেরা। সব ভ্রমণেই ক্লান্তির সঙ্গে একটা আড়ি-ভাব লুকোচুরি খেলা থাকে। আর তা থাকে বলেই ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে ক্লান্তি শেষ পর্যন্ত তাঁকে ক্লান্ত করতে পারে না। জিতে যায় ভ্রমণ। পরের দিন আবার থাকে নতুন পথে পথ হারানোর আনন্দ!..
আগামীকাল লেক আশি, কোমাগাতেকে রোপওয়ে ও মাউন্ট ফুজি দেখার আনন্দে ডিনার শেষ করে Toyoko Inn Fujisan Mishimaeki হোটেলের লিফ্টে উঠে সাত তলার নিজের রুমটার দিকে এগিয়ে চললাম!…
ক্রমশ…