বাবার সাথে ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে তপু হঠাৎ দেখল একটা পাখি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ফুলে ভরা অ্যালামন্ডা গাছের বড় টবটার সামনে। তপু চিৎকার করে বলল,” বাবু, বাবু, দেখো একটা পাখি আমাদের ছাদে কেমন পড়ে আছে। ভয়ে চোখ পিটপিট করছে!”
বাবা বিছানার বড় চাদরটা সবে রোদে শুকনোর দড়ির ওপর রেখেছে, তপুর চিৎকার শুনে ছুটে যায় পাখিটার কাছে। বাবা দেখেই চিনে ফেলে এটা একটা ঘুঘু পাখি। ডানায় চোট পেয়ে ছাদে পড়ে আছে। উড়তে পারছে না। পাখিটার প্রাণ আছে। চোখদুটো কান্না ভেজা!
-“তপু পাখিটার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। ওর ডানাটা মনে হয় চোট পেয়েছে।”
-“চোট কি বাবা!”
-“ব্যথা পেয়েছে রে। তাই উড়তে পারছে না।”
-” কি করে ও ব্যথা পেল বাবু?”
-” সেটাই তো ভাবছি রে!”
-“কেউ কি ওকে মেরেছে?”
-” বুঝতে পারছি না তো!…”
-” বাবু, ওকে ঘরে নিয়ে যাবে? একটু ওষুধ দাও না।” তপু আবদার করে বাবার পিঠে হাত রাখে।
-” ঠিক আছে। চল নিচে নিয়ে যাই। তুই মাকে বল বারান্দায় ওর জন্য একটা ব্যবস্থা করতে।”
তপু দৌড়ে চলে গেল মাকে জানাতে। মা তখন গল্পের বই পড়ছিল। লীলা মজুমদারের একটা বই। মা শুনেই তো অবাক হয়ে বলল,” সে কি! ডানাভাঙা ঘুঘু পাখি! ঈশ্! নিয়ে আয়, নিয়ে আয়!”…
পাখিটাকে মা-বাবা মিলে অনেক যত্ন করে জল, দানা খাইয়ে একটু সুস্থ করে তুলল। ঘুঘু পাখিটা এখন চোখ পিটপিট করে তপুকে দেখছে। মাঝে মাঝে কি সুন্দর ডাকছে। তপুর ভারী মজা হয়। পাখিটার দুটো ছবিও বাবা তুলল। মা বলল,”যারা পাখি পোষে তাদের কাউকে দিয়ে দিতে পারলে ওরা ওকে একদম সুস্থ করে তুলবে।”
” কেন দেবে?” মুখভার করে তপু বলল,” আমরা পুষব। পাখিটা কি সুন্দর দেখতে। ও আমার বন্ধু হবে!”…
“ওরে বাবা,পাখি পোষা অনেক ঝামেলার।” বাবা কেমন করে যেন বলল,” বাড়িতে পাখি রাখলে পুলিশ আমাদের বকতে চলে আসবে!”
“কেন পুলিশ বকবে?” তপু বিশ্বাস করতে চায় না বাবার কথা।
মা বাবুকে বলল,” তুমি বরং ফেসবুকে একটা পোস্ট দাও। বার্ড লাভার্স যদি কেউ থাকে, তাহলে অসুস্থ পাখিটাকে এসে নিযে যাক।”
“গুড আইডিয়া।” বাবু হেসে বলল,” ঠিক বলেছো।”
তারপর সত্যি সত্যিই মা- বাবা দুজনে মিলে পাখিটার ছবি দিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট করে বলল,” তপু, পড়ে দেখ কি লিখেছি।”
তপু ফেসবুক কি ভালো জানে না। শুধু জানে ওটা বড়দের একটা খেলনা! মা- বাবা মোবাইলে ফেসবুকের ছবি দেখে, গান শোনে, ভিডিও দেখে, খবর শোনে আর লেখেও মাঝেমাঝে। বাবা পাখিটার ছোট্ট একটা ভিডিও করে দিয়েছে ফেসবুকে।
ঘুঘুপাখিটা এখন ভালো আছে। ডানাটা একটু একটু নাড়তে পারছে। মেলতে পারছে। জল, দানা দিব্যি খাচ্ছে। তপু কাছে গিয়ে দাঁড়ালে চোখ পিটপিট করে চাইছে।
“পাখি, তুই কেমন আছিস?” তপু যেন মনে মনে বলে। আর পাখিটাও তখন ফিসফিস করে উত্তর দেয়,” ভালো হয়ে গেছি তো! এবার আমি উড়তে পারব। আমায় ছেড়ে দাও তোমরা!”…
ফেসবুকে দেখে দু’একজন মানুষ পাখিটাকে নিতে চেয়ে ফোন করেছিল। কিন্তু মা-বাবা কারোরই ওদের কথা শুনে ভালো লাগে নি। ওরা নাকি ব্যবসাদার। ভালোবেসে পাখি পোষে না!…
আজ তাই ভোরবেলায় ওরা তিনজনই ছাদে এসে ঘুঘু পাখিটাকে খোলা ছাদে ছেড়ে দেয়। অত বড় ফাঁকা ছাদ পেয়ে পাখিটা আনন্দে ছটফট করতে শুরু করে দেয়। ডানাদুটো একটু একটু করে নাড়াতে থাকে। আর কি সুন্দর দু’তিনবার শিস দিয়ে ডেকে ওঠে! ঘুঘু পাখির ডাকে সকালটা মিষ্টি হয়ে যায়!
তপু মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হঠাৎ পাখিটা লাফ দিয়ে ছাদের প্যারাপিটের সরু দেওয়ালে গিয়ে তিড়িং বিড়িং নাচ শুরু করে দেয়। কিন্তু পরে যায় না। সকালের রোদ এসে পাখিটার গায়ে পড়েছে। তপুর খুব আনন্দ হয়, পাখিটাকে এমন নেচে নেচে ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ করতে দেখে। বাবু বলল, ” ও এবার ঠিক উড়ে যাবে। টেক অফ্ এর এটাই টাইম।”
সত্যি সত্যিই ঘুঘু পাখিটা এবার উড়ে গেল। ডানা মেলে উড়তে উড়তে চোখের বাইরে চলে গেল। মা টা টা করে বলল,” গুডবাই। ভালো থাকবি!”
তপুও টা টা করল। কিন্তু মায়ের মত হেসে গুডবাই বলতে পারল না। ওর বুকের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে!
বাবা হাসতে হাসতে বলল,” পাখিটা দেখবি ঠিক আবার একদিন আসবে আমাদের বাড়িতে!”
” সত্যি! ” তপু অবাক হয়ে বলল।
” সত্যিই আসবে!” বাবা কেমন মজা করে বলল, “তুই কেমন পড়াশোনা করছিস দেখতে আসবে!”
বাবার এই মজাটা তপুর একদম পছন্দ হলো না। ও তাই কেমন গম্ভীর হয়ে থাকল। মা বলল” চল এবার নীচে যাই। একটু পরেই তো আবার তোর অনলাইন ক্লাস শুরু হবে!”…
তপুর চোখে তখনও ঘুঘু পাখিটার ডানা মেলে দূরের ঐ নীল আকাশে উড়ে যাওয়ার ছবিটাই জ্বল জ্বল করছে। ওর হঠাৎ তখন মনে হল, ঈশ্, আমিও যদি তোর মত পাখি হতে পারতাম রে ঘুঘু পাখি!…