ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২৮)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম বুলেটিন পত্রিকার,January–Jully,1968 সংখ্যায় ‘Inscriptions From the Kabilaspur Temple,Saka 1565 ” শীর্ষক প্রবন্ধে কবিলাসপুর এর মন্দিরে প্রাপ্ত লিপির উল্লেখ করেছেন এবং লিপির পাঠোদ্ধার করে সেই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।

ইনি দ্বিতীয় লিপিটির পাঠোদ্ধার এরকম করেছেন—–
” শুভমস্তু শকাব্দঃ ১৫৬৫ ।।পূর্বয়া যস্য নিবাসভূর্মির
তুলাসামাসনা বিশ্রুতা যস্যা খ্যাতিরতীর দান জনিতা
যস্যা =ভি(তি) ভূপা(২)
দরঃ।
যস্য দ্বারিচ দান-মান-মহিতাঃ সন্তঃশুভাশংসিনঃ কীর্তিঃ(৩)
শ্রীযুত রূপদাস সুধিয় স্তস্যান্ত কল্পাবধি।।
এনাং কীর্তিমপা(৪)
করোতি যদি কোপ্যঙ্গ (জ্ঞা) নতা লো(সং)
বৃতোবর্ন্নস্ত স্যয়া নিবারণায় শপ(৫)
নং গোভ [স] ক(ক্ষ) ণং বর্ততাম(তাম)।—
ধর্মাত্মা যবনো ভবেদানু যুগং ভূপৌ (৬)
পি সম্ভাব্যতে তত্রায়ং বিনা পাপহাংশ্চ শপনঞ্চা
অষ্টাং বরাহাশনম্ ।।(৭)
মেহতরি শ্রীহরিদাস ।।”(৮)

উপরোক্ত লিপিটিতে রূপদাসের পরিচিতির উল্লেখ আছে। “বিখ্যাত সামাসনা হইতে আগত এই রূপদাস তাঁর দান-ধ্যানের দ্বারা যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন এবং দেশের শাসনকর্তার নিকট
সমাদৃত হন। আরো জানা যায় যে তাঁর দ্বারে যে
সমস্ত পুণ্যার্থীগণ সমবেত হইতেন এবং তাঁর শুভ কামনা করিতেন তাঁহাদিগকে তিনি উপঢৌকন প্রদান করিতেন।”
পরবর্তী শ্লোকে উল্লেখ আছে যে, কোন অবর্ণব্যক্তি এই মন্দিরের ক্ষতি সাধন করিলে
গোমাংস ভোজন এর পাপে বিনষ্ট হইবে। আরো বর্ণিত আছে যে জনৈক ধার্মিক যবন( মুসলমান)
যিনি এই অঞ্চলে যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রাপ্ত হন তিনি ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা রূপে পরিগণিত হইবেন। অভিশাপের আরও উল্লেখ আছে যে এই মন্দির ধ্বংসকারী শুকর মাংস আহার জনিত পাপে দুষ্ট হইবে।

এই লিপিটি থেকে আমরা তৎকালীন সামাজিক অবস্থা বা পরিস্থিতির কিছু আবাস পাই। হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জনসাধারণের প্রতি দৃষ্টি রেখে লিপিটিতে সাবধানবানী উচ্চারিত হয়েছে।
মন্দিরটি যে গ্রামে অবস্থিত তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রাজনগরে মুসলমান ফৌজদারগণের কোন এক বিশেষ জনকে এই শিলালিপিতে সম্ভবত ধার্মিক যবন শাসনকর্তা রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। বাহাদুর খান বা রণমস্ত খান ১৬০০ —-১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজনগরের শাসনকর্তা ছিলেন বলেই জানা যায়। তাঁর রাজত্বকালে দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির উল্লেখ পাওয়া যায়, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও কৃষিকার্যের উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। সম্ভবত এই শাসনকর্তার প্রতি ইঙ্গিত এই লিপিতে আছে।
সেই সময়ে হিন্দু মন্দিরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর পূজা অর্চনা করার জন্য রাজনগরের মুসলমান ফৌজদারগণের পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থ সাহায্য এবং ভূদানের দৃষ্টান্ত সমকালীন লিপি বা দানপত্র বা অন্যান্য নথিপত্র থেকে পাওয়া যায়।
বীরভূমের বিখ্যাত বক্রেশ্বর মন্দির তৈরি করার সময়ে এবং পরবর্তীতে পূজা অর্চনার জন্য ভূদান রাজনগরের মুসলমান ফৌজদার গণের পৃষ্ঠপোষকতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হয়।

লিপিতে উল্লেখিত এই রূপদাসের তেমন কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। শোনা যায় যে ,রাজনগরের কাছে রাধানগরে তাঁর বাস ছিল। তিনি উত্তররাঢ়ী কায়স্থ ছিলেন। বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি রাজ সরকার থেকে ‘বাঁকা দিলীপ চাঁদ’ উপাধি লাভ করেছিলেন। শোনা যায় এই ব্যক্তি রাজনগরের রাজার কাছে হেতমপুর এর কাছাকাছি কোন জায়গায় কিছু নিষ্কর জমি প্রার্থনা করেছিলেন এবং তা লাভ করেছিলেন।
লিপিতে উল্লেখিত ‘মেহতরি হরিদাস সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় অনুমান করেন, সম্ভবত মন্দির নির্মাণে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য হরিদাসকে নিযুক্ত করা হয়েছিল।’
এই ব্যাখ্যা সঠিক কিনা সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।