ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২২)

তীর্থভূমি বীরভূম, ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

শিল্পীরা টেরাকোটার মাধ্যমে রামায়ণ ,মহাভারত ,পুরাণ ইত্যাদি থেকে সংগৃহীত কাহিনী, স্বর্গের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ইত্যাদি
বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে যেমন উৎকীর্ণ করেছিল, তেমনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও শিল্পের মাধ্যমে রূপায়িত করেছিল।

সেইসময়ের শৈব মঠের যোগী মোহন্তদের জীবনযাত্রা, জমিদার এবং ইউরোপীয় ফিরিঙ্গি সমাজের বিভিন্ন আমোদ প্রমোদের দৃশ্য, সেকালে প্রচলিত জলযান, শিকার যাত্রা, সাধারণ মানুষের জীবন কাহিনী, সেই সময়ের জনপ্রিয় খেলাধুলা, গীতবাদ্য নৃত্য চর্চার মতো অবসর বিনোদনের দৃশ্যাবলী ইত্যাদি বিভিন্ন রকম বিষয় অবলম্বন করে শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলেছিলেন টেরাকোটার মাধ্যমে।

শিল্পীরা এভাবে সেই সময়ের সাধারণ মানুষের সামাজিক ,অর্থনৈতিক , বৃত্তিগত জীবন চিত্র টেরাকোটার মাধ্যমে ফুটিয়ে তৎকালীন সময়টাকে ধরে রাখতে পেরেছেন শিল্পের মাধ্যমে। যা এক মূল্যবান দলিল।

হাওড়া, হুগলি ,বর্ধমান ,বাঁকুড়া ,মেদিনীপুর, বীরভূম ,নদীয়া জেলার বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে এদেশে আগত ফিরিঙ্গি সাহেবদের নানাবিধ কার্যকলাপের দৃশ্য টেরাকোটার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ওইসব বহিরাগত ইংরেজ বা পর্তুগিজদের ব্যবহৃত নানা ধরনের জলযান তথা রণতরীও শিল্পের বিষয় হয়েছে।
এছাড়া পালকিতে ভ্রমণরত বহু ফিরিঙ্গি সাহেবের দেখা মেলে ,যারা বহু ক্ষেত্রে গড়গড়ার নল হাতে অর্ধশয়ান হয়ে আছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, বীরভূম জেলার হেতমপুরে চন্দ্রনাথ শিব মন্দিরের গায়ে একটি মেম সাহেবের মূর্তি উৎকীর্ণ আছে।

পোড়ামাটির ভাস্কর্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের পেশা বা বৃত্তি, অবসর বিনোদনের চিত্র ইত্যাদি দেখা যায় নানা স্থানের মন্দিরের গায়ে। যার মধ্যে কোদাল চালনাকারী শ্রমজীবী, গাভীর দুগ্ধ দোহনের কার্যে রত গৃহস্থ, চরকা দিয়ে সুতো কাটা ইত্যাদি বিভিন্ন দৃশ্য আছে।
বীরভূম জেলার নানুর থানার উচকরণে একটি শিব মন্দিরে চরকাতে সুতো কাটা দৃশ্যের রূপায়ণ দেখা যায়। মলুটিতে ( জায়গাটি বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হলেও পূর্বে বীরভূমে ছিল) একটি মন্দিরে দুগ্ধ দোহনের চিত্র রূপায়িত হয়েছে।

বর্তমানে ব্যাধ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব তেমন ভাবে নজরে না এলেও অতীতে তাঁরা যে নানাবিধ কৌশলে পশুপাখি শিকার করতেন, তা কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের রচিত চন্ডীমঙ্গল কাব্যে উল্লিখিত আছে। শিল্পীরা টেরাকোটার ফলকে তাদের জীবন কাহিনী ও রূপায়িত করেছেন।
তীর ধনুক দিয়ে জন্তু জানোয়ার ও পশু পাখি শিকারের বিভিন্ন দৃশ্য দেখা যায় বিষ্ণুপুরের কৃষ্ণ রায়ের জোড় বাংলা মন্দিরের দেওয়ালে। তবে দেশীয় পদ্ধতিতে নল লাগিয়ে পাখি শিকারের দৃশ্য উৎকীর্ণ আছে বর্ধমানের বনপাশের কামারপাড়ার মন্দিরে, বীরভূমের সুরুলের শিব মন্দিরে ও অন্যত্র।

ব্যাধসম্প্রদায়ের মতো সাপুড়ে সম্প্রদায়ের জীবন কাহিনী রূপায়িত হয়েছে মেদিনীপুর জেলার কয়েকটি মন্দিরে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, টেরাকোটার মাধ্যমে উৎকীর্ণ পশু পাখির বিবরণ। পশু জগতের হাতি ঘোড়া বাঘ ভালুক সিংহ উট হনুমান শিয়াল হরিণ শুয়োর প্রভৃতির রূপায়ন ছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলা বড়নগর এর চার বাংলা মন্দিরের গায়ে গন্ডারের একটি মূর্তি ও দেখা যায । বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে শ্যামরায় ও জোড় বাংলা মন্দিরে অদ্ভুত ধরনের দুটি পাখির মূর্তি লক্ষ্য করা যায়। আকাশে উড্ডীয়মান পাখি দুটির নখে ঝুলন্ত রয়েছে হাতি।

সেকালের গ্রাম্য জীবনে নারীদের বিভিন্ন বৃত্তি ও কর্মজীবন নিয়েও সৃষ্ট বিভিন্ন টেরাকোটার ফলক নদিয়া হাওড়া মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন মন্দির গাত্রে দেখা যায়।

অন্তঃপুরিকাদের অবকাশ জীবনের বহু বৈচিত্র্যময় দৃশ্য উৎকীর্ণ হয়েছে টেরাকোটার মাধ্যমে। কুলনারীদের পাশা খেলা, গৃহ কর্মের অবসরে মেয়েলি বৈঠক, কুলবধূদের পশুপাখি চর্চায় নিজেদের ব্যাপৃত রাখা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি ফলক দেখা যায় বর্ধমান ,নদীয়া, বাঁকুড়া প্রভৃতি জেলার মন্দিরে।

এছাড়া গ্রাম্য রমণীদের অবকাশ বিনোদনের উপায় এর মধ্যে অন্যতম প্রসাধন ও কেশ চর্চা।
সেই সব চিত্র টেরাকোটার মাধ্যমে বিভিন্ন মন্দিরের উৎকীর্ণ হয়েছে।
মহিলাদের চিরন্তন কেশচর্চার অন্য যে ফলকটি দেখা যায় তা হল, পিছন ফিরে বসে থাকা কোন বঙ্গবধূর কেশ পরিচর্যায়রত তার সখী অথবা পরিচারিকা। যার উদাহরণ দেখা যায়, বীরভূমের সুরুলের লক্ষ্মী জনার্দন মন্দির, মুর্শিদাবাদের বড়নগর এর গঙ্গেশ্বর শিব মন্দিরে ও অন্যান্য মন্দিরে।
সামনে আয়না ধরে সিঁদুরের টিপ পড়ছেন এমন এক মহিলার মূর্তি উৎকীর্ণ আছে বীরভূমের সুরুল গ্রামের( বোলপুর থানা) লক্ষ্মী জনার্দন মন্দিরে, বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলির( থানা ইলামবাজার) রাধা বিনোদ মন্দিরে, মুর্শিদাবাদ জেলার বড়নগর এর গঙ্গেশ্বর শিব মন্দিরে ও অন্যান্য মন্দিরে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।