ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ৪

|| জাপানের ডায়েরি – ৪ ||

 

 

“জাপানকে ঠিকমতো চিনতে হলে চীন ও কোরিয়া দেখা উচিত তার আগে। তার পরে দেখতে হয় নারা ও কিয়োতো, তার পরে ওসাকা ও তোকিয়ো। অতীত থেকে বর্তমানে আসতে হলে পশ্চিমদিক থেকে পুবদিকে আসাই সঙ্গত।” অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত “জাপানে” গ্রন্থে একথাগুলো লিখেছেন।

আমার জাপান ভ্রমণের আগে চীন ও কোরিয়া যাওয়া হয় নি। কিন্তু জাপান ভ্রমণ অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথা অনু্যায়ী নারা, কিয়োতো, ওসাকা হয়ে টোকিওতে শেষ হয়েছিল। ভ্রমণ শেষ করে আমারও মনে হয়েছিল, নারা, কিওটো দিয়েই জাপানকে দেখা শুরু করলে ভালো হয়। তারপর চোখ ধাঁধানো আধুনিক টোকিও শহর দেখে গুডবাই বলা জাপানকে- ‘সায়োনারা!..’

কিওটো শহরের KANSEI হোটেলে আমরা দু’রাত্রি ছিলাম। মাঝারি মানের ভালো হোটেল। এই হোটেলের রিসেপশন ডেস্কে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় লিফলেট ও একটা চটি বই পেলাম। জাপান ভ্রমণ শুরু করার আগে এই বই থেকে বেসিক ইনফো গুলো জেনে খুব কাজে লেগেছে। চটি বইটার নাম – WAGOKORO BOOK। বইয়ের শুরুতেই বলা রয়েছে – “This guide gathers useful information to help you enjoy your travels and make daily life in Japan more convenient.”
কিওটো শহর সম্পর্কে বলা হয়েছে – “Kyoto- More than just History and Tradition. Discover its Love for the New।”

আমরা যেদিন কিওটো শহরে প্রবেশ করেছিলাম, তখন সন্ধে শেষ করে রাতের শুরু। আলো অন্ধকারে শহরটাকে ভালো করে বুঝে উঠতে পারি নি। তবু মনে হয়েছিল, শহরটার মধ্যে কোথাও একটা ইতিহাস লুকিয়ে আছে, ঐতিহ্য আছে। খুব শান্ত, সুন্দর একটা শহর মনে হয়েছিল প্রথম দেখায়।

দ্বিতীয় দিন সকালে কিওটো শহর ও নারা ভ্রমণের জন্য দলের সবাই তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে জড়ো হয়েছেন। বুফে ব্রেকফাস্ট। জাপানী খাবারের সঙ্গে আমাদের পরিচিত খাবারেরও সুন্দর আয়োজন। চটজলদি ব্রেকফাস্ট শেষ করেই গাইড বইয়ে ডুব দিলাম।
গাইড বই নেড়েচেড়ে কিছু জাপানী শব্দ মুখস্থও করে ফেললাম, পথ চলতি জাপানীদের সঙ্গে একটু যদি কথা বলা যায়, খেজুড়ে আলাপ হয়তো সম্ভব হবে না, কিন্তু একটু তো অচেনা দুটো মানুষের মুখোমুখি হওয়া যাবে! বেড়ানো তো আর শুধু পাহাড় পর্বত নদী সমুদ্র দেখা নয়, সেখানকার মানুষজনদেরও দেখা। পরিচিত হওয়া।

Ohayo জাপানি শব্দ। আমরা বলি সুপ্রভাত।
ধন্যবাদ- Arigato। আমরা বলি গুডবাই, ওরা বলে- Sayonara। গরম কে ওরা বলে Atsui।
ঠান্ডাকে বলে- Samui। সুস্বাদু কে ওরা বলে -Oishii। খুব ক্লান্ত- Tsukareta। স্বাগতম – irasshaimase।
এই অল্প পুঁজি নিয়ে কি আর গল্প করা যায়!.. তবু করেছি, হেসেছি, করমর্দন করেছি, সেল্ফি তুলেছি… তার পর ‘সায়োনারা’ বলে এগিয়ে গেছি নতুন পথে। জাপানীরা হাসতে জানে। সরলতা আছে ওদের ব্যবহারে। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরাতো দারুণ উচ্ছল। ওদের সঙ্গে বারংবার মোলাকাত হয়েছে আর আনন্দ পেয়েছি।

আজকের সারাদিনের ভ্রমণে এবার বেরিয়ে পড়লাম। ট্রাভেল এজেন্সির লাক্সারি বাস। বাসে জাপানি গাইড কাওয়াসাকি আছেন। সুভদ্র মানুষ। হাসি লেগেই থাকে মুখে। ট্রাভেল লাইভ থেকে রয়েছেন অশোক মুখার্জি। অশোকদা ও কাওয়াসাকির যৌথ তত্বাবধানে আমরা পুরো জাপান ভ্রমণটা সুন্দর ভাবে ঘুরে শেষ করতে পেরেছি। তাই এলেখায় এই দু’জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম।
কিওটো থেকে নারা পথের দূরত্ব খুব বেশি নয়। রাস্তাঘাট পরিস্কার, সুন্দর। গাড়িও ছুটছে স্বাভাবিক ছন্দে। পথের দু’ধারের দৃশ্যগুলো চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। জাপানের চারপাশেই খুব কলকারখানা রয়েছে। ঘনবসতি চোখে পড়েছে। কিন্তু দৃষ্টি কটু লাগে না দেখতে। রাস্তার ধারে কিছু বুনো ঝোপ জঙ্গল চোখে পড়ল। মনে হলো এগুলো সব সোশ্যাল ফরেস্ট। সামাজিক বনসৃজনের ফসল।

নারা পার্কের পার্কিং লটে গাড়ি এসে থামল। আমাদের বলে দেওয়া হলো আমরা কিভাবে যাব, কি কি দেখব। সবার আগে কাওয়াসাকি। হাতে তাঁর Travel Live এর পতাকা। যাতে দূর থেকেও চিনতে পারি। অশোকদা হাঁটছেন আমাদের সঙ্গে। সকালটা খুব রোদ ঝলমলে ছিল। কিন্তু এতটুকু গরম লাগে নি। জাপানের তাপমাত্রা এমনই আরামদায়ক থাকে।

নারা পার্কের প্রধান আকর্ষণ বুনো হরিণের দল। এই পার্কে নাকি ১৪০০ এমন হরিণ আছে। বুনো হরিণেরা স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষজনরা আদর করছে। ছবি তুলছে। ওরা বেশ টুরিস্ট ফ্রেন্ডলি হয়ে গেছে। নারা পার্কে সবুজ সবুজ বুগিয়াল রয়েছে। ঝাউ গাছ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। চেরি ফুলের গাছও অনেক রয়েছে। সব মিলিয়ে নারা পার্ক বেশ মনোরম।
এখানেই প্রথম দেখলাম অপূর্ব সুন্দর কতগুলো হাতে টানা জাপানি রিক্সা। আর রিক্সার চালকরা দারুণ হ্যান্ডসাম। চালকের পোষাকও বেশ অভিজাত। এই রিক্সায় চড়ে নারা পার্ক ও তার চারপাশ ঘুরে বেড়ানো যায়। রিক্সাগুলো দেখে চড়তে ইচ্ছে হবেই!..

আজকের ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অন্যতম এক জায়গা হলো – TODAI- JI Temple। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া বিশ্ব ঐতিহ্য জাপানের সুপ্রাচীন এই মন্দির। এখানে প্রবেশমূল্য রয়েছে। কাওয়াসাকি টিকিট কেটে আমাদের সবার হাতে হাতে দিয়ে দিলেন। এই টিকিটগুলো সুন্দর স্মারকও বটে! টিকিট নিয়ে বিশ্বের অন্যতম কাঠের তৈরী প্রাচীন মন্দিরে প্রবেশ করলাম। এই মন্দির নারার সময়কালে শুরু হয়েছে ( 710- 794 AD)। এই মন্দিরকে বলা হয় – Great Buddha Hall। এই মন্দিরের ভেতরে বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। এতবড় বুদ্ধমূর্তি দেখে অবাক হতে হয়। কাঠের তৈরী এই মন্দিরটি দেখেও বিস্ময় জাগে মনে! এই বিশাল মন্দিরটি দু’বার আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, ১১৮০ ও ১৫৬৭ তে। তাই বর্তমান মন্দিরটি প্রাচীন সেই মন্দিরের থেকে ৩৩ শতাংশ ছোট।

মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে ঘুরে ঘুরে অনেককিছু দেখা যায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষজনরা ভক্তি ভরে প্রণাম করছেন। উপহার ও উপাচার নিবেদন করছেন বুদ্ধের পাদদেশে। মোমবাতি জ্বেলে মাথা নত করে দাঁড়াচ্ছেন। আর দেখলাম অদ্ভুত সুন্দর এক জিনিস বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা চটজলদি কালির আঁচড়ে সাদা পৃষ্ঠায় লিখে দিচ্ছেন ধর্মের বাণী। এগুলো সবই জাপানি চিত্রলিপি। মানুষজনরা অর্থ প্রদান করে ভক্তিভরে তা ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন।

তোদাজি টেম্পল দেখার অভিজ্ঞতা খুব সুন্দর।
অনেক বড় একটা বাগান জুড়ে এই মন্দির। বাগানে নানা রকম ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। তারমধ্যে ফুলে ভরা কয়েকটা চেরি গাছ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বলতে গেলে জাপানে এসে তোদাজি টেম্পলের বাগানেই প্রথম মন হারানোর মত ফুলে ভরা চেরিগাছ দেখলাম এবং যথারীতি মুগ্ধ হলাম।
এবেলার ভ্রমণে নারা পার্ক ও তোদাজী টেম্পল দেখে শহরের এক রেস্টুরেন্টে জাপানী লাঞ্চ করলাম। খুব ভালো লেগেছিল সেই জাপানী থালি- ‘খামা মেসি’ যার নাম। এই প্রথম জাপানী লাঞ্চ করলাম। খেয়ে বেশ তৃপ্তি হয়েছিল।

বিকেলের ভ্রমণে গেলাম আরও এক সুন্দর মন্দির দেখতে – Golden Kinkakuji Temple। এই মন্দির এর অবস্থান এক অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে। চারপাশে সবুজের সমারোহ, শান্ত নির্জনতায় এক ছোট্ট সরোবরের মধ্যে সোনার মন্দিরটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। নানাভাবে নানাজায়গা থেকে সোনার মন্দিরটা দেখার মজা আছে। প্রচুর পর্যটক ভিড় করে থাকেন। তাই সোনার পাতা দিয়ে সাজানো অপরূপ মন্দিরটা দেখতে হয় বেশ লুকোচুরি সুযোগের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে। Kinkakuji Temple Zen Buddhist Temple এর অন্তর্গত। এই মন্দিরের শোভা প্রতি ঋতুভেদ অনুসারে নাকি বদলে বদলে যায়। বছরে চার ঋতুতে চার রকম সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয় জাপানের বিখ্যাত এই কিনকাকুজি টেম্পল।

এরপর দেখতে গেলাম World Cultural Heritage – TENRYU- JI Temple। এই মন্দির ও তার বাগান খুব সুন্দর। মন্দিরের চারপাশে পাহাড়শ্রেণী ও সবুজ জঙ্গল। বাগানটির নাম – Sogenchi Garden। মন্দিরের ভেতরে এক Dharma Hall রয়েছে।

দিনের শেষ ভ্রমণে আমরা গেলাম দারুণ সুন্দর এক বাঁশ বাগান দেখতে। যার পোশাকি নাম – Arashiyama bamboo grove। এমন সুন্দর নিটোল গোল গোল আকাশ ছোঁয়া বাঁশ গাছের বাগান আমি এর আগে কখনো দেখি নি। Tenryu- Ji Temple এর বাগান দিয়ে পাহাড় জঙ্গল দেখতে দেখতে গেছি এই বাঁশ বাগানে। তাই পুরো পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম। তার ওপর যখন দেখলাম জাপানের বিখ্যাত একজন চলচ্চিত্র শিল্পী Ohkouchi Denjirou ( 1898- 1962) এই বাঁশ বাগান তৈরী করেছিলেন তখন ভালোলাগার স্বাদ আরেকটু বেড়ে গেল। তাঁর নামেই আজ এই বাঁশবাগানের নামকরণ হয়েছে – Ohkouchi Sansou Garden। এই বাঁশবাগানের মাথার ওপর নিশ্চয়ই চাঁদ ওঠে। কাজলা দিদিরা এখানেও হয়তো আছেন! জায়গাটা এত অপূর্ব যে মন কেড়ে নেয়। পাশ দিয়েই চলে গেছে আবার একটা রেলপথ। রেলের শব্দ শোনা গেল। বুলেট ট্রেন ছুটে চলে গেল দেখতেও পেলাম। তাই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আমি ও শংকরদা এক ছুটে পাহাড়ি রেল স্টেশনটা দেখতে চলে গেলাম। এমন ছোট্ট অপূর্ব স্টেশন আমি আগে কখনো দেখি নি। স্টেশনটির নাম – Arasiyama। দেখলাম এখানে আবার এক Sagano Romantic Train চলে। এত সুন্দর স্টেশন দিয়ে রোম্যান্টিক ট্রেনেরই তো যাওয়ার কথা। লুকিয়ে চটজলদি দেখে আসা এই স্টেশনটার স্মৃতি কোনওদিন ভুলতে পারব না! সব মিলিয়ে এই Bamboo Groove অসাধারণ লেগেছিল।

 

দিনের শেষে এক নদীর ধারে ফিরে এলাম। এখানে আমাদের বাস অপেক্ষা করছিল। আবার দলবেঁধে হৈ হৈ আনন্দে বাসে করে ফিরে এলাম কিওটো শহরে। ডিনার করলাম সেই রাজুর রেস্টুরেন্টে। আজও সবাই হাসিমুখে ভালোই খেলাম।

রাত খুব বেশি হয় নি। বেশ সুন্দর ঠান্ডা অনুভব করছি। জাপানে এসে প্রথমদিনের ভ্রমণটা ভালোই হলো। চলন্ত বাস থেকে চোখের দেখায় যতটুকু দেখতে পেয়েছি কিওটো শহরটাকে ভালো লেগেছে। মন চাইছিল, আর একটা দিন যদি থাকা যেত এখানে, তাহলে কিওটোকে আরও আপন করে চিনে নিতে পারতাম! এক্সপ্লোর করতাম। এই ছোট ছোট আক্ষেপগুলো থেকেই যায় গ্রুপ ট্যুরের সীমাবদ্ধতার দরুণ। অন্নদাশঙ্কর রায় এক সুন্দর ছড়া লিখেছিলেন কিওটোকে নিয়ে-” কিয়োতো / ভালোবাসা দিয়ো তো, আর / নিয়ো তো।”

আগামীকাল আমরা প্রথম বুলেট ট্রেনে চড়ব। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। দেখব হিরোশিমাকে। সেই ধ্বংসের ইতিহাসকে নিজের চোখে দেখবে অন্য অনুভব নিয়ে। তার পর যাব দারুণ সুন্দর এক আইল্যান্ডে – মিয়াজিমা। তাই এত নতুন জায়গা দেখার আনন্দ উত্তেজনায় বিছানায় শুয়েও ঘুম আসে না! ছটফট করতে করতে একটা ভালোলাগার গান মনে পড়ে যায়… গুন গুন করে গাই নিজের মনে, ‘এমন যদি হোত, আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ // বৃক্ষতলে শুয়ে, তোমার দুঃখ ছুঁয়ে, ঘুম আসে না, ঘুমও স্বার্থপর!..’

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।