সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১১)

দেবমাল্য

তিন

লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল দেবমাল্য। ঝপাঝপ তৈরি হয়ে নিল। চারটে নাগাদ লালগোলা প্যাসেঞ্জার ঢুকবে বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে। তখনও চারদিক অন্ধকার থাকবে। ট্রেন থেকে নেমে তানিয়া ওকে দেখতে না পেলে ঘাবড়ে যাবে। কী করবে, কূলকিনারা পাবে না। সঙ্গে নিশ্চয়ই ঢাউস একটা লাগেজ থাকবে। একটা না দুটো, নাকি তারও বেশি, ও জানে না। ওর কথা তো! আগে থেকে কিছুই বলা যায় না।
বিয়ের পরে পরেই বউকে নিয়ে ও বকখালি গিয়েছিল। না, গাড়ি করে নয়। গাড়ি তো সারাক্ষণই চড়ে। ট্রেনে করে যাওয়ার মজাই নাকি আলাদা। আর সেটা যদি খুব ভোরে হয়, তা হলে তার চার্ম আরও বেশি।
শিয়ালদা থেকে ছ’টা পঁয়তিরিশে কাকদ্বীপ লোকাল। লাস্ট স্টেশনে নেমে ভ্যানরিকশা করে ঘাটে। সেখান থেকে নৌকো করে ওপারে। তার পরে বাসে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। একেবারে বকখালি। পর পর অজস্র হোটেল। কিন্তু হোটেলে নয়, ওরা উঠবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দফতরের বাংলোয়।
ওখানে নাকি সহজে ঘর পাওয়া যায় না। সবই মন্ত্রীটন্ত্রি আর ভি ভি আই পি-দের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু দাদা-বউদি যাচ্ছে শুনে কাকে ধরে যেন ওই বন বাংলোর দোতলার একটা ভাল এ সি রুম বুক করে ফেলেছিল সামশের।
ঘরের একটা জানালা দিয়ে তাকালে যত দূর চোখ যায় ধূসর সমুদ্র। সাদা ধবধবে ফেনাওয়ালা ঢেউ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে পাড়ে। পাড়ের এদিকটা সার সার ঝাউগাছে ভরা। ওখানে নাকি বনবিবির একটা ছোট্ট মন্দির আছে। ছোট হলেও খুব জাগ্রত। মন্দিরের গায়েই একটা মাঝারি মাপের গাছ। লোকেরা মানত করে ঢিল বেঁধে দিয়ে যায়। মনস্কামনা পূরণ হলে, যেটা বেঁধে গিয়েছিল, সেটা তো আর অত হাজার হাজার ইটের টুকরোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই চোখ বন্ধ করে মায়ের নাম নিয়ে যে কোনও একটা ঢিল খুলে দিলেই হল।
ওই জানালার উল্টো দিকের জানালাটা খুললে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। একটু ভাল করে দেখলেই বোঝা যায়, সব গাছের পাতা সবুজ হলেও প্রতিটা গাছের সবুজই আলাদা আলাদা। সবুজের যে কত রকমের শেড হতে পারে, এখানে না এলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
আর, যে বন বাংলোয় ওরা উঠবে, তার চৌহদ্দির মধ্যেই নাকি ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানা আছে। ঢোকার মুখে সাইনবোর্ডে বন দফতরের ‘কুমির প্রকল্প’ লেখা থাকলেও পর পর অনেকগুলো খোপে সাত-আটটা, কি তারও বেশি কুমির হয়তো আছে। সব তো আর গোনা যায় না। কোনটা কোন দিকে থাকে! কেউ কেউ গোটা শরীরটা জলের তলায় রেখে শুধু মুখটুকু বের করে রাখে। কিন্তু একদম শেষ প্রান্তে ফুটবল খেলার মাঠের মতো প্রশস্ত ঘেরা জায়গায় এতগুলো হরিণ আছে, গোটা আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও বোধহয় অত হরিণ নেই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।