ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ১৪

।। আমেরিকার ডায়েরি ।।

।।ফ্লোরিডার মায়াবী শহর মায়ামি- ৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার।। 

ব্যাটন রুজ এয়ারপোর্টের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমান  American Eagle। ছোট বিমান। একটু পরেই উঠব গিয়ে। জেটওয়েজ লাগানো নেই। রানওয়ে দিয়ে উঠতে হবে।

ব্যাটন রুজ থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। তারপর লেওভার মাত্র কুড়ি মিনিট। এরপরই  মায়ামির ফ্লাইট। কানেকটিং ফ্লাইট আমেরিকান এয়ারলাইন্সেরই। গতকাল রাতে হঠাৎ জেনেছি,  ব্যাটন রুজ এর ফ্লাইট লেটে ছাড়বে। ফলে মায়ামির ফ্লাইট ধরতে খুব চাপ হয়ে গেল।

আজ ভোরে সুজয়দা ব্যাটন রুজ এয়ারপোর্টে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গেলেন। এবং এই কুড়ি মিনিটের লে ওভার সমস্যার কথাটা বোর্ডিং কাউন্টারে বলে আমার টিকিটের সিট নাম্বার এগিয়ে আনলেন, যাতে প্লেন ল্যান্ড করার পরই দৌড়ে চলে যেতে পারি কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে নেমে দৌড়ে দৌড়ে পৌঁছে গেলাম মায়ামির ফ্লাইটের কাছে। খুব টেনশন হয়েছে, যদি ফ্লাইট মিস করি তো ঝামেলা বাড়বে। টিকিট রিসিডিউল করতে হবে পরের ফ্লাইটের জন্য। আমি শেষমুহুর্তে এমন দৌড়ে দৌড়ে এসেছি দেখে বোর্ডিং কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন, “ওয়েলকাম ইয়াংম্যান!..

ডোন্ট ওরি। কুল। কুল। “

আমি টিকিট দেখিয়ে জেট ওয়েজে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটু যেন শান্ত হলাম। তখনই মোবাইল বেজে উঠল, সোহমের কল। জানতে চাইল,” সব ঠিক আছে তো?” ওরা দুজন আমার পুরো জার্নিগুলোর ট্র্যাক রাখে। তাই এতটুকু অসুবিধা হলেই বুঝতে পেরে যায়। গাইড করে দেয়।

আমেরিকায় একা একা ঘুরতে প্রাথমিক ভয়টা কেটে গেছে। কিন্তু কিছু বাস্তব অসুবিধা তো থেকেই যায়। তার ওপর বিমানবন্দরের কিছু বাড়তি হ্যাপা আছে। সব ঠান্ডা মাথায় সামাল দিয়ে চলতে হচ্ছে।

মায়ামির ফ্লাইট বেশ বড়। এবার আর জানলার ধারে সিট পেলাম না। আমার পাশের দুজন অ্যাফ্রো- আমেরিকান যুবক যুবতী। দেখে মনে হলো টুরিস্ট। দু’জনে কুজনে মায়ামি চলেছে!..

ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি হল এক বন্দর শহর। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র বন্দর ব্রাজিলের কাসিনো। তারপর নব্বই মাইল কক্সবাজার। মায়ামির নাম এদের পরেই। মায়ামির বন্দর শহরটা এত অপূর্ব যে প্রথম দেখাতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মন হারিয়ে যায় আটলান্টিকের ঢেউ গুণে। আর মায়ামি নদীর নীল জলে

 মুসাফির মন পাখা মেলে উড়ে যায়।

মায়ামির পথে আমি একদম একা। এই শহরের কেউ আমাকে চেনে না, আমি কাউকে চিনি না। এই প্রথম আমি আমেরিকার কোনও বড় শহরে একদম একা নামব। হোটেলে থাকব। বেড়াব। ডুলুং হোটেল বুক করে রেখেছে অনলাইনে। আমাকে এয়ারপোর্টে নেমে পৌঁছে যেতে হবে। থাকব মায়ামির বিখ্যাত সাউথ বিচে। হোটেলের নাম Majestic। হোটেল থেকে  আটলান্টিক সমুদ্র সৈকত পায়ে হেঁটে আট মিনিটও নয়।

আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর বিমান ঠিক সময়েই সুন্দর ভাবে ল্যান্ড করল মায়ামির রানওয়েতে। বুকের মধ্যে  চাপা উত্তেজনা অনুভব করলাম। এবার তো আমাকে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে উবের বুক করে যেতে হবে সাউথ বিচ। পথের হিসেবে পঁচিশ তিরিশ মিনিট। আমার লাগেজ নিজের কাছেই ছিল। তাই আর কনভেয়র বেল্টের কাছে যেতে হল না। ধীরে সুস্থে বেরিয়ে এলাম। মোবাইল নেটওয়ার্ক এয়ারপোর্টের ওয়াই ফাইতে কানেক্ট করতেই ডুলুং এর কল।” নেমে পড়েছো ? কোনও অসুবিধা হয় নি তো?”

“না। না। কোনও অসুবিধা হয় নি।”

“তুমি কি পারবে উবের বুক করতে? নাকি আমি করে দেব?”

আমার মোবাইলে উবের ও আমেরিকার লিফ্ট দুটো অ্যাপ ডাউনলোড করা আছে। হোটেলের ঠিকানা ঠিক মত লিখে বুক করলেই গাড়ি চলে আসবে। তবু কেমন যেন মেয়ের ওপরই ভরসা

 করলাম, “তুইই উবের বুক করে দে তাহলে।”

গাড়ি চলে এল নিমেষের মধ্যে। চালকের নাম ফিদেল। পরিচয় করেই জানলাম বাড়ি কিউবায়। মায়ামি থেকে খুব দূরে নয়। কিউবা শুনলেই ফিদেল কাস্ত্রোর কথা মনে পড়ে যায়!..চালক ফিদেল আমাকে ওয়েলকাম করে বসালেন। ডুলুংকে বলে দিলাম আমি গাড়িতে উঠেছি। ফিদেল এবার অদ্ভুত উচ্চারণে বললেন, “সুচেতনা ইওর ডটার?”

“ইয়েস। মাই ওনলি চাইল্ড!”

“আর ইউ ফার্স্ট টাইম ইন মায়ামি?”

“মায়ামি দিঘা নাকি! বছরে চারবার আসব?” মনে মনে একথা ভাবলাম। হেসে বললাম, “ইয়েস মাই ফার্স্ট ভিজিট।”

“তাহলে তুমি দারুণ এনজয় করবে! মায়ামি এক্সিলেন্ট। “

“তুমি কি এই শহরে থাকো?”

“নো। আই এম অরিজিনালি কামিং ফ্রম সেন্ট্রাল আমেরিকা।…”

“ইউ?”

“ইন্ডিয়া। নাম শুনেছো?”

“হোয়ার ইজ ইনদিয়া?”

বোঝো ঠ্যালা!.. এবার ফিদেলকে বোঝাতে হবে আমার দেশ কোথায়?..

এমন গল্প করতে করতে দু’পাশের শহরের একটা ছবিও চোখে আঁকা হয়ে রয়ে গেল। সাউথ বিচের কাছাকাছি আসতেই মোবাইল বেজে উঠল, “পৌঁছে  গেছো?” ডুলুং চিন্তিত।

“এই এসে গেছি। ফিদেল এর সাথে একটু গল্প করছিলাম।”

“তুমি সব সময় সবার সাথে এত গল্প করবে না। মায়ামিতে একটু সাবধানে থাকবে। এখানে অনেক মিস্টিরিয়াস লোকজন চলাফেরা করে। এরা সব ঘুরে বেড়ায় নানান মতলব নিয়ে।”

“তাই! ঠিক আছে। “

এরপর আরও দুচারটে সাধারণ কথাবার্তা হতে না হতেই সাউথ বিচে চলে এলাম। গাড়ি থেকে নেমে ফিদেলকে ধন্যবাদ জানালাম। ফিদেল হেসে বলল, “হ্যাভ আ নাইস ডে। ইউ এনজয় মায়ামি।”

হোটেলে ঢুকে ঘরে চলে গেলাম। ঘর দেখেই মন খুশ। একদম সমুদ্রমুখী ঘর নয়। কিন্তু এক চিলতে সমুদ্র দেখা যায় ঘরে বসে। ঘরের সব ব্যবস্থাগুলো একদম নিখুঁত সুন্দর। এটা একটা ডবল বেড রুম। রুম রেন্ট একশো দশ ডলার একদিনে। আমি দুদিন থাকব। দুশো কুড়ি ডলার!..

আজ ভোরে উঠে ব্যাটন রুজ থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মায়ামি এসে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। পথশ্রমে একটু ক্লান্ত। ফ্রেশ হওয়া দরকার। তারপর নয় যাব সমুদ্রসৈকতে।  এখানেও সন্ধ্যা হয় সন্ধ্যার অনেক পরে!..

।। সৈকতে সন্ধেবেলা….।।

আটলান্টিকের জল ছলাৎ ছল ছলাৎ করছে। সৈকতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পা ভেজাবার ইচ্ছে নিয়ে নেমে পড়লাম ঢেউয়ের জলে পা ভেজাতে।

আমার চারপাশে আমেরিকান ও অন্যান্য দেশের বহু পর্যটক। তাঁরা আটলান্টিকের জলে মহানন্দে সমুদ্র স্নান করছে। ঢেউয়ের তালে তালে ডুবছে ভাসছে। আর বহু পর্যটক সমুদ্র পারে বসে হাতে পানীয় ও পছন্দের বই নিয়ে নিজের মত অবকাশ উদযাপন করছেন। পথে, ট্রেনে, বাসে বই পড়া বহু আমেরিকানদের এই কদিনে অনেকবার দেখলাম।

আমি সৈকতের ভেজা বালির পথ ধরে বহুদূর হাঁটলাম। এই একলা ভ্রমণের আনন্দ অসাধারণ। নিজের মত করে নিজেকে পাওয়ার এই আনন্দ আমাকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে। এ যেন আমার একলা চলা করব রমনীয়। সন্ধ্যার আলো কমে এলো যখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে আটটা। হঠাই একটু ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। অল্প ভেজার একটু মজাও উপভোগ করলাম।

সৈকত ছেড়ে চলে এলাম সাউথ বিচের পথের ধারে। সে তখন এক আলোকিত সন্ধ্যা-রাত্রি।

পথের ধারে সারি সারি রেস্তোরাঁ। সব রেস্তোরাঁয় তখন যেন উৎসব চলছে। মুঠো ভরা যদি ডলার থাকে, হৃদয়ে প্রেম থাকে আর যদি পাশে থাকে প্রিয়জন এই সন্ধ্যা রাত্রি উৎযাপনের আনন্দে  ভোর হয়ে যায়। ” নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে..” প্রিয় গানগুলো এভাবেই মনে পড়ে যায়!..

অনেকটা সময আপনমনে পথের ধারে হাঁটলাম। মায়ামির শহর জীবনকে দেখলাম। সৈকত শহর। বহু পর্যটক ভিড় করে আছে। অথচ কোনও কোলাহল চিৎকার নেই। কি শান্ত আনন্দ। সবাই নিজের নিজের প্রিয়জনদের নিয়ে মশগুল। খানা-পিনা-নাচনা-গানা সব চলছে। কিন্তু তারও একটা ছন্দ রয়েছে।

অনেক রেস্তোরাঁয় স্যাক্সোফোন বাজিয়ে নাচ গান হচ্ছে। দু’একটা পাব- বারে নর্তকীর মায়াবী নাচও হচ্ছে। সেখানে ভিড় একটু বেশি।

আজ ডিনার করলাম মেক্সিকান ডিশ- Chicken Quesadilla। সঙ্গে হ্যাপি আওয়ার্স এর অফার ছিল মেক্সিকান ক্যান বিয়ার। নাম MODELO। ট্যাক্স ও টিপস নিয়ে বিল হলো ৩১ ডলার। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার রেস্তোরাঁর নিভৃতে বসে একা একাই করলাম। এই একাকীত্বের জন্য মনে আর কোনও বেদনাবোধ পুষে রাখি নি। মেনে নিয়েছি। এটাই জীবন! এভাবেই বাঁচতে হবে। তাই বাঁচাটাকে সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করি। একলা বেড়ানোর এই আনন্দকে উপভোগ করি।

ডিনার করে আবার একটু আটলান্টিকের নীল  জলের গর্জন শুনে এলাম। বঙ্গোপসাগরের দেশের লোক, আটলান্টিকে এসেছি বেড়াতে। এ এক অনন্য আনন্দ অনুভূতি।  হঠাৎই আবার ঝিরিঝিরি বরিষণ শুরু হয়ে গেল। এ বৃষ্টি বড় মিষ্টি।  ভিজিয়ে ভূত করে দেয় না, বরং একটু ভেজার অদ্ভুত মজা ও আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ এনে দেয়। আমিও সেই মজা ও আনন্দ নিয়ে ফিরে আসছি হোটেলের পথে। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল, “তুমি কোথায?” ডুলুং এর ফোন।

“ডিনার করে ফিরছি।”

“বাহ্। সব ঠিক আছে তো?”

“একদম ঠিক আছে।”

“কালকের সাইট সিয়িং এর স্লট বুক করে দিয়েছি। VIATOR এর তিনটে টুর আছে। আমি তোমাকে বুকিং টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছি হোয়াটসঅ্যাপে দেখে নাও।”

“ঠিক আছে।  হোটেলে ঢুকে দেখে নেব।”

“আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পোড়ো। কাল কিন্তু নটায় ওদের অফিসে রিপোর্টিং।”

“বেশ। এই তো হোটেলে চলে এসেছি।”

“আর বৃষ্টি হয় নি তো?”

“না। না। আকাশ এখন খুব সুন্দর।”

“ঠিক আছে।  গুডনাইট।”

“গুডনাইট।”

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ভিজতে ভিজতে চলেছি। এ ভেজার আনন্দ বড় নির্মল সুন্দর। তার জন্য একটু না হয় মিথ্যেই বললাম আত্মজাকে!.. ওদের শাসনগুলো মিষ্টি হলেও সব সময় মানতে যেন মন চায় না!..

।। আজ সারাদিন মায়ামি, তোমার সাথে…।।

মায়ামিতে সারাদিনে তিনটে প্যাকেজ টুর করলাম ট্রাভেল এজেন্টের সাথে। এই টুরগুলো হল- Miami Combo City Tour, Biscayne Bay Cruise  and Everglades Airboat Ride. এক একটা টিমে কুড়ি থেকে পঁচিশ জন ছিলাম। এই সব টিমে আমিই ছিলাম একমাত্র এশিয়ান। এবং একমাত্র বাঙালি। বাকি টুরিস্ট সবাই আমেরিকান ও সাউথ আমেরিকা থেকে  আসা লোকজন। উরুগুয়ে থেকে আসা আটজন সিনিয়র সিটিজেনের একটা দল খুব হৈ হৈ করে আনন্দ করছিলেন। ব্রাজিল থেকে আসা এক হানিমুন কাপলের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ছেলেটির নাম Felipe Mendes মেয়েটি Tainara।  দুজনেই ভীষণ সুন্দর দেখতে। ফিলিপ পুলিশে চাকরী করে। তাইনারা ট্যাক্স প্র্যাকটিশনার। সকাল নটায় প্রথম টুর শুরু হল দোতলা বাসে করে শহর দেখতে দেখতে শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গিয়ে।

মায়ামি শহরের চারপাশে অনেক বড় বড় আশ্চর্য সুন্দর সব বাড়ি, অট্টালিকা, পোস্ট অফিস, বন্দর, নদী, মিউজিয়াম রয়েছে। আমেরিকার তৃতীয় বড় অট্টালিকার শহর হলো মায়ামি। প্রথম নিউইয়র্ক।  দ্বিতীয় শিকাগো। আমি এই দুই শহর দেখেই মায়ামিতে এসেছি। মায়ামির এই ডাউনটাউন বাসে বসেই দেখতে দেখতে গেছি। এগুলো সব এক পলকের একটু দেখা।

তারপর শহর থেকে দূরের এক পার্কে পৌঁছে ওখানকার এলিগেটরদের দেখলাম। এই পার্কের নাম Sawgrass Recreation Park। এখানে খাঁচায় বন্দী  নানান সাইজের অনেক এলিগেটর রয়েছে। গাইড সুন্দর দেখালেন। অনেক গল্প শোনালেন এলিগেটরদের। এলিগেটররা ম্যানইটার নয় বললেন। আমাদের হাতে তুলেও দিয়েছেন এলিগেটরদের ছানাগুলোকে। আমিও হাতে নিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছি!

এই পার্কের পাশেই আছে এক মস্ত জলাশয়। বড় বিল বলা যায়। এই জলাশয়ের জলে এলিগেটর রয়েছে। নানান জাতের পাখি রয়েছে। এখানে একটা জলভ্রমণের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। বেশ বড় সাইজের এক স্পিড বোটে করে এই জলভ্রমণ দারুণ রোমাঞ্চকর। খানিকটা সুন্দরবনের খাঁড়িতে নদী ভ্রমণের মত মনে হচ্ছিল। এখানে দেখলাম ম্যানগ্রোভ জাতীয় কিছু গাছ। কয়েকটা এলিগেটরকে দেখলাম জলসাঁতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাছরাঙাদের মত একধরণের পাখিও দেখলাম কিছু। এই জলভ্রমণের সময় মাথার ওপর আকাশ ছিল একদম আমাদের শরতের আকাশের মত নীলিমায় নীল। মায়ামি শহরের বাইরের এই অংশটার সাথে আমাদের গ্রাম বাংলার খুব মিল আছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ ভীষণ রকমের এক। খুব আনন্দ পেয়েছি এই ভ্রমণটা করে।

দ্বিতীয় ভ্রমণ শুরু হল বেলা একটায়। ছাদ খোলা দোতলা বাসে। এই বাসের নাম HOP ON- HOP OFF।  মায়ামি সাউথ বিচের রাস্তা ধরে শহরের আরও একটা দিক দেখাতে দেখাতে নিয়ে গেল লিটিল হাভানায়। যাওয়ার সময় শহরের দেওয়াল জুড়ে গ্রাফিতি দেখেছি । অপূর্ব সব গ্রাফিতি। রঙের কি কারুকাজ এই গ্রাফিতিগুলোয়। ফুটবলার মেসির সঙ্গে মায়ামির একটা সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে। তাই মেসির এক মস্ত বড় গ্রাফিতি চোখে পড়ল। এক জায়গায় দোতলা বাস দাঁড়িয়ে পড়ল। জায়গাটার নাম Wynwood Stop for Pictures and Selfies । ফলে আমরা সবাই নেমে ছবি তুললাম চারপাশের সুন্দর সুন্দর গ্রাফিতিগুলোর। সেল্ফিও তোলা হলো। ফিলিপ ও তারানার সাথে আমার একটা সুন্দর সেলফি স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। ওরা দুজনেই কি সুন্দর আমায় নাম ধরেই ডাকত। গল্প করত। আর অনেকবার বলেছে, “তুমি নেক্সট টাইমে ব্রাজিলে এসো। আমরা থাকি ব্রাজিলিয়ায়। ক্যাপিটল অফ ব্রাজিল।।”

লিটল হাভানায় অনেক রেস্টুরেন্ট ও বার চোখে পড়ল। বারগুলোয় স্যাক্সোফোন বাজিয়ে গান – নাচ হচ্ছে। আমাদের এমন একটা বারেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। উরুগুয়ের টিমের সবাই তো একটু নেচেও নিল। পানীয় কমবেশি সবাই খেলাম। এখানকার নিশিযাপন খুব বিনোদনময়। পাশেই ছিল একটা গিফ্ট শপ। মার্কেটিং এর জন্য সময় দিল।

বিকেলে মায়ামি নদীর বুকে রিভার ক্রুজ করলাম। এই বোট টুরের নাম হলো – Biscayne Bay Cruise । মায়ামি নদীর চারপাশে ছোট বড় অনেক আইল্যান্ড আছে। Star Island, Hibiscus Island, Monument Island, Venitian Island, Fisher Island। এই রিভার ক্রজের মজা হল আইল্যান্ডগুলো দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। আর দেখা যায় নদীর দুধারে  সারা পৃথিবীর অনেক বড় বড় সেলিব্রিটিদের বাড়ি। একেকটা বাড়ি দেখলে চোখে তাক লেগে যায়। গাইড সুন্দর ইংরেজি ও স্প্যানিশ  ভাষায় ধারাবিবরণী দিয়ে বলে বলে যাচ্ছিলেন কোনটা কার বাড়ি, কবে বাড়িগুলো হয়েছে। কত খরচ পড়েছে তৈরী করতে সেসবও বলে আমাদের কৌতূহল মেটাচ্ছিলেন।

দিনের শেষ আলো এখানে শেষ হয় অনেক পরে। রিভার ক্রুজ করে নেমে এলাম যখন জেটিতে ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। এখানে তখন এক পূর্ণ বিকেল। কি মায়াবি আলো ছড়িয়ে রয়েছে মায়ামিতে। একটু নদীর ধারে পায়ে হেঁটে ঘুরে সবাই চলে এলাম আমাদের ছাদ খোলা দোতলা বাসের কাছে।

এবার ফিরে যাচ্ছি। সারাদিনের ভ্রমণ সাঙ্গ হলো দারুণ সুন্দর ভাবে। বাস আমাদের নামিয়ে দেবে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা সেই সাউথ বিচের কাছে। ফিলিপ ও তাইনারা বাসে ফিরল না। ওরা উবের ধরে চলে গেল হোটেলে। ওদের সাউথ বিচের কাছে হোটেল নয়। ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগের মুহূর্তে আলিঙ্গন বদ্ধ হয়ে বলেছিলাম, “শুরু করেছিলাম সহযাত্রী হয়ে, শেষ হল আমাদের বন্ধুত্বের সূচনায়।”

“Yes। You are right.” দুজনেই  হেসে আমার কথাকে সম্মতি জানাল। টা টা করে ফিলিপ ও তাইনারা চলে গেল। আমি গুডবাই বললাম।

(দেশে ফিরে এসেছি। আমাদের যোগাযোগ আজও অটুট। প্রতিদিন সকালে আমি ফিলিপকে সুপ্রভাত জানাই। ও আমাকে জানায় Bom Dia= Good Morning)।

আমাদের হপ অন- হপ অফ বাস ছাড়ল। ছাদ খোলা দোতলা বাসে বসে দিনান্তের শেষ আলোয় শেষবারের মত মায়ামির বন্দর শহরটাকে দেখতে দেখতে ফিরছি। কি অপূর্ব দেখতে লাগছিল শহরটাকে। মন উদাস হয়ে গিয়েছিল এই দেখার আনন্দে।

আজকের সন্ধ্যারাত্রি মায়ামিতে কাটিয়ে কাল সকালের ফ্লাইটে চলে যাব সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটন৷ আমেরিকা ভ্রমণে এই একমাসে আমার দশম বার ফ্লাইটে চড়া হবে!..

আমেরিকায় একদম একা একা ভ্রমণের প্রথম ভ্রমণ মায়ামি বড় সুন্দর ভাবে শেষ করলাম। অনেক স্মৃতি, অনেক ছবি মনের চিত্রপটে স্থায়ী হয়ে রয়ে গেল। থ্যাঙ্ক ইউ মায়ামি!..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Ramesh Chandra Das says:

    শেষ করলাম। বেশ চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।