ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ৬

 আমেরিকার ডায়েরি – ৬ 

১৩ অগাস্ট -মঙ্গলবার। বিদায় সিরাকিউজ

আজ সকালেও সময়মতো ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু দেখলাম শরীর ঠিক চনমনে নয়। ক্লান্তি রয়েছে সারা শরীর জুড়ে। গত সাতদিন ধরে শুধু ঘুরছি আমেরিকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। বড় বড় জার্নি হচ্ছে। খাওয়া ঘুম ঠিকমত হচ্ছে না। তাই শরীর যেন একটু বিশ্রাম চাইছে।

ডুলুং-সোহম ঘুম থেকে উঠে বলল,”আজ আমরা একটু দেরী করে বেরব। রেস্ট দরকার। আর কিছু কাজও আছে ঘরের। “

ভালোই হল আমারও একটু বিশ্রাম জুটে গেল।

সোহমের নতুন অ্যাপ্যার্টমেন্ট। ঘরের সবকিছু এখনো সাজানো হয় নি। তারওপর ইন্টারনেট কানেকশান, ডিসওয়াশার মেশিন, ওয়াশিং মেশিন এসবের ব্যবস্থাগুলো চালু করতে হবে। তাই ওরা দুজন ঘরের কাজগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমিও যতটা পারি হাতে হাতে করে দিলাম।

এখানে কোনও কাজের লোক, রান্নার লোক, সহকারী লোক পাওয়া যায় না। সব কাজ নিজে করো। নিজে শেখো। যন্ত্র রয়েছে চারপাশে ছড়ানো। তুমি যন্ত্রমানব হয়ে ওঠো। এক-এক সময় মনে হয়, বেশ ভালোই তো। মানুষকে এমন স্বাবলম্বীই তো হতে হবে। পরনির্ভর জীবন কেন বহন করবে? আবার কখনো কখনো মনে হয়, এত আত্মনির্ভরশীল জীবন কোথায় যেন একাকিত্ব এনে দেয়। মানুষের থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তখন ভিড়ের মধ্যে থেকেও একা হয়ে যাওয়া। এই একাকীত্বের জীবনে বিষাদ এসে জড়ো হয় গোপনে। নির্বাক মন নিয়ে কেমন গুমরে কাটে জীবন!..

সকালে ঘরের দরকারী কাজগুলো সেরে একটু বিশ্রামও হয়ে গেল। তাই বাড়িতেই লাঞ্চ করে নিলাম।

গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে প্রায় দুটো বেজে গেল। বিদায় সিরাকিউজ! চারটে রাত সিরাকিউজে কাটালাম। সিরাকিউজ আমার মন জয় করে নিয়েছে। এমন সুন্দর এক পাহাড়ি শহরে আমার প্রিয়জন থাকবে, পড়াশোনা করবে এটা ভেবেই বড় আনন্দ নিয়ে ফিরে চললাম আরও এক সুন্দর শহর বস্টনের পথে। সিরাকিউজ থেকে বস্টন পাঁচ-ছ’ঘন্টার ড্রাইভ। হোটেলে পৌঁছাতে রাত আটটা বাজবে! হোটেল দু’দিনের জন্য বুক করা আছে। আজ  রাতে পৌঁছে কাল সারাদিন বস্টনে ঘুরব। তারপর পরশুদিন চলে যাব বস্টন থেকে বহুদূরের এক শহর বল্টিমোর।

আমেরিকার হাইওয়ের প্রশংসা আগের লেখাতেই করেছি। আজও আমরা সেই সুন্দর হাইওয়ে ধরে এগিয়ে চললাম বস্টনের পথে।  অনেকটা পথ। মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়েছি আমরা। সোহম সুন্দর ড্রাইভ করে চলেছে। ডুলুং সামনে বসে রোড ম্যাপ খেয়াল রাখছে। আমি পেছনে বসে আপনমনে পথের দৃশ্য উপভোগ করছি। এই পথগুলো দিয়ে যেতে যেতে সত্যিই মনে হয়, “এই পথ যদি না শেষ হয়..” বড় অপূর্ব লাগে এই লংজার্নিগুলো।

বস্টন বা বোস্টনও বলে। ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল সুন্দর শহর বস্টন। ১৭০০ দশকের শেষের দিকে আমেরিকান বিপ্লবে এই শহরের খুব বড় ভূমিকা ছিল। বস্টন ভারতীয়দের কাছে খুব পরিচিত প্রিয় শহর। অনেকেরই চেনা পরিচিত মানুষজন বস্টনে থাকেন। আমারও পরিচিত কয়েকজন রয়েছেন এই শহরের নানাপ্রান্তে।

আমেরিকান হাইওয়েতে একটা জিনিস খুব চোখে পড়েছে, গাড়ি ড্রাইভ করছেন প্রায় সব বয়সের নারী ও পুরুষরা। সবচেয়ে অবাক করেছে এদেশের সিনিয়র সিটিজেনরা। তাঁরা দিব্যি লংড্রাইভ করছেন। শুধু করছেন না, পাশে সঙ্গী বা সঙ্গীনিকে নিয়ে উইকএন্ডগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এদেশের এটা খুব পরিচিত কালচার। উইকএন্ড গুলো  কাছাকাছি শহরের হোটেলে বা সমুদ্র সৈকতে চলে যাওয়া। একটু অন্যযাপনের আনন্দ কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসা প্রাত্যহিকের জীবনে।

আমাদের দেশে মোটামুটি যাদের দাদু-দিদা বলে  বানপ্রস্থে পাঠিয়ে দিয়েছি, এখানে দেখলাম তেমন দাদু-দিদারা  দিব্যি হেসে খেলে গাড়ি চালিয়ে “হাম দোনো দো প্রেমি দুনিয়া ছোড়  চলে” গাইতে গাইতে হাইওয়েতে লংড্রাইভ করে হুশ হুশ করে চলে যাচ্ছে! বাহ্ রে জীবন!..

আমার তো কলকাতায় এখন আর গাড়ি চালাতেই ইচ্ছে করে না। লং ড্রাইভ এখনো পছন্দ করি। কিন্তু আমাদের হাইওয়েগুলো ভালো হলেও, এত ভালো হয়ে ওঠে নি। তাই লংড্রাইভ করে এখানকার মত মজা পাওয়া সম্ভব হয় না।

বস্টন শহরে ঢুকতে রাত প্রায় আটটাই হলো। মাঝে দু’বার বিরতি নেওয়া হয়েছে। রেস্টরুম ব্যবহার ও কফি, বার্গার খাওয়ার জন্য। শহরে ঢুকে হোটেল খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় নি। সরাসরি চলে এলাম হোটেলে। হোটেলের নাম- LA QUINTA। পাঁচতারা হোটেল নয়, সাততলা হোটেল। আমাদের ঘর সাততলাতেই পেলাম। মোটামুটি ভদ্রস্থ হোটেল বলতে যা বোঝায় LA QUINTA হলো তাই।

এই হোটেলে দু’দিন থাকব। একটা ফোর বেডেড রুম। মোট ভাড়া পড়ল পাঁচশো পাঁচ ডলার। আমি তো সব সময় ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে কনভার্ট করে ফেলি মনে মনে, তাহলে দাঁড়াল কম বেশি ৪২ হাজার টাকা!.. চা, কফি, জল চব্বিশ ঘন্টা ফ্রি। এবং ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। চা কফি জল চব্বিশ ঘন্টা ফ্রি মানে অনেকটা ডলার বাঁচল! পাঁচ ডলার খরচা করে এক কাপ কফি – ভারতীয় টাকায় ৪১৫/। তবু খেয়েছি। নেশা। চা কফি ছাড়া থাকতে পারি না!..

হোটেলের রুমে ঢুকে রেস্ট নেওয়া ছাড়া আজ আর কোনও কাজ নেই। সুন্দর রুম। ওয়াশরুম চমৎকার। এসি আছে। রুম হিটারও আছে। একটু রেস্ট নিয়ে সোহম ডুলুং আলোচনা করে অনলাইনে ডিনারের অর্ডার করল। বাইরে থেকে খাবার আসবে। হোটেলে কোনও রেস্টুরেন্ট নেই।

আজ ডিনারে এলো “মেডিটেরেনিয়ান চিকেন ওভার রাইস”। একটু ভাতের স্বাদ পাওয়া আর কি! এই খাবারটায় মেওনিজ মাখানো অনেকটা কাঁচা স্যালাড থাকে। খেতে খুব সুস্বাদু। খরচ হলো মোট ৩৫ ডলার। আমেরিকায় মোটামুটি সারাদিন একজন মানুষের বেসিক মিল, ব্রেক ফাস্ট, চা- কফি, হাল্কা টিফিন খেতে মোট খরচ পড়বে ৫০/ ডলার। অর্থ্যাৎ ভারতীয় টাকায় ৪১৫০/ টাকা!.. এটা একদম নূন্যতম খরচ ধরে বললাম।

আমেরিকায় এসে আমাকে সর্বভূক হতে হয়েছে। যা পাচ্ছি খেয়ে নিতে হচ্ছে। আমার বাঙালি জিভ এখানে এসে আন্তর্জাতিক না হয়ে পারে নি! খাবারগুলো সুস্বাদু এবং চমৎকার। তবু যেন ভেতো বাঙালির দুঃখ রয়ে যায় হৃদয়ে!

ডিনার শেষে আর রাত জেগে সময় নষ্ট করি নি। ক্লান্ত ছিলাম সবাই। প্রতিদিনের নিয়ম মত রাতের দাঁত ব্রাশ করে আজীবন খেয়ে যেতে হবে যে ওষুধটা, সেটা খেয়ে নিলাম। তারপর মনে মনে “ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু…” গাইতে গাইতে নরম বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।

।। ১৪ অগাস্ট, বুধবার, বস্টন সাইট সিয়িং।।

ভোরের আকাশ দেখলাম LA QUINTA হোটেলের জানালা দিয়ে- বেশ শান্ত নীল আকাশ। মেঘহীন সুন্দর নীলাকাশ। শহরটাও কেমন নিঝুম। একটু পর হয়তো রোদ উঠবে। শহরও জেগে উঠবে। আজ আমরা বস্টনের সাইট সিয়িংগুলো করব। ঘুরে ঘুরে দেখব বস্টন শহরটাকে। একদিনের ভ্রমণে সব দেখা সম্ভব নয়। আবার একটা শহরে চার পাঁচদিন হোটেলে থেকে সব দেখাও সাধ্যে কুলোবে না। তাই পছন্দের জিনিসগুলো দেখার চেষ্টা করব। তার একটা তালিকাও তৈরী করে নিয়েছি।

বস্টন এক অপূর্ব শহর। এই শহরে ঘুরে দেখার মত বহু জিনিস রয়েছে। সেসব যেমন ঐতিহ্য পূর্ণ তেমন আবার পর্যটকবান্ধব জনপ্রিয় জায়গা। Quincy Market, Boston Tea party Ships & Museum , Children’s Museum,   Common Public Garden, Beacon Hill, Boston Harbor, Charles River Esplanade , Harvard University, MIT, ChinaTown, DownTown Crossing, Freedom Trail, Post Office Park- সারাদিন আমরা কখনো পায়ে পায়ে হেঁটে কখনো বস্টনের মেট্রোরেলে চড়ে এগুলো দেখেছি। খুব আনন্দ পেয়েছি। এছাড়াও ছিল আরও অনেক বিখ্যাত সুন্দর সুন্দর জায়গা। সেসব আর দেখা সম্ভব হয় নি।

আমরা হোটেল LA QUINTA থেকে নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম এই ভেবে যে শহরটা ঘুরতে সুবিধা হবে। কিন্তু আমাদের ভাবনায় ভুল হয়ে গিয়েছিল। এই শহরে পার্কিং পাওয়া খুব কষ্টের। যেখানে সেখানে গাড়ি রেখে ঘোরা সম্ভব হবে না। তাই বাধ্য হয়ে একটা বহুতলের বেসমেন্টে গাড়ি রাখলাম সারাদিনের জন্য।  এবং পার্কিং চার্জ দিলাম ৪২ ডলার!..ছোট্ট ভুলে বড় মাশুল গুণতে হলো।

গাড়ি রইল পার্কিংয়ে, আমাদের ভ্রমণ হল শুরু  ওয়াকিংয়ে। পায়ে পায়ে বস্টন। প্রথমেই দেখলাম বস্টন টি পার্টি ও চিলড্রেন্স মিউজিয়াম। নদী বন্দরের দুই পারে এই দুই বিখ্যাত জিনিস। বস্টন টি পার্টির একটা ইতিহাস আছে।

ব্রিটিশ শাসকের “চা -কর” এর বিরুদ্ধে আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে হয়েছিল এই গণ আন্দোলন। ১৭৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল  “সন অব লিবার্টিদের” একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। ব্রিটিশ চা করের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রায় ১০০ জনের মত তরুণ নিঝুম রাতের গভীর অন্ধকারে বন্দরে দাঁড়ানো জাহাজে উঠে চা ভর্তি বস্তাগুলো আটলান্টিকের নীল-কালো জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ৩৪২ বস্তা চা সেই রাতে মহাসমুদ্রে ফেলে দেয় সন অব লিবার্টির বিদ্রোহীরা। তাদের পরনে ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের পোশাক।

এত চায়ের বস্তা আটলান্টিকের জলে নিক্ষেপের মাধ্যমে সেদিন ঔপনিবেশিক আমেরিকানরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনীতিতে চরম আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল। BOSTON TEA PARTY তাই ঐতিহাসিক মর্যাদায় আজও উদযাপিত হয়- জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা যখন বন্দরের নীল-কালো জলে প্রতীকি চায়ের বাক্স ছুঁড়ে ফেলে দেয়, হাততালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আজকের চা পার্টি।

বন্দরের এপারে Boston Tea Party ওপারে সুন্দর Children’s Park দেখে আমরা চলে গেলাম হাঁটতে হাঁটতে শহরের পথে Post Office Park দিয়ে DownTown Grossing হয়ে একদম Quincy Market।

কলকাতার নিউ মার্কেটের মতই মনে হচ্ছিল কুইন্সি মার্কেটকে। রোদ ঝলমল কুইন্সি মার্কেটে একজন আমেরিকান পথশিল্পী খোলা জায়গায় শারীরিক নানা খেলা দেখিয়ে সবাইকে খুব মাতিয়ে রেখেছিলেন। আমরা কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে দেখলাম তাঁর কর্মকান্ড। বেশ মজা করে কথা বলে সবাইকে হাসাচ্ছিলেন।

কুইন্সি মার্কেটের ভেতরে অনেক রকম খাবারের দোকান। আমেরিকান ফাস্ট ফুডের রকমারি সব খাবার সাজানো। তারমধ্যে ফিস আইটেমও চোখে পড়ল অনেক। বিশেষ করে ক্র্যাব, লবস্টার ও সলমন মাছের লোভনীয় ডিশগুলো।  খেতে খুব ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু ডলার বলল, “খেয়ো না!.. তোমায় এখনো থাকতে হবে এদেশে একমাস!..” আমিও মনে মনে  তখন বললাম, “ঠিক। ঠিক। ঠিকই তো। ঘুরতে এসেছি। ঘোরাটাই তো আসল!.. খেয়ে কি হবে!…”

কুইন্সি মার্কেটের দুই ফুটপাত জুড়ে বিক্রি হচ্ছে টুপি, গেঞ্জি, টিশার্ট, মেয়েদের সাজগোজের হরেক জিনিস। আমি সাধারণত নতুন নতুন জায়গায় গেলে সে জায়গার একটা টুপি বা টিশার্ট নিজের জন্য কিনি স্মারক হিসেবে। আমেরিকায় এসেছি একটা টুপি অন্তত কিনে নিয়ে যাব ভেবে দর করতে গিয়ে ডলারের পরিমাণ শুনে ভাবলাম, এতো টুপি কেনা নয়, টুপি পড়া হয়ে যাবে!..থাক্!  মনে মনে জয়ধ্বনি দিলাম, আসছে বছর দেখা যাবে!..

Quincy Market থেকে হাঁটতে হাঁটতে এবার আমরা চললাম Boston Harbor এর কাছে। যাওয়ার পথে বস্টন শহরটাকে নানাভাবে দেখতে দেখতে চলেছি। এই শহরটাকে ভীষণ শান্ত, সুন্দর লাগছিল। মানুষজনরাও বেশ হাসিখুশি। কোথাও কোনও হৈ চৈ অতি ব্যস্ততা নেই। সবাই নিয়ম মেনে সৌজন্য বজায় রেখে চলছে। কথা বলছে। খুব ভালো লাগছিল।

 হারবার বড় সুন্দর এক জায়গা। বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় কত জাহাজ। রং বেরং এর জাহাজ ভর‍া বন্দর দেখতে খুব সুন্দর লাগে। আটলান্টিকের জল ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল নয়! এখানে সে বড় শান্ত, স্থির। হারবারের পাশেই রয়েছে অনেকটা সবুজ এক ঘাসজমি। বুগিয়াল, মেডো যে নামে খুশি ডাকা যায়। সেখানে দেখলাম আমেরিকান পরিবারগুলো বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়েছে। ওরা কি খুশি! কি খুশি! দৌড়ে লাফিয়ে মজা করছে, খেলছে। ঘাস জমিতে গড়িয়ে পড়ছে। আর ওদের মা বাবারা বেশ প্রেমালাপ করছে নিজেদের মধ্যে মগ্ন হয়ে ঘাসজমিতে বসে। আমেরিকানরা প্রকাশ্যে সঙ্গী বা সঙ্গীনিকে দিব্যি সুন্দর আদর করতে পারে। কতবার সে দৃশ্য আমি দেখেছি। দেখতে এতটুকু অশোভন, অশালীন মনে হয় না। ভালোবাসার প্রকাশ ও আদর করার আনন্দ ওরা খুব উপভোগ করে। তারজন্য নিভৃত নির্জনতাকে ওরা পাত্তা দেয় না!..

হারবারের পাশেই মনে হয় বস্টন এয়ারপোর্ট। তাই আকাশ থেকে বিমানগুলো নামতে নামতে একদম আটলান্টিকের জল ছুয়ে যেন চলে যায়। উফ্ এটাও একটা দেখার মত সুন্দর দৃশ্য। এই হারবারে ক্রুজের ব্যবস্থা রয়েছে। আটলান্টিকের বুকে ভেসে বেড়ানোর মজা। দেশ বিদেশের বহু পর্যটক ক্রুজে করে এই আনন্দের স্বাদ নিচ্ছে। আমাদের ক্রুজে চড়া হয় নি। এটা একটা আফসোস রয়ে গেছে হৃদয়ে!..

সকাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়ে গেল। আজ আমরা বস্টনের চায়না টাউনে লাঞ্চ করব ঠিক করে রেখেছিলাম। ডুলুং সোহম এর আগে একবার বস্টনে এসেছিল। ওদের  কনফারেন্স ছিল। ওরা বস্টন থেকে সেবার কানাডায় চলে গিয়েছিল আরও এক কনফারেন্সে । তাই শহরটা কিছুটা চেনা ওদের। চায়না টাউন খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। ওরা সেবার যে দোকানে খেয়েছিল সেই চিনা দোকানটা FIVE SPICES HOUSE খুঁজে বের করে ফেলল। আজ আমরা খেলাম চাইনিজ খাবার  CRAB RANGOON, CHICKEN LO- MEIN, SEASEME CHICKEN WITH RICE এবং একটি সুপ। সুপটা কাঁচা ডিম দিয়ে খুব সুন্দর বানিয়েছিল। আর CRAB RANGOON অসাধারণ!.. লা জবাব!..

লাঞ্চের পর চলে গেলাম Common Public Garden ও Beacon Hill দেখতে। এই পার্কটা বেশ বড়। প্রচুর গাছ রয়েছে। বাচ্চাদের খেলার জায়গা রয়েছে। সুন্দর সুন্দর জলাশয় রয়েছে ছোটরা জলে নেমে সুইমিং করছে। এটা আমেরিকানদের কাছে সামার। ওরা সামারকে চুটিয়ে উদযাপন করে। স্কুল কলেজ ছুটি থাকে। পরিবার নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। আমার আমেরিকায় এসে একটা জিনিস খুব চোখে পড়েছে, ওরা কিন্তু বেশ পরিবার মনস্ক। এবং একাধিক সন্তান সহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সিঙ্গেল চাইল্ড ফ্যামিলি ওদের নয় দেখলাম।  বাচ্চাদের খেলে বেড়ানোর দেদার স্বাধীনতাও দিচ্ছে।

কমন পাবলিক পার্কের পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক বিকন হিল। এখানে লাইন দিয়ে অপূর্ব স্থাপত্যের বাড়িগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। একদম আমাদের উত্তর কলকাতার মত বাড়িগুলো লাইন দিয়ে বানানো। দুটো বাড়ির মধ্যে কোনও দেওয়াল নেই। কিন্তু ওদের এই বাড়ির আর্কিটেকচার ভীষণ আধুনিক। কত যত্ন করে যে বানিয়েছিল তা দেখে সত্যি অবাক হয়েছি। এমন কি এই বাড়ি লাগোয়া ইট দিয়ে সাজানো ফুটপাতও খুব দৃষ্টিনন্দন। বিকন হিলের ছোট্ট ইতিহাস হল- Home to the Massachusetts State House and many historical landmarks including the Boston African American National Historic Site.

বিকন হিলের পাশেই রয়েছে চার্লস রিভার ও পার্ক। জায়গাটার নাম তাই দেখলাম- CHARLES RIVER ESPLANADE।  আমাদেরও এমন Esplanade আছে। অনেকে আমরা ধর্মতলা বলি। Esplanade কথার অর্থ হল নদী তীরবর্তী শহর। আমাদের ধর্মতলা তো তাই। গঙ্গার নিকটবর্তী এক শহর- তাই তার ইংরেজি নাম Esplanade। চার্লস রিভারের পাশে গাছের ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম ও নদীর শোভা উপভোগ করে ভালোই লাগল।

Freedom Trail বস্টনের আরও এক ঐতিহাসিক জায়গা। ১৭৭৫ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা বস্টন দখলের সময় এখানে ক্যাম্প করেছিল। ফ্রিডম ট্রেইল বস্টন কমন থেকে শুরু হয়। এটি প্রায় আড়াই মাইল জুড়ে। আমরা এর অনেকটাই পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখলাম। আমেরিকার ইতিহাসে বস্টনের ভূমিকা গভীর ভাবে বোঝা যায় এই ফ্রিডম ট্রেইল পরিদর্শন করলে। এই সুন্দর আড়াই কিমি পথের নকশা করেছিলেন সাংবাদিক উইলিয়াম স্কোফিল্ড ১৯৫১  সালে। তাঁর করা সুন্দর এই নকশাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন বস্টনের মেয়র জন হাইনেস ১৯৫৩ সালে।

এবার আমরা চললাম পৃথিবী বিখ্যাত দুই বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে HARVARD ও MIT। হেঁটে যাওয়া নয়। গেলাম বস্টনের মেট্রোরেলে করে।  সোহম মেবাইলের জিপিএস অন করে খুঁজে খুঁজে বের করছে পথ, ঘাট, স্টেশন। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আমরা মেট্রোর  SOUTH STATION থেকে উঠলাম। টিকিট নিল সাড়ে তিন ডলার। নিউইয়র্কে মেট্রো চড়ে মন ভরে নি। কিন্তু বস্টনের মেট্রোরেল খুব সুন্দর। এখানে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে মেট্রোরেলে চড়তে গিয়ে। সেটা নিউইয়র্কেও হয়েছিল। টিকিট পাঞ্চ করে ঢোকার সাথে সাথে টিকিট না কাটা এক যাত্রী আমার সাথে টুক করে ঢুকে গেল!..আবার ওরা বেরিয়েও গেল ঠিক ওভাবে কারো না কারোর সঙ্গে। এরা মূলত অভাবী আমেরিকান। হোমলেস পুওর আমেরিকান। সাদা – কালো দু’ধরণের মানুষই আছে। এব্যাপারে আমার মনে হয়েছে মেট্রোরেল কতৃপক্ষ সব জানে, কিন্তু খুব কড়াকড়ি কিছু করে না ওদের জন্য! অর্থ্যাৎ এক চোখ বন্ধ করে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলেছে।

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে সত্যি কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এর খ্যাতি ভুবনজোড়া। কোনওদিন যে এমন সুযোগ আসবে জীবনে ভাবি নি। জীবন আজ কত অধরা মাধুরী আমায় সাজিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে। এজীবনকে প্রণাম জানাই। আমি কৃতজ্ঞ আমার এই সৌভাগ্যময় জীবনের কাছে। কত  কি পাই নি, কত কি হারিয়েছি.. তাই আর ভাবি না!.. বরং ভাবি, হে জীবন, তুমি আমায় কত কি দিচ্ছো এই পরিণত বয়সে এসে। আমার “অন্যভুবন – সবুজ পাঠ” আছে। আজ আমার কত সবুজ বন্ধু। কত প্রিয়জন,কত শুভাকাঙ্ক্ষী। আমার কত ছোট্ট ছোট্ট বন্ধু সবুজ পাঠে। আমার প্রিয় কত দিদিমণি। কত শিক্ষার্থী আদিবাসী মা। আমি আজ ওদের ভালোবাসায় ভরা ডাক শুনি “দাদা”!  মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিশ্বভুবনে বেড়াতে বেড়াতে এসব কথাও মনে মনে ভেবে ভ্রমণকে আরও উপভোগ্য করে তুলি।

হার্ভাডের বিরাট ক্যাম্পাসে হেঁটে হেঁটে অনেকটা সময় ঘুরে বেড়ালাম। আর অবধারিত ভাবে  একজনের নাম মনে আসছিল, তিনি হলেন অমর্ত্য সেন। বাঙালির দ্বিতীয় নোবেল জয়ী কৃতি অর্থনীতিবিদ এখানে পড়াতেন। তাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বহুদিন ধরে। আমি আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে এসে দাঁড়িয়ে আছি!..

হার্ভাড থেকে আবার মেট্রোরেলে চড়ে চলে এলাম KENDALL // MIT। যার পুরো নাম হলো – Massachusetts Institute of Technology। এও পৃথিবী বিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয়। খুব সুন্দর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। অনেকটা ছড়ানো চার্লস নদীর পাশেই এই বিশ্ববিদ্যালয়। ঘুরে ঘুরে দেখলাম।এখানে এসেও একজনের কথা খুব মনে পড়ল, তিনিও একজন কৃতী বাঙ্গালি নোবেল উইনার। নাম তাঁর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যাোপাধ্যায়। অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। এই অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় MIT র ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থনীতি বিভাগের আন্তর্জাতিক  অধ্যাপক। তিনি আজও জড়িত আছেন MIT র সাথে।

এই দুই বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় দেখার আনন্দ ভুলবার নয়। একটা গোটা দিন বস্টন শহরের পথে পথে হাঁটলাম। ঘুরে বেড়ালাম। কত সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখা হল। চোখ মন জুড়িয়ে গেছে। নিউ ইয়র্ক খুব চোখ ঝলসে দেওয়া সিটি। বস্টন চোখের আরাম। এই চার্লস নদী ও আটলান্টিকের পাশে গড়ে ওঠা শহরটাকে বড় ভালো লেগেছে।

মেট্রোরেলে করে এবার ফিরে এলাম শহরের সেই আবাসনের কাছে, যেখানে আমাদের দুধ সাদা WAGONEER গাড়িটা জমা রেখে গিয়েছিলাম।

আমাদের হোটেল LA QUINTA য়  ফিরে চললাম। ঘড়িতে প্রায় রাত আটটা। সূর্য এবার ডুববে ডুববে করছে। পশ্চিম আকাশে রং এর খেলা শুরু হয়েছে। বস্টন শহর আরও শান্ত হয়ে আসছে। শহরবাসীরা যে যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। কলকাতায় সন্ধ্যা নামে কত আগে। এখানে সন্ধ্যা যেন রাত্রির কোলে জন্ম নেয়। হোটেলে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা এবার একটু বিশ্রাম চাইবে।

বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি টো টো করে। হে মহাজীবন, “এমনি করেই যায় যদি দিন যাক্ না…”

পশ্চিম আকাশের শেষ আলোর দিকে তাকিয়ে আপনমনে গুণ গুণ করছি, “যাক্ না.. এমনি করেই…।” মেয়ে জামাই গাড়ির সামনে। ওরা নিজেদের মত গল্প করছে। গাড়িও ছুটছে LA QUINTA র দিকে।

আমি মুসাফির। আগামীকাল আবার নতুন জায়গা বল্টিমোর যাব, এই ভেবেই আনন্দে আত্মহারা!..

সানসেট হয়ে গেল। রাত্রির কোলে জন্ম নিল এক অপরূপ সন্ধ্যা।…

শুভরাত্রি।

বস্টন। ১৪ অগাস্ট।  ২০২৪।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. U N Putatunda says:

    Khubei rasograhi o manograhy hoyechey ei parber lekha. Monkey dharey rakhar rasader abhav nei.
    Kathkn kathao sahajey ball hoyechey. Lukochuri nei,tai eta prasangsanio.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।