সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ২৫)

কেমিক্যাল বিভ্রাট

আট

সবাই তাজ্জব। এটা কী করে সম্ভব! তিন মাস আগে বুক করতে গিয়েও যে ডাক্তারদের ডেট পাওয়া যায় না, সেই ডাক্তারদের চেম্বারও বেশ কিছু দিন ধরে একেবারে খাঁ খাঁ করছে। সাধারণ হাসপাতাল তো বটেই, সুপার ফেসিলিটি হাসপাতালও একদম শুনশান। যে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলি কাজের চেয়ে নামে কাটে বেশি, সেই পাঁচতারা হোটেলের মতো তাবড় তাবড় বেসরকারি নার্সিংহোমগুলিতেও হাতে গোনা মাত্র গুটিকতক লোক। তাও যাঁরা আসছেন, তাঁদের কেউই কঠিন কোনও রোগেরর চিকিৎসার জন্য আসছেন না। আসছেন রুটিন চেক-আপ করাতে কিংবা অসুখ নিয়ে যাঁরা বিলাসিতা করেন, তাঁরা।

তবু তাঁদের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে করার পরেও রোগ তো নয়ই, রোগের সামান্যতম লক্ষ্মণও দেখা যাচ্ছে না। খরিদ্দার নেই দেখে ক’দিন যাবৎ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে রাজ্যের প্রায় সমস্ত ওষুধের দোকান।

মুখ বেজার করে ঘরে বসে রিমোটের বোতাম টিপে টিপে একের পর এক খবরের চ্যানেল দেখে যাচ্ছেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভরা, তাঁদের কোনও খবর আছে কি না জানার জন্য।

প্যাথেলজিগুলি ফিফটি পার্সেন্ট, সিক্সটি পার্সেন্ট, কোথাও কোথাও সেভেন্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিয়েও কোনও রোগী পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে, লাগুক না লাগুক চিকিৎসকরা যাতে নানা টেস্টের জন্য তাঁদের কাছেই রোগীদের রেফার করেন, সে জন্য নানা রকম উপঢৌকন এবং চোখ-ধাঁধানো ভেট পাঠাচ্ছেন প্যাথেলজির কর্ণধারেরা। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যেন কোনও এক মন্ত্রবলে এই রাজ্য থেকে উবে গেছে যাবতীয় অসুখ-বিসুখ।

এই অবস্থা দেখে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাড়াতাড়ি সেজেগুজে টিভি চ্যানেলগুলির সামনে হাসি হাসি মুখে গদ গদ হয়ে বলেছেন, আমি যদিও ওদের মতবাদকে বিশ্বাস করি না, তবুও মাও সে তুংয়ের মতো আমিও একদিন মনে মনে বলতাম, আমাদের দেশের ডাক্তাররা যে দিন খেতে পাবে না, সে দিন জানব, আমাদের দেশের লোকেরা সুস্থ আছে।

সেটা যে এত তাড়াতাড়ি ফলে যাবে আমি ভাবতেই পারিনি। তবে হ্যাঁ, সে জন্য ধন্যবাদ দিতেই হবে পুরসভাকে। কারণ, ওরা যে ভাবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ডেঙ্গির মোকাবিলা করছে, তাতে আমি অভিভূত। ওরা যে সম্প্রতি পরিশুদ্ধ জল সরবরাহ করছে, তার জন্যও রোগভোগ অনেকটাই কমে গেছে। আর ওরা যে ভাবে চার দিকে গাছপালা লাগিয়েছে, সন্তান স্নেহে লালন-পালন করছে, গভীর রাতে রাজ্যের লোক যখন ঘুমিয়ে কাদা, তখন পুরসভার লোকেরা রাতের পর রাত জেগে চারাগাছগুলোতে জল দিয়ে তাদের মহীরুহ করে তুলছে। সে জন্য তাঁদেরকেও আমি ধন্যবাদ জানাই। আর তার থেকেও বড় কথা, তাদের তদারকিতে রাস্তাঘাট এখন একেবারে ঝকঝকে তকতকে। কোথাও এতটুকু ময়লা জমতে পারে না। ফলে জলবাহিত রোগও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।

পাশাপাশি আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে পথেঘাটে কাটা ফল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। ফুচকাওয়ালারা পর্যন্ত কলের জলের বদলে এখন যে মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করছেন, হাতে মেডিকেটেড গ্লাভস পরে ক্রেতাদের ফুচকা দিচ্ছেন, সে জন্য তাঁদেরও আমি সাধুবাদ জানাই।

তবে হ্যাঁ, আমি এটাও আপনাদের আশ্বস্ত করছি, চিকিৎসা জগতের এই মন্দা পরিস্থিতি আর বেশি দিন চলবে না। আমরা চলতে দেব না। তবু যত দিন না সব কিছু আগের মতো হচ্ছে, আবার রোগ থাবা বসাচ্ছে লোকজনের ওপরে, অন্তত তত দিন চিকিৎসার সঙ্গে সামান্যতম হলেও যাঁরা এত দিন ধরে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন, এটাই ছিল যাঁদের একমাত্র রুটিরুজি, এই মুহূর্তে একটু বিপাকে পড়েছেন, তাঁদের আগাম জানিয়ে রাখছি, সত্যিই যদি এই পরিস্থিতি আরও কিছু দিন চলে, তবুও আপনাদের ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমরা আপনাদের ক্ষতিপূরণ দেব। ভর্তুকি দেব। আপনাদের গোটা পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে আমাদের রাজ্য সরকার।

দরকার হলে আপনাদের ছেলেমেয়েরা যে যেখানে পড়াশোনা করছে, তা ফ্রি করে দেওয়া হবে। পরিবার পিছু বিশেষ দৈনিক রেশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। বাসে-ট্রেনে যাতায়াতের জন্য ফ্রি পাস দেওয়া হবে। বছরে অন্তত দু’বার জামাকাপড়় বিলি করা হবে। আরও কী কী করা যায়, তা আমরা রাজ্যসভায় মন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনা করে স্থির করব।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শুনে আই এস, আই পি এস, ব্যরিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক থেকে শুরু করে নানা পেশাদারির তাব়়ড়় তাবড়় সফল ব্যক্তিরা পর্যন্ত আফসোস করছেন, কেন যে ডাক্তারিটা পড়়লাম না! তা হলে সব কিছুই ফ্রি-তে হয়ে যেত।

তাঁদের দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস।

সারা রাজ্যে এখন এই একটাই খবর। শুধু খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেলেই নয়, বাসে-ট্রামে, রাস্তাঘাটে, বাজার-হাটে, অফিস-কাছারিতে, চায়ের দোকানে লোকের মুখে মুখে এখন শুধু এই একটাই আলোচনা।

ঔপমানবের কাছে যাঁরা আসছেন, তাঁরাও এই একই বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। সবার একটাই প্রশ্ন, কী এমন হল যে, এক দিনের মধ্যেই এ রকম অভাবনীয় একটা ঘটনা ঘটে গেল!

যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানতেন, কিছু দিন আগে এ দেশের সব ক’টা রাজ্যে দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, কোন রাজ্যে দূষণের পরিমাণ কতটা ভয়াবহ, তা পরীক্ষা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে বিদেশ থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি-সহ ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছিল বেশ কয়েক জন দক্ষ পরিবেশবিদকে। তাঁদের দলের একজন নাকি ভুল করে ও দেশ থেকে আনা মাস্ক একদিন আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে এখানকার এক দোকান থেকে স্থানীয় একটা মাস্ক কিনে আর পাঁচজন কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন ডালহাউসির মোড়ে। কিন্তু তার পরেই বিপত্তি। আধ ঘণ্টা থাকার পরেই গাড়ির কালো ধোঁয়ায় তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হল। পরে দেশ ছাড়ার আগে তাঁরা লিখিত জানিয়ে গেলেন, কলকাতা শহরের মতো এমন দূষিত, বিপজ্জনক শহর পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

কিন্তু মাত্র ক’মাসের মধ্যেই এমন কী ঘটল যে, শুধু মাত্রাতিরিক্ত দূষণই নয়, দূষণের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রোগও এ রাজ্য থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে একেবারে ভোঁ ভাঁ হয়ে গেল। এটা জানার পরে শুধু ওই দেশের ওই পরিবেশবিদরাই নন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পরিবেশবিদরাও রাতারাতি ছুটে এলেন। তাঁদের বিশ্বাস, এখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে, যার জন্য এটা হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কী, কেউই তা আন্দাজ করতে পারলেন না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।