ক্যাফে ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজে সুব্রত সরকার (পর্ব – ২)

পাহাড় নদী অরণ্য – রোলেপ অনন্য

রংলী থেকে শেয়ার জিপে রোলেপ চলেছি। পথ সামান্য। মাত্র ১৬ কিমি। ৭০ টাকা ভাড়া।  কিন্তু পথের যা দূরবস্থা পিঠ, কোমড়, ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। পাহাড় জঙ্গল কেটে রাস্তা চওড়া হচ্ছে। কোথাও ডাবল লেন, কোথাও কোথাও ফোর লেন। তাই যথেচ্ছ পাহাড় জঙ্গলকে নিকেশ করা চলছে। এ দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে বড় কষ্ট হয়!

রংলী থেকে সভারী জিপ ছুঝাচেন, ব্যাঙডাঁড়া  পেরিয়ে এসে দাঁড়াল। একজন মহিলা উঠলেন তিনটে বাচ্চা সহ মোট চারজন। মাঝের সিটে আমরা ছিলাম দুজন। এবার হলাম ছ’জন। একেবারে ছয়ে ছক্কা! ফলে ঠাসাঠাসি গাদাগাদি হয়ে চললাম। গাড়ি তো কখনো দুলছে, কখনো লাফাচ্ছে। এভাবেই চলতে চলতে লোকডাঁড়া, ওস্তি পয়েন্ট পেরিয়ে এসে থামল লামাতেনে। পেছনের সিট থেকে দুজন যাত্রী নামল। লামাতেন ভুটিয়া গ্রাম। যে দুজন সহযাত্রী নামল তাদের চেহারায় ভুটিয়া ছাপ রয়েছে।

গাড়ি আবার সেভাবেই চলতে চলতে একসময় এসে আমাকে নামিয়ে দিল যেখানে জায়গাটার নাম নামগেজুং। তারপর আর গাড়ি যাবে না। কয়েক ঘন্টা আগে হঠাৎ ল্যান্ডস্লাইড হয়ে পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে। বিরাট বড় বড় পাথরে ছড়াছড়ি। রাস্তা হারিয়ে গেছে। গাড়ি আর যেতে পারবে না। অগত্যা বাকি প্রায় এক কিমি পথ এই পাথর টপকে, খাদের কিনার দিয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম হোম স্টের কাছে। রোশন রাই লজ্জিত হয়ে বলল, “সকালেও রাস্তা ঠিক ছিল। অচানক এই ধস নেমে গেল। ভেরি সরি, আপনার খুব পরেশানি হল।”

আমি তখন খুব ক্লান্ত। হাঁফাচ্ছি। কাঁসার গ্লাসে করে এক গ্লাস জল এনে দিল একটি হাসিখুশি বালিকা। সেই শীতল জল পান করে তৃপ্ত হয়ে হেসে বললাম, “মুসাফিরকে সব কিছু মানিয়ে নিতে হয়। নো প্রবলেম।”

বড় রাস্তা থেকে সামান্য নিচে ঢালু একটা পথ পেরিয়ে এসে এই ট্রাইবাল হোম স্টে।  অনেকটা ছড়ানো ফুলের বাগান ও  ফল -সব্জির বাগান সহ এই  নিজের বাড়ির বাইরে বাড়িটি খুব সুন্দর। আজ এখানেই আমার রাত্রিযাপন।

হোম স্টের দোতলায় আমার জন্য রাখা ঘরে ঢুকেই মন মাতাল হয়ে গেল, একদম হাত বাড়ানো দূরত্বে রংপো নদী আর রোলেপের পাহাড়- জঙ্গল। ভাবতেই পারি নি এমন গা ঘেঁষে থাকবে নদী, পাহাড় ও জঙ্গল। তাই মুগ্ধ হয়ে গিয়ে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুটা সময়। নদীর জলধ্বনি কান পেতে শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। এই ভুবনে কত বিচিত্র আনন্দ আছে, সব সময় আমরা তার স্বাদ নিতে পারি না। তার গন্ধে মোহিত হতে পারি না। তারজন্য দরকার হয় উপযুক্ত আবহ। কোনওভাবে সেই আবহে এসে একবার দাঁড়াতে পারলে, মনে হবে ধন্য জীবন!..”বাবুমশাই, জিন্দেগি লম্বা নেহি, বড়া হোনা চাহিয়ে!”..কানে ফিসফিস করে এই কথাগুলো কে যেন বলে চলে যাবে!..

এই আনন্দ অনুভূতি নিয়ে যখন লিভিং কাম ডাইনিং এ এসে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ দু-চোখ আটকে যায় রবীন্দ্রনাথের ছবিতে! পরিণত বয়সের সাদা কালো একটা ছবি। একইসঙ্গে বিস্ময় ও আনন্দ হল। এত দূরে সিকিমের এক অচেনা দুর্গম পাহাড়ের হোম স্টেতে রবীন্দ্রনাথের ছবি!..

পরে জেনেছিলাম এই হোম স্টের রুপকার রোশন রাই রবীন্দ্র ভক্ত এবং রবীন্দ্রনাথের গানও গায় সুন্দর। ভ্রমণে এই সব  অভিজ্ঞতা ও আবিস্কারের আনন্দ সব সময়ই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। মুগ্ধ করেছে। তাই কখনোই ভ্রমণ আমাকে ক্লান্ত করে না! আমি আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠি।

রোলেপের উচ্চতা কম বেশি সাড়ে তিন হাজার ফুট হবে।  সারাবছরই আবহাওয়া মনোরম  থাকে। এত শান্ত, নির্জন একটা গ্রামে চলে আসতে পেরে বেশ ভালো লাগছিল। এই ভালো লাগার আবেশ নিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ালাম বিকেলবেলাটা।

রোলেপে রাই, গুরুং, শেরপা, তামাং, ভুটিয়া মানুষজনদেরই বসবাস। রাই আদিবাসী বেশি। হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য । বাকিরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

রোলেপ আর পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের মতই শান্ত সুন্দর। পাহাড় নদী অরণ্য রোলেপকে অনন্য করে তুলেছে। চারপাশের ঠাস বুনোট জঙ্গল, খাঁড়া পাহাড় আর  রংপো খোলার জলনুপূরের ধ্বনী রোলেপে এসে মুগ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।  একবার এসে পড়তে পারলে  চট করে ফিরে যেতে ইচ্ছে হবে না!..

রোলেপ যেন এক পাখিগ্রামও! চিচিংকোটে( হামিং বাড়ড) পাখিরা সারাদিন গান গাইছে আর তিড়িং বিড়িং করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও পাখি দেখা যায় অনেক। রুপ্পিও খুব সুন্দর চিড়িয়া।

প্রজাপতিও আছে প্রচুর । ফুলে ফুলে প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে খুব দেখতে পেলাম। রোলেপে অর্কিড ও ফুল সব বাড়িরই সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে রেখেছে।

এখানকার বনে – পাহাড়ে একধরনের সবুজ বিষাক্ত সাপ আছে। সারাবছরই সাবধানে থাকতে হয়। সবুজ সাপের দংশনে মানুষ মারা যায় প্রতিবছরই।

রংপোখোলার জলে সিলভার টাউট মাছ খুব পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় সুস্বাদু ওসালা মাছ।

ফুল, পাখি, প্রজাপতি, নদী সব নিয়ে রোলেপ একটা খুশির প্রলেপ জড়িয়ে দেয় বেড়াতে আসা পর্যটকদের মনে। তাই রোলেপ ভ্রমণ স্মরণীয় হবেই হবে।

রোলেপ খুব ছোট্ট হলেও সব মিলিয়ে জনসংখ্যা প্রায় বারো তেরোশো। রোলেপের উল্টোদিকের পাহাড়ে সুন্দর তিনটে গ্রাম রয়েছে লাটুক, ঠেক, ছেচেনপোখরি। পায়ে হেঁটে ঘুরে আসতে পারলে ভালো লাগবে।

রোলেপে আসা মানেই সাইট সিয়িং কি কি আছে জানতে হবে, তেমন কোনও দরকার নেই। শান্ত হয়ে বসে রোলেপকে অনুভব করার, রোলেপকে আবিষ্কার করার আনন্দই বেশি।

রোলেপে একটা চা বাগান আছে। এই তথ্যটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুনলাম এখানে অর্গানিক পদ্ধতিতে হলুদ, বড় এলাচ, আদা ও কমলালেবু চাষ হয় খুব ভালো। প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে এদের নাম সর্বাগ্রে।

সন্ধ্যার নির্জনতায় চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে আছি অন্ধকার ছোট্ট বারান্দাটায়। হাত বাড়ানো দূরত্বে পাহাড়, গভীর জঙ্গল। নীচে রংপোখোলার গর্জন। চারপাশ নিস্তব্ধ। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। টিনের চালে বৃষ্টির নৃত্যনাট্য। বেশ ভালো লাগা তৈরী হল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আপনমনে বসে আছি। বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে। আকাশে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। “স্যার,মোমো।”

হঠাৎ কানে ভেসে এল এই ডাক। মোমো রেখে চলে গেল সেই পাহাড়ি বালিকা। ধোঁয়া ওঠা গরম মোমো। আর পাশেই এক পেয়ালা চা!..

কাঠবাংলোর ছোট্ট বারান্দাটার নির্জনতায় বসে বৃষ্টির গান শুনছি। রংপো খোলার জলধ্বনীও শুনছি। সন্ধেটা বড় মায়াবী হয়ে ধরা দিয়েছে।

এমন একটা সন্ধ্যা নিজেকে নিজেই উপহার দিলাম মনে মনে। “কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক হওয়া যায়!…. কতটা অপচয়ের পরে মানুষ চেনা যায়!.. প্রশ্নগুলো সহজ!.. উত্তরও তার জানা!..”

আজ এই অজানায় বসে সেই আনন্দ উপভোগ করতে করতে বললাম, “রোলেপ, এবার হাতে সময় বড় অল্প নিয়ে এসেছি, তাই সব গল্প আমাদের হোল না, আবার আসব তোমার কাছে, আসতেই হবে!..”

কিভাবে যাবেন –  নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে চলে আসতে হবে রংলি।

রংলি থেকে রোলেপ সামান্য পথ। নিজের ভাড়া করা গাড়ি বা শেয়ার জিপে আসা যায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *