ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || আফ্রিকার ডায়েরি-১ – সুব্রত সরকার

আফ্রিকা!..

একটা ছোট্ট শব্দ! অথচ কি ঝঙ্কার আছে শব্দটায়।
আফ্রিকা তো শুধু একটা জায়গার নাম নয়!.. বিরাট এক মহাদেশ। ৫৪ টা দেশ নিয়ে আফ্রিকা মহাদেশ। এই মহাদেশ জুড়ে রয়েছে ভ্রমণের হাজারো হাতছানি। শিহরণ আর রোমাঞ্চকর কত গল্প, সিনেমা, শিকার কাহিনি, সাহিত্য ও ভ্রমণকথা।
খুব ছোটবেলায় আমার হবি ছিল স্ট্যাম্প জমানো। জমিয়েও ছিলাম অনেক স্ট্যাম্প। সবচেয়ে বেশি জমিয়েছিলাম আফ্রিকার স্ট্যাম্প। উগান্ডা, ইথিওপিয়া, ঘানা, লিবিয়া,কঙ্গো, ইজিপ্ট – আফ্রিকার এমন কত দেশের স্ট্যাম্প আমার কালেকশনে ছিল। বন্ধুরা ঈর্ষা করত খুব। আফ্রিকা নিয়ে আমার একটা অবসেশন সেই ছেলেবেলা থেকে কি করে যে হয়ে গিয়েছিল জানি না!
তখনও আমি বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের গল্প জানতাম না। বুদ্ধদেব গুহর আফ্রিকার লেখাগুলো হয় নি। বুদ্ধদেব গুহ লেখক হিসাবে হয়তো তখন আত্মপ্রকাশও করেন নি। অনেক পরে তাঁর লেখা আমি পড়তে শুরু করি। বুদ্ধদেব গুহর প্রেমে পড়ি তাঁর “মহুল সুখার চিঠি” পড়ে। অসাধারণ এক পত্র- উপন্যাস। পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ পরিচয় হয়েছিল “শিলাদিত্য” সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে। খুব আনন্দ হয়েছিল পত্রিকার একই সংখ্যায় তাঁর পাশে আমারও লেখা থাকত। বুদ্ধদেব গুহ আফ্রিকা নিয়ে পরবর্তী সময়ে একাধিক জনপ্রিয় গল্প- উপন্যাস লিখেছেন। সে সব রোমাঞ্চকর গল্প-কথা পড়ে বহু পাঠক আফ্রিকায় যাওয়ার উৎসাহ পেয়েছেন, কেউ কেউ মানস ভ্রমণের আনন্দে শিহরিত হয়েছেন।
আফ্রিকা আমার ছেলেবেলাতেই কি করে যে স্বপ্নে চলে এসেছিল, আজও সে বিস্ময় যায় নি । আমাদের সেই কিশোরবেলায় ডিসকভারি চ্যানেল, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট ছিল না। আফ্রিকান সাফারি, বর্ন ফ্রি, স্নোজ অফ কিলিমাঞ্জারো, হাটারি সিনেমাগুলো দেখার সুযোগও হয় নি। তবু মনে মনে ভাবতাম, বড় হয়ে যাবই যাব আফ্রিকা। এমন দুঃসাহসিক স্বপ্নও দেখতাম!..
বড় হয়ে, বুড়ো হয়ে অবশেষে সেই আফ্রিকা মহাদেশের ইজিপ্টে ঘুরে আসা হয়েছে দু’বছর আগে। গিয়েছিলাম ভ্রমণ সংস্থা Travel Live এর সঙ্গে। তারপর জাপান ঘুরে এলাম এই পরিচিত Travel Live এর সুব্যবস্থাপনায়। তাই ওদের Animal Kingdom সফর সূচীর কেনিয়া- তানজানিয়া যাব বলে ভাবতে ভাবতেই জানতে পারলাম মেয়ে-জামাই পেপার পড়তে যাবে নাইরোবি। কেনিয়ার রাজধানী। আফ্রিকান লিটারেচারের ওপর ওদের পেপার। আমেরিকায় ওরা পি এইচ ডি করছে। জুন মাসে নাইরোবিতে পেপার পড়তে যাবে আমেরিকা থেকে কলকাতায় এসে। ফলে এ যেন মেঘ না চাইতেই জল!.. মন নেচে উঠল। ওদের সঙ্গে জুটি বেঁধে তাহলে একটু স্বাধীন ভাবে আফ্রিকায় ঘুরে আসা যায়! হয়তো একটু সস্তায়ও হবে!.. নিজেরা নিজেদের মত করে সফরসূচি সাজাব, বেড়াব, আনন্দ করব- এতো দারুণ মজার হাতছানি এসে গেল মনের দুয়ারে।

মেয়ে – জামাইয়ের ( ডুলুং- সোহম) সঙ্গে গতবছর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি চল্লিশ দিন। দারুণ হয়েছিল সেই সব ভ্রমণ। আমেরিকার কত বিখ্যাত বিখ্যাত জায়গা, নদী, সমুদ্র, বড় বড় সুন্দর শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই সব গল্প-কথা নিয়ে এগারো পর্বে “আমেরিকার ডায়েরি” ধারাবাহিক লিখেওছি এই অনলাইন পত্রিকায়(টেক টাচ টক)। বই হয়েও সেই “আমেরিকার ডায়েরি” বেরিয়েছে। মেয়ে – জামাইয়ের সঙ্গে বেড়ানোর মজাই আলাদা। বেশ স্বাধীন ভাবে মনের খুশিতে বিদেশে বেড়ানো যায়। আমি তো দেখার আনন্দে দেখে বেড়াই। ওরা বাকি জিনিসগুলো সুন্দর গুছিয়ে ট্যুরটাকে সার্থক করে তোলে। সাউথ আমেরিকায়ও ওদের সঙ্গে ঘুরতে যাব এমন একটা আগাম ভাবনা – পরিকল্পনা আমাদের হয়েও আছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা,পেরু, উরুগুয়ে, অ্যামাজনের জঙ্গল… আহা! সেও হবে এক স্বপ্নের ভ্রমণ!

ডুলুং-সোহম নাইরোবি যাবে, হঠাৎ করেই যখন এসে গেল এ সুসংবাদ! আমার তো তখন প্রাণ-মন তা তা থৈ থৈ, নাচে ছন্দে, নাচে আনন্দে দিবারাত্রি!..প্রস্তাব দিলাম, শুধু সেমিনার করে ফিরে আসবি কেন! একটু ঘুরেও আসবি। আমিও নয় সঙ্গী হব। সেই একটু ঘুরে আসাটা অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলো বারো দিনের আফ্রিকান সাফারি- কেনিয়া- তানজানিয়া সফরসূচী।

জুন মাসে আফ্রিকা যাওয়াটা একটু আগে যাওয়া হয়ে যাচ্ছে। কারণ তখন ঠিক মত মাইগ্রেশন শুরু হয় না। যাকে জঙ্গলপ্রেমীরা বলেন, ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’। জুলাই- অগাস্ট- সেপ্টেম্বর ভালো সময়। পিক সিজন। কিন্তু ওদের সেমিনার, পেপার পড়া জুন মাসে। নাইরোবি তে ২৫- ২৮ জুন সেমিনার। এই আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজক- African Literature Association. এবছরের সেমিনারের থিম- “Ecologies of Transition : Space and Mobilities in African Literature and Culture.”
ডুলুং পেপার পড়বে যে বিষয়ের ওপর তা হলো- “Understanding Extractive Modernity through Historical Interventions in Fiston Mwanza Mujila’s Novel Tram 83”.

সোহম এর বিষয় হলো – “Three Hundred years of ‘a/ historicity’: Reading Yaa Gyasi’s Homegoing as a Counter-narrative to 19th Century Colonial Literature of the British Empire.”

খুব ছোটবেলা থেকে “আফ্রিকা”নামটার সঙ্গে একাত্ম করে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তী ও পুজোর পর বিজয়া সম্মিলনীগুলোতে আবৃত্তিকারদের প্রিয় কবিতা ছিল “আফ্রিকা।” জলশা জমে যেত আফ্রিকার সেই দীপ্ত পংক্তিগুলো শুনলে –
“উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগ
স্রষ্টা যখন নিজের সৃষ্টির প্রতি অসন্তোষে
নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত
তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন- ঘন মাথা নাড়ার দিনে
রুদ্র সমুদ্রের বাহু
প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমাকে, আফ্রিকা-
বাঁধল তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়
কৃপণ আলোর অন্ত:পুরে।”

এভাবে কবিতাটা বারবার শুনতে শুনতে আমার মধ্যে একটা আফ্রিকা- আবেগ জন্ম নিয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশবাদ শব্দগুলোর অর্থ একটু একটু করে শিখছিলাম। ইটালির ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির ইথিওপিয়ায় অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানোর জন্যই যে ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ “আফ্রিকা” কবিতাটা
রচনা করেছেন তাও পরবর্তী সময়ে জেনেছি। অমিয় চক্রবর্তী কবির এই কবিতা বিশ্বের বহু গুণীজনদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এবং অনেকেই “আফ্রিকা” কবিতার অনুবাদ করেছেন। সুতরাং এই সব মিলিয়ে আফ্রিকা এক নীরব নিমন্ত্রণ ছিল আমার জীবনে!..
এই এত বছর পর, বালাই ষাট জীবনে পৌঁছে সেই – ” হায় ছায়াবৃতা
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানব রূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে। ” তার কাছে যাব বলে নিজের ঘর ছেড়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছি। পা বলছে,’ চলো যাই!.. মন বলছে, চরৈবেতি চরৈবেতি!..’
আফ্রিকা মহাদেশের খুব প্রিয় দুটো দেশ কেনিয়া- তানজানিয়া যাচ্ছি। যাত্রা শুরু ১৯ জুন, বৃহস্পতিবার। কলকাতা থেকে ইন্ডিগোর বিকেলের উড়ানে মুম্বাই। তারপর গভীর রাতের উড়ানে মুম্বাই থেকে নাইরোবি। ভোরের প্রথম আলোয় নামব আফ্রিকার মাটিতে। নাইরোবিতে অপেক্ষা করবে আমাদের গাইড ও ট্যুর অপারেটর। শুরু হবে আমাদের আফ্রিকান সাফারি!..
ও লে লে লে… ও লা লা লা… ও লে লে লে…!..

 

ক্রমশ..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *