ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ১৩

আমেরিকার ডায়েরি – ১৩
।। লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স – ০১ সেপ্টেম্বর, রবিবার।।
বিদায় শিকাগো!..প্রণাম স্বামীজি!..
ভোর রাতে হোটেল থেকে বেরিয়ে উবেরে উঠলাম। যাব শিকাগোর ও’ হেয়র
এয়ারপোর্টে। আজ আমরা তিনজন তিনদিকে উড়ে যাব। ডুলুং সাউথ ক্যারোলাইনায়। সোহম সিরাকিউজ। আমি নিউ অরলিন্স। তিনজনের বিমানই অল্প সময়ের হেরফেরে টেক অফ করবে।
ভোরের শিকাগোর পথ ঘাট নিঝুম। তবু কিছু মানুষজনকে দেখলাম। তাঁরা রাত জেগে পার্টি করে ফিরছে হোটেলে। গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে তিনদিনের ছুটির হুল্লোড়। শনি- রবি সাপ্তাহিক ছুটি। সোমবার পাওয়া গেছে লেবার ডের ছুটি। আনন্দে-আহ্লাদে আটখানা সবাই।
শিকাগোর হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট প্রায় পঞ্চাশ মিনিট লাগল। আমার টার্মিনাল আলাদা। ডুলুং সোহমের একই টার্মিনাল। এবার আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আমি আটদিনের জন্য একা হয়ে যাব। আমেরিকার অচেনা অজানা পথে পথে ঘুরে বেড়াব। একটু কি শঙ্কা হচ্ছে না! হচ্ছে!..কিন্তু বেশি ভাবলে ভয় চেপে বসবে।
ডুলং বলল, “চলো তোমায় চেক ইন করিয়ে দিই।”
আমার আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমান। চেক ইন করে ঢুকে গেলাম। তার আগে তিনজনে একটা সেলফি তুলে গুডবাই বলে নিয়েছি। চেক ইন হয়ে ওদের টা টা করে দিলাম। ওরা চলে গেল। আমি একা হয়ে গেলাম। এই মুহূর্তটা খুব মনে রয়ে যাবে সারা জীবন। কেমন একটু যেন করেছিল বুকের ভেতরটা। ভয় মায়া আশঙ্কা কষ্ট সব নিয়ে একটা অনুভব!
এবার আমায় চার চোখে চলতে হবে। একা একা বিদেশ ভ্রমণ- সব সময় সতর্ক ও সাবধানে থাকো। আমার গেট খুঁজে চলে গেলাম নির্দিষ্ট জায়গায়। হাতে অনেকটা সময় আছে। সকালে চা খাওয়া হয় নি। নেশার জিনিস সকালের চা। তাই আগে খাওয়া দরকার। কিন্তু আমি তো আমেরিকায় আসার পর থেকে কোনও দোকানে অর্ডার দিয়ে ডলার ভাঙিয়ে কিছু কিনি নি। ডুলুং সোহম কয়েকটা ফুড চেইনের নাম বলে দিয়েছে, যেগুলো একটু সস্তা ও আমার খাওয়ার মত জিনিস পাওয়া যাবে। ওরা হলো- McDonald’s, Burger King, Dunkin Donuts, Starbucks, Subway, Wendy’s, Panda Express। একটু খুঁজেই পেয়ে গেলাম McDonald’s। এগিয়ে গেলাম দোকানের কাছে। খাবারের নাম ও দাম লেখা আছে বোর্ডে। অর্ডার দিলাম লাটে টি ও এগ চিজ বার্গার। দাম পড়ল এগারো ডলার পঞ্চাশ সেন্ট। ডলার রেখেছি সাবধানে। ডুলুং ওর আমেরিকান ক্রেডিট কার্ডটা দিয়ে বলেছে “ঠিক করে রাখবে। দরকার মত ব্যবহার করবে। কোনও পিন এদেশে লাগে না। হারিয়ে গেলেই বিপদ। যে পাবে তার।” আমি কার্ড ও পাসপোর্ট সাবধানে রেখেছি। দুটোই মহামূল্যবান। আপাতত ডলার ভাঙিয়ে চলুক।
শিকাগো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে একটু হেঁটে বেড়ালাম। শপিংও করলাম। কিনলাম নিজের জন্য একটা সোয়েটশার্ট। বুকে লেখা শিকাগো! স্মৃতি হয়ে থাকবে। দাম পড়ল বাইশ ডলার।
আজ নিউ অরলিন্স যাচ্ছি। লুইজিয়ানার এই সুন্দর জায়গাটা ঘুরে চলে যাব ব্যাটন রুজ। লুইজিয়ানার রাজধানী। ব্যাটন রুজ থেকে আমার পরিচিত প্রিয়জন দেবযানী ঘোষ আসবেন এয়ারপোর্টে । অন্যভুবন এর একজন আপনজন দেবযানীদি। আগামী দু’দিন ওঁর বাড়িতে থাকব। লুইজিয়ানার কিছুটা দেখব, বেড়াব, আনন্দ করে চলে যাব ফ্লোরিডার মায়ামিতে।
আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর বিমান সময় মত ছাড়ল। কোনও লেওভার নেই। আড়াই ঘন্টার জার্নি। কপালগুণে এবারও আমার সিট জানলার ধারে। দেখলাম সব সিট ভরে নি। কিছু ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আমার পাশের সিটটাই ফাঁকা। তার পাশের সিটে এসে বসলেন একজন অ্যাফ্রো আমেরিকান যাত্রী। সে বসেই কেমন ঘুমিয়ে পড়লেন। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। ভেবেছিলাম একটু গল্প করব। হলো না!..
বিমান টেক অফ করে যখনই মহাশূন্যে ভাসতে শুরু করে সেই মুহূর্তটা আমার খুব প্রিয়। তারপর যখন একটু স্টেডি হয়ে চলতে শুরু করে সেটা মেনে নিয়ে বসে থাকা আর কি। আজ আমি একা। এতদিন পাশে ডুলুং-সোহম ছিল। কথা বলেছি। গল্প করেছি। এখন আকাশ পানে চেয়ে বসে আছি বিমানের পুচকে জানলাটার পাশে। কোথায় আমার বাড়ি সেই ব্রহ্মপুর! কলকাতা-৯৬!..আর আমি এখন কোথায় কোন মহাশূন্যে ভাসছি…অচেনা অজানা এক মহাদেশ আমেরিকার অচিন আকাশে!..পাশে চেনা কেউ নেই!.. এতো নিছকই বেড়ানোর আকর্ষণে এত দূর মহাদেশে চলে আসা!..মেয়ের সাথে এসেছি, মেয়ের কাছে আর থাকছি কতটুকু! মন মোর মেঘের সঙ্গী হয়েই উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার জীবনেই কিছু স্বপ্ন থাকে, সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। মেনে নিতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়। আমারও অনেক স্বপ্ন পূরণ হয় নি। কষ্ট পেয়েছি। মানিয়ে নিয়েছি। মেনেও নিয়েছি। কিন্তু একটা স্বপ্ন আমার অনেকটা পূরণ হয়ে চলেছে.. তা হল ভ্রমণ। দেশ ভ্রমণ। বিদেশ ভ্রমণ। আমার দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। অনেকটা ঘুরে দেখেছি নিজের প্রিয় দেশটাকে । বাকিগুলোও দেখব। বিদেশ ভ্রমণেরও একটা ইচ্ছে-তালিকা রয়েছে। শুরুও করেছি…বাংলাদেশ, নেপাল, মিশর হয়ে গেছে।
এবার আমেরিকায় আমার চর্তুথ বিদেশ ভ্রমণ চলছে। এ আমার পরম পাওয়া। চরম আনন্দ!..হে মহাজীবন, তোমাকে প্রণাম!..
নিউ অরলিন্সের মাটি ছুঁয়ে যখন আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমান অবতরণ করল আকাশ বেশ ঝলমলে। জেটয়েজ দিয়ে বাইরে এসে লাউঞ্জে দাঁড়ালাম। মোবাইল ওয়াইফাই তে কানেক্ট করে ডুলুংকে মেসেজ করে দিলাম “সেফ ল্যান্ডিং নিউ অরলিন্স ” সাথে একটা স্মাইলি!..এবার ধীরে সুস্থে এক্সিট খুঁজে নিয়ে বাইরে এলাম। আমাকে বলা হয়েছে, লাগেজ কালেকশন এর কাছে দাঁড়াতে। চলে এলাম সেখানে। কিন্তু দেবযানীদিকে দেখতে পেলাম না। ভুল করে অন্য জায়গায় দাঁড়াই নি তো!.. ফোন করলাম। “চলে এসেছেন!. জাস্ট দশ মিনিট, আমরা আসছি।” আমি দশ মিনিট সময় হাতে পেয়ে গেলাম এয়ারপোর্টের বাইরেটা একটু দেখে নেওয়ার জন্য।
বেশ সুন্দর করেই সাজানো বাইরেটা। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সর্বত্র। এই ব্যাপারে গোটা দেশটা একদম দশে দশ। বসার জায়গাগুলো সুন্দর করে বানানো। একজায়গায় একটা বোর্ড দাঁড় করানো আছে। কাছে গিয়ে দেখলাম -LOUISIANA CIVIL RIGHTS MUSEUM এর একটা অনুষ্ঠানের কথা লেখা- THE INAUGURAL EXPERIENCE, 3 rd & 4th September
LOUISIANA STATE MUSEUM ।
আমি তো থাকব এখানে আজ ও কাল। অর্থ্যাৎ ১ ও ২ সেপ্টেম্বর। এই এক্সপেরিয়েন্সটা নাহলে নেওয়া যেত।
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় দেখলাম দেবযানীদি আসছেন। কাছে এসে বললেন, “সরি দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হলো আপনাকে!..”
আমিও হেসে বললাম,”এই দশ মিনিটে তো চারপাশটা দেখে নেওয়ার একটু সুযোগও পেয়ে গেলাম।”
তারপর দেবযানীদির সঙ্গে আসা দুজনের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন, “আমার হাজব্যান্ড সুজয়। ছোট ছেলে সৌরিশ। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। ও স্কটল্যান্ডে পড়াশোনা করছে। আর এই হল সুব্রতদা। অন্যভুবন এর সুব্রতদা।”
“অন্যভুবন এর সুব্রতদা!”…এটা আমার এক নতুন পরিচয় হয়েছে। আজ বড় ভালো লাগে, বড় আনন্দ হয়, “অন্যভুবন” আমাকে একটা অন্য জীবন দিয়েছে। আমার চেনা জানার জগৎটা কত বড় হয়ে গেছে। কত মানুষের ভালোবাসা, আশীর্বাদ, স্নেহ- মমতা, সাহায্য-সহযোগিতা আজ আমি পাই। একজন থেকে আরেকজন আমার চেনামহলের প্রিয়জন, বন্ধুজন হয়ে উঠছেন। দেবযানীদি আমার কথা জেনেছিলেন মৌসুমীদির কাছে। তারপর যোগাযোগ হয় আমাদের। এরপর দেবযানীদি অন্যভুবন এর প্রিয়জন হয়ে ওঠেন আরও অনেক প্রিয়জনদের মতই। আজ সেই সূত্র ধরেই এতদূরে কেমন চলে এসেছি!..
আলাপের পর সুজয়দা বললেন, ” চলুন। গাড়ি সামনে আছে।”
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে সুজয়দা বসলেন। পাশের সিটে দেবযানীদি। আমি আর সৌরিশ পেছনের সিটে বসলাম। শুরু হল আমাদের পথ চলা!..
এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চলে এলাম নিউ অরলিন্স এর সেরা জায়গা ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারে। এখানে আসার আগে যতটুকু যা পড়াশোনা করেছিলাম তা থেকে জেনেছিলাম, এ এক প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যশালী শহর। এ শহরের আকর্ষনে সারা পৃথিবীর পর্যটকরা ছুটে ছুটে আসেন। আজ থেকে তিনশো বছর আগে ১৭১৮ সালের ৭ ই মে ফ্রেঞ্চ মিসিসিপি কোম্পানি এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিল। ডিউক অফ অর্লিন্স- ফিলিপ ডি অরলিন্স এর নামে এই শহরের নাম LA nouvelle orleans বা নিউ অরলিন্স।
নিউ অরলিন্স অনন্য তার জ্যাজ সঙ্গীতের জন্য। জ্যাজ মিউজিক এই শহরকে প্রাণবন্ত করে আজও রেখেছে। অলিতে গলিতে, বাড়ির পোর্টিকোতে, পাবে, বারে, নাইট ক্লাবে, পথের মোড়ে মোড়ে স্যাক্সোফোনে জ্যাজ মিউজিক বাজছে শোনা যায়। শহরের তরুণ তরুণীরা গিটারে জ্যাজ বাজিয়ে পাড়া মাতিয়ে রাখে। বিউগল বাজিয়ে কত লোক যে আনন্দ করে দেখে অবাক হয়েছি। আবার একর্ডিয়ানে সুর তুলে কোনও নিঃসঙ্গ মানুষ রাস্তার ধারে বসে বাজাচ্ছে দেখে শুনে মুগ্ধ হয়েছি। নিউ অরলিন্স এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত জ্যাজ শিল্পী লুই আমস্ট্রং এর নাম।
ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারে ঢুকেই বুঝলাম চলে এসেছি সিটি অফ জয়তে। চারপাশে সব রঙিন মানুষ। আজ রবিবার- ছুটি। আগামীকাল লেবার ডে- ছুটি। তো পায় কে!..হুল্লোড়ে হিল্লোলে মাতোয়ারা মানুষজন। জ্যাজ মিউজিকে সরগরম রাস্তাগুলো। মহিলাদের তো সাজপোশাক দেখার মত উজ্জ্বল ঝলমলে। যদি তোমার মনে কোনও রিজার্ভেশন থাকে, সাবেকি ধ্যান ধারণায় আবদ্ধ থাকো, তবে তোমায় চোখ বন্ধ করতে হতে পারে মাঝে মাঝেই। কেননা ওরা উন্মুক্ত নগরীর নীলনয়না সুন্দরীর দল! লজ্জা পেতে পারো তোমার সামনে এসে দাঁড়ানো নগর নটীদের দেখে। আর তুমি যদি মনে করতে পারো, এসেছি তো নিউ অরলিন্সে!.. চোখে অত আতস কাঁচ রাখব কেন! তাহলে তুমি একজন প্রকৃত পর্যটকের মত আনন্দ করো। দুচোখ ভরে দেখো- জীবন কত মধুর। জীবন কত আনন্দের। ওরা এভাবেই বাচঁতে ভালোবাসে। বাঁচো বাঁচার আনন্দে!..
আমাদের গাড়ি পার্কিং জোনে রেখে লাঞ্চ করতে ঢুকলাম এক রেস্টুরেন্টে। সুজয়দারা আগে এসেছেন অনেকবার নিউ অরলিন্সে। তাই সব মোটামুটি চেনা। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই একটা পুরোনো দিনের গন্ধ পেলাম। লাল ইটের দেওয়াল। পরিপাটি করে সাজানো। চেয়ার টেবিল ক্রকারিজ সব সব কিছুই মনকে ছুঁয়ে গেল। অর্ডার নিয়ে চলে গেল যে সেও কি সুন্দর কথা বলে গেল। এখানকার খাবারেরও একটা বিশেষত্ব আছে। ক্রেওল ও কেজন্ এই দুই অভিনব ঘরানার সংমিশ্রণে তৈরী হয় খাবার। এই দুই ধারা হল ফরাসী ও স্প্যানিশের মিশ্রণ। এছাড়াও আছে ইউরোপিয়ান, মেডিটেরিনিয়ান, নেটিভ আমেরিকান ও আফ্রিকান ঘরানার খাবার। নিউ অরলিন্স এর সি ফুড বিখ্যাত।
আমি ভ্রমণ পিপাসু মুসাফির। বেড়ানোর একটা বড় মজা হল খাবার। যখন যে জায়গায় যাও সে খাবার চেখে দেখার সুযোগ হারাতে নেই। কিন্তু আমি খুব খাদ্যরসিক নই। সব খাবারের নাম জানি না। আগেই হাত তুলে বলি, “যেটা মনে হয় ভালো বলতে পারো আমার জন্য। আমি টেস্ট করে দেখব।”
সুজয়দা অর্ডার দিয়েছিলেন, Gumbo Zambelaya, ক্যাটফিস রোল, শ্রিম্প অ্যান্ড গ্রিটস। সবাই মিলে বেশ আনন্দ করেই খেলাম। খাবারগুলো সুস্বাদু তো বটেই। খেয়ে বেশ তৃপ্তি হলো।
এবার হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মিসিসিপির পাড়ে। সেই মিসিসিপি!..ছোটবেলা থেকে বইয়ের পাতায় এর নাম পড়েছি। আজ প্রথম দেখলাম। মিসিসিপি নামটার মধ্যেই কেমন যেন আকর্ষণ আছে। মিসিসিপির ওপর একদম অবিকল আমাদের হাওড়া ব্রিজের মত একটা সেতু দেখতে পেলাম। আমাদের হাওড়া ব্রিজের সেতু খুব বড়সড়, মিসিসিপির এই সেতু তুলনায় ছোট। নদীর ধারে অনেকটা সময় কাটালাম। নদীর জলে ছোট জাহাজ, লঞ্চ ও টুরিস্টদের জন্য সাজানো ক্রুজের ব্যবস্থা দেখলাম। মিসিসিপি নিউ অরলিন্সকে বাড়তি সৌন্দর্য দান করেছে।
মিসিসিপি নদীর ধারেই রয়েছে দুটো সুন্দর অ্যাকোরিয়াম। Audubon Aquarium, Audubon Insectarium। টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হলো। টিকেটের মূল্য ৪০ ডলার। এই দুটো অ্যাকোরিয়াম এক কথায় অপূর্ব। প্রাণীজগতের কত বৈচিত্র্য ও ইকো সিস্টেম এর ছবি দিয়ে এত সুন্দর করে সাজানো যে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ফিস অ্যাকোরিয়ামের তো কোনও তুলনা হয় না। কত রকমের ফিস যে রয়েছে এবং তাদের সংরক্ষণের পদ্ধতি দেখে অবাক হতে হয়। প্রজাপতিদের ঘর বাড়িটাও মজার। বাটারফ্লাই গার্ডেন। কয়েকশো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। এই দুই অ্যাকোরিয়াম দেখা একটা এডুকেশন টুর মনে হয়েছে। কত সুন্দর সুন্দর কথা লেখা রয়েছে দেখলাম- Insects are Eco Engineers / Louisiana ‘s official State insect is the Honey Bee / Scientists have calculated that the weight of all ants on Earth is greater than the weight of all people / Amazon Rain Forest / Amazon River Life/ American Alligators are essential to Louisiana wetlands- and are protective parents।
খুব ভালো লাগল দেখে এই দুই অ্যাকোরিয়াম।
বিকেল হয়ে এসেছে। একটু চা চা করছিল প্রাণটা। সুজয়দা নিয়ে গেলেন এখানকার বিখ্যাত “Cafe du Monde”/ ক্যাফে ডু মন্ডে তে। খানিকটা আমাদের কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের মত। মিসিসিপি নদীর ধারে শহরের বড় রাস্তার ওপর কফি হাউস। এই ক্যাফে ডু মন্ডে সেই ফরাসী আমল থেকে চলে আসছে। তাই তার ঐতিহ্য ও আকর্ষণ রয়েছে। এখানকার বিখ্যাত হল কালো কফি ও বেনিয়ে। দেখলাম প্রায় সব টেবিলেই কফি ও বেনিয়ে রয়েছে। খেয়ে মনে হয়েছে এটা ময়দা জাতীয় কিছু দিয়ে বানানো এক ধরণের পিঠে, তার ওপর চিনির সাদা গুড়ো ছড়ানো। একদম পাউডার মাখানো মনে হয় দেখলে। খুব যে ভালো খেতে তা মনে হয় নি। এখানে বসে কফি খেতে খেতে জ্যাজ মিউজিক শোনা বাড়তি প্রাপ্তি।
ক্যাফে ডু মন্ডে থেকে বেরিয়ে জ্যাকশন স্কোয়ারে এলাম। এখানকার বিখ্যাত St. Louis Cathedral দেখলাম। জ্যাকশন স্কোয়ারের ছোট্ট বাগানটা ঘুরে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে গেল কয়েকটা কলা গাছ। কি সুন্দর মোচা সহ কলার কাঁদি ঝুলছে। দেখে খুব মজা পেলাম। আমেরিকায় এসে আমাদের দেশের পরিচিত অনেক জিনিস দেখেছি- চড়াইপাখি, কাশফুল, রক্তকরবী। আজ দেখলাম মোচা ও কাঁচকলা।
এবার হর্স ক্যারেজ রাইড করলাম। দারুণ সুন্দর এক MULE CART। মিউল হল ঘোড়া ও গাধার সংমিশ্রণে জাত এক পশু। আমাদের দেশে যাকে খচ্চর বলি, এদেশে বলে মিউল। আমাদের খচ্চররা দেখতে মোটেই সুশ্রী হয় না। কাজে হয়তো দক্ষ। কিন্তু এদেশের মিউলকে দেখে আমি মুগ্ধ। কি রাজকীয় সুন্দর চেহারা। আর আমরা যে মিউল কার্টটা নিয়েছিলাম, তার মালকিন মেয়েটি এই মিউলকে বড় যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। তাই ওর মিউলকে দেখেই গাড়ি পছন্দ হয়ে যায়। এই মিউল কার্টে করে আমরা French Quarter এর অলি গলিগুলো সুন্দর ঘুরে বেড়ালাম। কয়েকটা রাস্তার নাম ছিল St. Philip, St. Peter, St. Louis, Burgundy…। এই মিউল দৌড়ে দৌড়ে চলেছে আর ওর মালকিন মেয়েটি সুন্দর ধারাবিবরণী দিয়ে French Quarter এর ইতিহাসের গল্প বলে যাচ্ছে। শুনতে শুনতে সেই অতীত দিনের অন্য আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিলাম। এই ছোট্ট ভ্রমণটা খুব স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁয়েছে। নিউ অরলিন্সও এক ঘন্টা পিছিয়ে থাকে আমেরিকান ইস্ট কোস্ট টাইম জোন থেকে।৷ এবার আমরা ফিরে যাব ব্যাটন রুজ।
নিউ অরলিন্সে আরও অনেক অনেক কিছু দেখার ছিল। কিন্তু এই একদিনে সব আনন্দ কুড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। Daytime Jazz Cruises, Evening Jazz Cruises, Steamboat Stompers এর মত সুন্দর বেড়ানোগুলো একটাও করতে পারলাম না। আরও ছিল Oak Alley Plantation, Whitney Plantation, Airboat Swamp Adventure।
নিউ অরলিন্সকে দেখতে জানতে বুঝতে হলে তিন চারদিন থাকা দরকার। এমন একটা শহরে ছ’ সাত ঘন্টা থেকে এই শহরের যতটুকু দেখা সম্ভব, সুজয়দা- দেবযানীদি সুন্দর ভাবে করিয়েছেন। ওঁদের আন্তরিকতার কোনও তুলনা হয় না।
নিউ অরলিন্স এমন একটা শহর যার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেক গল্প আছে- উইলিয়াম ফকনার এই French Quarter-এ বসে তাঁর প্রথম উপন্যাস লিখেছিলেন। ও হেনরিও এখানে বসে সাহিত্য রচনা করেছেন। টেনেসি উইলিয়ামসের বিখ্যাত নাটক” A Streetcar Named Desire” লিখেছেন এখানে এসেই। কথিত আছে Uncle Tom’s Cabin উপন্যাসের অকশন এখানেই হয়। এই এত সব কিংবদন্তীর গল্প নিয়ে নিউ অরলিন্স অসাধারণ অপূর্ব। মন কেড়ে নেয়। মায়ায় জড়িয়ে যায় ভ্রমি হৃদয়!..
।। ব্যাটন রুজ এর পথে…।।
নিউ অরলিন্স থেকে বেরিয়ে প্রায় দু’ঘন্টার টানা লং ড্রাইভে ব্যাটন রুজে এলাম। আসার পথে লম্বা এই ইন্টার স্টেট হাইওয়ের দু’পাশের জঙ্গল দেখতে দেখতে এসেছি। আর দেখেছি বিরাট বিস্তৃত এক জলাশয়- গল্ফ অফ মেক্সিকো। এই স্টেট হাইওয়ে ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত চলে গেছে। লম্বায় ৩৯৫৯ কিমি। আমেরিকার চতুর্থ দীর্ঘতম হাইওয়ে।
ব্যাটন রুজে ঢুকতে নটা বেজে গেল। আমরা সরাসরি বাড়ি না গিয়ে চলে গেলাম ব্যাটন রুজ মার্কেট এরিয়ায় – শেরউড প্লাজা। ডিনার করে একবারে বাড়ি ঢুকব। “এশিয়ান সি ফুড হাউস”খুব ভালো চাইনিজ রেস্তোরাঁ। বেশ বড় সাজানো গোছানো চাইনিজ রেস্তোরাঁ। ডিনারের অর্ডার এবার সৌরিশের দায়িত্বে ছেড়ে দিলেন সুজয়দা।
সৌরিশ খাদ্যরসিক। ও বেশ সুন্দর সুন্দর ডিশ ঠিক করল। আমাকে একবার বলল, “আঙ্কেল তুমি ‘ডাক’ খাবে?” অনেকদিন খাই নি ডাকের মাংস। একসময় সুন্দরবনে নিয়মিত যেতাম। তখন হাঁসের মাংস খুব খেয়েছি। তাই আজ বললাম, “খাব। অনেকদিন খাই নি।” অর্ডার দেওয়া হলো স্টাটারে এগ ড্রপ সুপ। মেন কোর্সে – পিকিং ডাক, গার্লিক এগপ্ল্যান্ট(বেগুন) ফ্রাই, শ্রিম্প রাইস। এবং পাইন অ্যাপেল চিকেন উইথ শ্রিম্প( চিংড়ি মাছ)।
ডিনার খেয়ে খুব ভালো লাগল। সুন্দর রান্না। সৌরিশকে ধন্যবাদ দিলাম সুন্দর মেনু সিলেকশনের জন্য। ও খুব কম কথা বলে। ধন্যবাদ শুনে শুধু হাসল। লাজুক হাসি।
এখানকার রেস্টুরেন্টে বেঁচে যাওয়া বাড়তি খাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বাক্সগুলো দেয় তা সব থার্মোকলের। ইন্ডিয়ানাপোলিসের লাফায়েতে সেদিন থাই রেস্তোরাঁয়ও দেখেছিলাম বাড়তি খাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়েছিল থার্মোকলের বাক্স। আমরা তো থার্মোকল ব্যবহার বর্জন করেছি। বারণ করা হয় সবাইকে। কিন্তু আমেরিকায় কি করে থার্মোকলের এমন দেদার ব্যবহার সবাই করছে জানি না!..
আমাদের গার্লিক এগপ্ল্যান্ট ফ্রাই অনেকটা বাড়তি হয়েছে। তাই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থার্মোকলের বাক্সে ভরে।
এশিয়ান সি ফুড হাউস থেকে বেরিয়ে এসে খোলা আকাশের নিচে একটু দাঁড়ালাম। আশপাশেও কয়েকটা দোকান আছে।, ডলার ট্রি, এশিয়ান সুপার মার্কেট, ভিয়েতনামি ফুড স্টল, গ্যাস স্টেশন।
এবার বাড়ির পথে। সকলেই ক্লান্ত। ড্রাইভিং সিট বদল হলো। স্টিয়ারিং এ বসল সৌরিশ। সুজয়দা আমার সাথে পেছনে। বাড়ি আর বেশি দূরে নয়। মিনিট পনেরো লাগবে “লেকশোর গার্ডেনে” পৌঁছাতে। ওখানে দেবযানীদিদের বাড়ি।
সৌরিশ সুন্দর ড্রাইভ করছে। আমি সুজয়দার কাছে ব্যাটন রুজের গল্প শুনছি। রাত হয়েছে। সময় বেশি লাগল না লেক শোর গার্ডেনে আসতে। বাড়ির লনে এসে গাড়ি ঢুকতেই দেখলাম চিচিং ফাঁক- গ্যারাজের গেট উঠে গেল!.. এখানেও সেই ইন্ডিয়ানাপোলিসের মামাদাদুর বাড়ির রিমোট কন্ট্রোল!.. এই ব্যবস্থাটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
আজ সারাদিন অনেক বেড়ানো হলো। খেলামও কত কিছু। খুব আনন্দ পেয়েছি নিউ অরলিন্সে বেড়িয়ে। আগামীকাল সকালটা বিশ্রাম। দুপুরে আবার হবে ছোট্ট ভ্রমণ। ডিনারে নিমন্ত্রণ রয়েছে দেবযানীদিদের এক বন্ধু – শম্পাদির বাড়িতে। সেখানে আরও কয়েকজন বাঙালি বন্ধুরা আসবেন। আলাপ পরিচয় হবে।
সেই ভোরে উঠে শিকাগো থেকে বেরিয়ে আকাশপথে চলে এসেছিলাম নিউ অরলিন্স। তারপর থেকে শুধুই ঘুরে বেড়ালাম। স্নানের সুযোগ হয় নি। এবার ক্লান্ত শরীরে ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ হবো। শুদ্ধ হবো। এই বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে প্রতিটা দিন অক্লান্ত হয়ে ঘুরছি..কত বড় বড় জার্নি করছি, ঠিক মত স্নান খাওয়া ঘুম হচ্ছে না! তবু বেড়ানোর নেশায় আমি মাতাল হয়ে থাকি। এ যেন জীবনানন্দের কবিতার মত… “আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন..”
এখন শুধু দু’চোখ জুড়ে ঘুম!.. রাত নিঝুম!..
শুভরাত্রি!..
এখানে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে না। অত পাখি দেখি নি।
রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। তাই সকালে সময়মতই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।
বাইরে ভোরের আলো। বাড়ির লনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সকালের নরম আলো বাগানের গাছগুলোয় লুটিয়ে পড়েছে।
দেবযানীদি মর্নিং ওয়াক করেন। আজ তাঁর সাথে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ির পাশেই রয়েছে ছোট্ট এক লেক। লেকটা প্রদক্ষিণ করলাম। লেকের জলে অনেক রাজহাঁস দেখলাম। শান্ত চারপাশ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। নির্জন নীরব নিঝুম এক পাড়া। গোটা আমেরিকায় তিন ধরণের দূষণ নেই বললেই চলে- শব্দ দূষণ, দৃশ্য দূষণ ও পরিবেশ দূষণ। এখানকার আকাশ বাতাস সব সময় খুব ঝলমলে নির্মল থাকে। ফলে শরীর থাকে চনমনে। পরিশ্রম করা যায়।ক্লান্তি চট করে আসে না।
মর্নিং ওয়াক করতে করতে অনেক প্রতিবেশীর বাড়ির খোলা লন দিয়ে আসার সময় দেখলাম সকালের খবরের কাগজ প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে রাখা রয়েছে। এমন একটা কাগজের নাম ADVOCATE।
কতদিন খবরের কাগজ পড়ি না। কাগজ পড়া আমার এক নাছোড় নেশা। টিভি দেখি না। দেখতে ভালোও লাগে না। কিন্তু কাগজ না পড়তে পারলে ভালো লাগে না। আজকাল আমার অনেক পরিচিত প্রিয়জনদের বাড়িতে কাগজ রাখা বন্ধ করে দিয়েছে। বলে মোবাইলে পড়ি। টিভি তে দেখে নিই। আমি পারিনি রপ্ত করতে এই অভ্যাস। সকাল বেলার কাগজ হাতে নিয়ে পড়ার একটা আলাদা আনন্দ। তার ওপর আছে বিশেষ লেখা, ভালো সম্পাদকীয়, রবিবারের বিশেষ পাতা- এগুলো তারিয়ে তারিয়ে পড়ার মজাই অন্যরকম।
জলখাবারের টেবিলে আড্ডা জমে গেল। গরম গরম লুচি, ছোলার ডাল, গার্লিক এগপ্ল্যান্ট ভাজা, হরেকরকম ফল ডাইনিং টেবিলে সাজানো। খেতে খেতে গল্প হচ্ছে। সুজয়দার সাথে গতকালই প্রথম আলাপ পরিচয় হয়েছে। বিশেষ কিছুই জানতাম না। আজ জানলাম, সুজয়দার বাড়ি যাদবপুরে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র। অসাধারন মেধাবী ছাত্র। ১৯৮১ সালের মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছিলেন। ১৯৮৩ উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয়। তারপর কেমিস্ট্রি নিয়ে গ্রাজুয়েশন করে আমেরিকায় এসে সব করেছেন। ইন্ডিয়ানার University of Notre Dame থেকে পিএইচডি। পোস্ট ডক্টরেট নর্থ ক্যারোলাইনার ডিউক ইউনিভার্সিটি থেকে। বর্তমানে চাকরী করছেন- PENNINGTON BIO MEDICAL RESEARCH CENTRE এ। এখানকার জেনেটিক্স বিভাগের ডিরেক্টর সুজয়দা। এমন একজন গুণী বাঙালিকে পেয়ে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। সোহমের মামাদাদুকেও কদিন আগে দেখলাম। সেও অসাধারণ। সুজয়দাও অসাধারণ। সত্যি এই সব মানুষদের সান্নিধ্য ও সঙ্গসুধা ভ্রমণকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়।
সুজয়দা-দেবযানীদির দুই ছেলে। শ্রমণ ও সৌরিশ। ওরাও ভালো ছাত্র। শ্রমণ শিকাগোয় পড়াশোনা করছে। সৌরিশ স্কটল্যান্ডে। দেবযানীদি ব্যাটন রুজ এর Heli Mentorship Steam Academy ( High School) র সায়েন্স টিচার। মর্নিং স্কুল। বাড়ি থেকে প্রায় পঁচিশ কিমি দূরে। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে স্কুলে যাতায়াত করেন। সুজয়দা আমেরিকায় রয়েছেন প্রায় তিরিশ বছর। নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। এমন একটা পরিবারের সকলের সাথে বসে গল্প করে বড় আনন্দ হয়। সফল মানুষ, সার্থক জীবন এই দুইয়ের মোড়কে যাঁরা রয়েছেন, জীবন তো তাঁদের জন্য একটা উপহার! বাঁচো। আনন্দ করো। সুখে থাকো। আমেরিকা এই সুখ দিতে কার্পণ্য করে না। তাই আমরা পারি না এই সব মেধাবীদের ধরে রাখতে!..
আজ আমাদের বিকেলের ভ্রমণ শুরু হল ব্যাটন রুজ ঘুরে বেড়িয়ে দেখব বলে। ফ্রেঞ্চ কলোনীর প্রভাব রয়েছে ব্যাটন রুজে। এখানকার রাস্তা ঘাট স্থাপত্যে ছাপ রয়েছে ফরাসী কালচারের। আমরা প্রথমে চলে গেলাম LSU ( Louisiana State University) Tiger Stadium। তারপাশেই দেখলাম Pete Maravich Assembly Centre। এখানে একটা জিনিস দেখে খুব মজা পেলাম, সে হল খাঁচায় বন্দী এক বিশাল বাঘ- নাম তার MIKE। সে তখন নিদ্রামগন ছিল। তাই তার হালুম গর্জন বা রাজকীয় পদচারণা কিছুই দেখা হলো না। এখান থেকে চলে এলাম Roger Headfield Ogden Honours College এর কাছে। এই ফরাসী আমলের বিল্ডিংটা আশ্চর্য সুন্দর। পাশের রাস্তাঘাটও অপূর্ব। অনেক প্রাচীন ওক গাছ রয়েছে। সেই গাছগুলোতে স্প্যানিস মশ ঝুলছে। ফলে দারুণ এক দৃশ্য সুখ।
এখান থেকে চলে গেলাম মিসিসিপি নদীর ধারে। গতকাল নিউ অরলিন্স থেকে মিসিসিপিকে দেখেছিলাম। আজ ব্যাটন রুজ থেকে দেখলাম মিসিসিপিকে। মিসিসিপি খুব শান্ত সুন্দর এক নদী।
সন্ধের মুখে পৌঁছে গেলাম শম্পাদির বাড়িতে। সেখানে চলে এলেন আরও দুজন প্রবাসী বাঙালি রামানুজ ও রচনা। স্বামী স্ত্রী। ওঁরা সদ্য কেনিয়া তানজানিয়া ঘুরে এলো। তাই জমে গেল গল্প। এঁরা সবাই কৃতী ভারতীয় বাঙালি। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী। আমেরিকায় বহু বছর ধরে রয়েছেন।
ডিনার খেতে খেতেও অনেক গল্প হলো। ডিনারে ছিল ভাত, লাউ দিয়ে ডাল, আলু উচ্ছে ভাজা( শম্পাদির বাগানের উচ্ছে), পালং পনির, মাটন, ঘরে পাতা মিষ্টি দই। আরও একজন কৃতী বাঙালি সুখময় কুন্ডুর আসার কথা ছিল। বিশেষ কারণে আসতে পারেন নি।
রাতের নির্জন নিঝুম ব্যাটন রুজ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসছি। দুটো দিন সুন্দর কেটে গেল। নতুন কত মানুষের সাথে আলাপ হলো। কত ভালোবাসা আদর যত্ন পেলাম। প্রবাসে আমার শহরের এই সব সফল বাঙালিদের এখানে কাছ থেকে দেখে বড় আনন্দ পেলাম।
কাল ভোরে চলে যাব নতুন জায়গা – ফ্লোরিডার মায়ামিতে। সুজয়দা পৌঁছে দেবেন ভোরের এয়ারপোর্টে। একটা একটা করে ভ্রমণ শেষ হয়, স্মৃতির পাহাড় জমা হয়। মন মায়ায় জড়ায়। এই মায়াবী মন নিয়েই কাল যাচ্ছি মায়ামী।
দেবযানীদি- সুজয়দাকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে আসার সময় মন কেমন যেন করছিল। এই মনকেমন গুলোকে নিয়েই মুসাফিরকে পথ চলতে হয়!..
গুডবাই লুইসিয়ানা। বিদায় ব্যাটনরুজ।
porte khub valo laglo!