ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার পর্ব – ৫

 আমেরিকার ডায়েরি – ৫

।। ১২ অগাস্ট। ২০২৪।। সোমবার। নায়াগ্রা।।

সিরাকিউজ থেকে নায়াগ্রা ১৭০ মাইল। সড়কপথে এই লং ড্রাইভ করতে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা। আমেরিকার রাস্তাঘাট অসম্ভব ভালো। লং ড্রাইভগুলো খুব সুন্দর করা যায়।

এবার আমরা নিজেরা একটা গাড়ি ভাড়া করে নিলাম। আগামী সাতদিন এই গাড়ি নিয়ে ঘুরব। সোহম নিজে ড্রাইভ করবে। সিরাকিউজ থেকে শুরু করে একে একে যাব নায়াগ্রা, বস্টন- ম্যাসাচুসেটস, ওয়াশিংটন ডিসি, বল্টিমোর – মেরিল্যান্ড হয়ে আমি আর ডুলুং নেমে যাব বল্টিমোর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে আমেরিকান এয়ারওয়েজের South West বিমান ধরে চলে যাব Sharlotte। নর্থ ক্যারোলাইনার একটা বড় শহর। তারপর শার্লট থেকে Shuttle নিয়ে যেতে হবে সাউথ ক্যারোলাইনায় ডুলুং এর কাছে। সোহম বল্টিমোর থেকে গাড়ি নিয়ে ফিরে যাবে সিরাকিউজ।

গাড়ি ভাড়া নেওয়া হল যে সংস্থা থেকে তার নাম Enterprise। সিরাকিউজে সংস্থার শাখা অফিস আছে। খুব বড় সংস্থা। গাড়ি ভাড়া পড়ল সাতদিনে ১১০০/ ডলার। অর্থ্যাৎ ৯৩০০০/ হাজার টাকা। তেল আমাদের।
গাড়িটার নাম WAGONEER। কোম্পানির নাম JEEP। খুব দামী বেশ বড় গাড়ি। দাম জেনে অবাক হলাম ৮০,০০০/ হাজার ডলার!..মানে ৬৫ লাখ টাকার গাড়ি। এমন লাক্সারি গাড়িতে এর আগে কোনওদিন চড়ি নি!..

গতকাল রাতে আমাদের খিচুড়ি পিকনিক খুব জমেছিল। সোহম খিচুড়ি ও বাঁধাকপি রান্না করেছে। আমি বেগুন ভেজে দিয়েছি। ডুলুং আর ছোট সোহম হেল্প করেছে। ওদের বন্ধু সৃজন ও অভিপ্সা এসেছিল। এমন বৃষ্টির রাতে আমেরিকায় বসে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, বাঁধাকপির তরকারি-তার মজাই অন্যরকম। খাওয়া-দাওয়া গল্প করতে করতে রাত হয়ে গিয়েছিল অনেক।

সিরাকিউজ এর চারপাশে আরও সুন্দর সুন্দর কয়েকটা কান্ট্রি সাইড আছে। সেগুলো নাকি অসম্ভব সুন্দর। জায়গাগুলো হলো Finger Lake, Ithaca, Catskills, Adirondack। এবার আর সব দেখে নেওয়া সম্ভব হবে না।

আজ সকাল সকাল তৈরী হয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। এটা একটা ডে ট্রিপ। নায়াগ্রা দেখে আবার ফিরে আসব সিরাকিউজ। তারপর আগামীকাল সিরাকিউজ ছেড়ে চলে যাব বস্টন- ম্যাসাচুসেটস্।

আমাদের দুধ সাদা গাড়িটা খুব বড় এবং আধুনিক সব ব্যবস্থায় সাজানো। সোহম এর আগে এমন বড় গাড়ি চালায় নি। তাই প্রাথমিক জড়তা কাটাতে একটু সময় লাগল। গাড়িতে বসে খুব আরাম হয়। আমরা প্রথমেই গেলাম পেট্রোল পাম্পে ( ওরা বলে Gas Station)। তেল ভরতে হবে। এই সাতদিন তেল আমাদের। এখানে দেখলাম পেট্রোল পাম্পে নিজেকে তেল ভরে নিতে হয়। কার্ড পাঞ্চ করে পেমেন্ট করে তেল ভরে নেওয়া নিজের কাজ। কেউ নেই আশপাশে। পেট্রোল পাম্প পুরোটাই যন্ত্রচালিত। সোহম নেমে কার্ড পাঞ্চ করে ৫০ ডলার তেল ভরে নিল। এক গ্যালন পেট্রোলের দাম ৩.৬৯ ডলার।

সিরাকিউজ শহর ছেড়ে আস্তে আস্তে আমরা হাইওয়েতে উঠলাম। জি পি এস ছাড়া এখানে গাড়ি চালানো খুব মুশকিল। হাইওয়েতে অসংখ্য Exit point। একটা ভুল করলেই অনেকটা ড্রাইভ বেড়ে যাবে। ডুলুং সামনে বসেছে। ম্যাপ দেখে রাস্তা খেয়াল রাখছে। আমি পেছনে বসে খোলামনে দু’চোখ ভরে চারপাশ দেখতে দেখতে চলেছি।

স্বীকার করতেই হয়, আমেরিকার হাইওয়েগুলো অসম্ভব সুন্দর এবং ভীষণ পরিচ্ছন্ন। মাইলের পর মাইল এমন নিখুঁত হাইওয়ে সত্যিই দুর্লভ। গাড়ি চালাতে এই পথে ভীষণ মজা। আমার হাত খুব নিশপিশ করছিল, মনে মনে ভাবছিলাম, কিছু মাইল চালিয়ে দেখি!.. কিন্তু এখানে আমাদের উল্টো, ড্রাইভিং সিট বামদিকে। আমার অভ্যাস নেই। তাই আর সাহস হলো না। কিন্তু সোহম বেশ রপ্ত করে ফেলেছে এদেশের কায়দা। এখানে সবাই খুব ট্র্যাফিক রুল মেনে গাড়ি চালায়। গাড়ি চালানোটা ওদের কাছে একটা প্যাশান। সবাই সবাইকে মান্য করে। রাফ ড্রাইভ করে না। কেউ ভুল করলেই পুলিশের গাড়ি তাড়া করে এসে ধরবে এবং ফাইন করবে। শুনলাম সেই সব ফাইন নাকি এমনও হয়, তোমার সামাজিক অনেক সুযোগ সুবিধাও কেড়ে নেওয়া হতে পারে!..

হাইওয়েগুলো সুন্দর হওয়ার জন্য লংজার্নি খুব উপভোগ্য হয়। আমাদের WAGONERR গাড়ি সুন্দর ছুটতে শুরু করেছে। মসৃণ মোলায়েম এক সড়ক সফর। পথের দু’পাশে সবুজ গাছপালা, ফুরুশ গাছের সারি, পাইন, ম্যাপল ট্রি লাইন দিয়ে রয়েছে। পথের ধারের সব্জিবাগান, আলুচাষের খেত, ভুট্টাচাষের জমি, নদী, জনপদ একে একে পিছনে চলে যাচ্ছে। সোহম খুব স্টেডি সুন্দর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া ফোরকাস্ট ছিল, আজ সকালে সিরাকিউজে বৃষ্টি হবে। সিরাকিউজ ছেড়ে রচেষ্টার এর পর থেকে আবহাওয়া পাল্টে যাবে। সত্যি হলোও তাই। আমরা হাইওয়ে ধরে সিরাকিউজ ছেড়ে রচেস্টার আসতেই আকাশ কেমন ঝলমলে হয়ে উঠল। রোদ উঠল চমৎকার। ওদের ফোরকাস্টিং গুলো একদম মিলে যায়।

রচেস্টার এ একটু বিরতি নেওয়া হল। এখানে আমাদের দেশের রোড সাইড ধাবার মত বিরতি নেওয়ার জায়গা রয়েছে। এই জায়গাগুলো ভীষণ পরিচ্ছন্ন। খোলামেলা এবং ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো। সুন্দর রেস্টরুম রয়েছে। আমরা ওয়াশরুম বা টয়লেট বলি, ওরা বলে রেস্টরুম। রেস্টরুম ছাড়া হাইওয়ের ধারে যখন তখন গাড়ি থামিয়ে যা কিছু করা যাবে না। পুলিশ ধরলে ফাইন করবে।

হাইওয়ের ধারে অনেকটা ব্যবধানে Exit Rest Area বোর্ড থাকে। সেই বোর্ড দেখে গাড়ি নিয়ে সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়। এবং নিজের পছন্দমত ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ড্রিংক্স করা যায়। এই সব জায়গায় আমেরিকার জনপ্রিয় ফাস্টফুডগুলোর দোকান দেখেছি- McDonald’s, Burger King, Starbucks, Dunkin Donuts, Wendy’s, Subway
আমরাও এসব জায়গার খাবার খেয়েছি। ওদের খাবারের বেশিটাই নানানরকম বার্গার। খুব সুস্বাদু। আর কফি মানেই কোল্ড কফি। ওরা সব কিছু একটু ঠান্ডা খেতে পছন্দ করে। আমেরিকানরা সাদা জল মোটেই খায় না। আইস কিউব দিয়ে জল খাবে। কফি খাবে। আমাকে এটা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে হয়েছে।

রচেস্টার ছেড়ে আমরা বাফেলোর পথে চলে এসেছি। বাফেলো একটা সুন্দর জনপদ। সবুজ চারপাশ। নিসর্গ ভীষণ মনোরম। গাড়ি সুন্দর গতিতে চলছে। বাফেলো গাড়ি নির্মাণ শিল্পের জন্য বিখ্যাত। গাড়িতে আমাদের পছন্দের গানগুলো হচ্ছে। ডুলুং গান বাছাই করছে। আবার আমাদের রিকোয়েস্ট মত গানও শোনাচ্ছে। এতদূর বিদেশে এসে গাড়িতে বসে আমাদের প্রিয় বাংলা গান, হিন্দি গান, ব্যান্ডের গান, লোকগানগুলো শুনতে ভালো লাগছিল।

বাফেলোর পথ ঘাট, বাড়িগুলো ছবির মত। আমেরিকার সব জায়গায় দেখেছি বাড়িগুলো একদম পথের ধারে বানানো। দেখে মনে হবে কেউ বুঝি সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে চলে গেছে। মানুষ দেখা যায় না। কিন্তু বাড়ির লনে তিন চারটে করে বড় বড় দামী গাড়ি দেখা যায়। আমেরিকান পরিবারগুলোতে সবার নিজস্ব গাড়ি থাকে। বিরাট বড় বাড়ি, তিনতলা, চারতলা চোখে পড়ে খুব কম। একতলা বাগান-লন সহ ছড়ানো বাড়ি ওরা পছন্দ করে। এবং কারো বাড়িতে কোনও বাউন্ডারি ওয়াল নেই। বাড়ির রং গুলো খুব হাল্কা, চোখের পক্ষে আরামদায়ক। ফলে কি সুন্দর, কি অপূর্ব যে লাগে!

বাফেলো ছাড়িয়ে চলে এসেছি নায়াগ্রার কাছে। বাফেলো থেকে নায়াগ্রা ২৭ কিমি। এবার চোখে পড়ল নায়াগ্রা নদী। অন্টারিও হ্রদ ও এরি নদের মধ্যে অবস্থিত নায়াগ্রা। এরি হ্রদ থেকে নায়াগ্রা প্রবাহিত হয়েছে। এই নদীর ওপর সুন্দর এক সেতু। সেই সেতু পেরিয়ে নায়াগ্রা শহরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলাম। শহরটা সুন্দর করে সাজানো। একটা নদী ও জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করে অপূর্ব এক শহর নায়াগ্রা। টুরিজম বিজনেস কাকে বলে নায়াগ্রা এলে বোঝা যায়। প্রশংসা করতেই হয় ওদের এত সুন্দর করে পর্যটকদের সব কিছু দেখতে সাহায্য করার জন্য।

নায়াগ্রায় তিনটি জলপ্রপাত রয়েছে। আমেরিকান ফলস, হর্সশু ফলস বা কানাডিয়ান ফলস ও ব্রাইডাল ভেইল ফলস্।
নায়াগ্রার উচ্চতা ১৬৭ ফুট ( ৫১ মিটার)।
নায়াগ্রা কথার অর্থ হলো ” জলরাশির বজ্রধ্বনী”। সত্যি সার্থক এই নাম। ঐ প্রবল জলরাশির সামনে দাঁড়ালে একথা মনে হবেই। নায়াগ্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের শিরোপা লাভ করেছে। প্রতি বছর সারা পৃথিবীর পর্যটকরা এসে ভিড় করেন শুধু নায়াগ্রাকে একবার চোখের দেখায় দেখবার জন্য!.

পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাতের নাম – অ্যান্জেল জলপ্রপাত। ভেনেজুয়েলায় অবস্থিত। উচ্চতা ৯৭৯ মিটার ( ৩২১২ ফুট)। সেই তুলনায় নায়াগ্রা অনেক ছোট। কিন্তু সামগ্রিক সৌন্দর্যের বিচারে নায়াগ্রা অতুলনীয়। অনন্য। অপরূপ এক চোখ জুড়ানো জলপ্রপাত। নায়াগ্রাকে নিজের চোখে দেখা সারাজীবনের এক সেরা অভিজ্ঞতার স্মৃতি।

নায়াগ্রার টুরিজম সার্কিটে একবার ঢুকে পরতে পারলে অনেককিছু দেখা হয়ে যায়। তিনটে বিখ্যাত জলপ্রপাত ছাড়াও রয়েছে- Three Sisters Islands, Terrapin Point, Luna Island, Green Island, Pedestrian Bridge, Aquarium of Niagara.

আমরা প্রথমে Terrapin Point ( হর্সশু জলপ্রপাত) এক ঝলক দেখে নিয়ে Trolley Trip করলাম। এটা খানিকটা ট্রয় ট্রেনের মত। তবে পার্কের মধ্যে রাস্তায় চলে। কোনও ট্রেন লাইনে নয়। Trolley তে বসে এক চক্কর সুন্দর ঘুরে দেখা হয়ে যায় চারপাশটাকে। টিকিটের দাম ৩ ডলার। নিছক ‘ফান’ যাকে বলে, এই রাইডটা সেই রকম আনন্দ!..

নায়াগ্রায় এসে Maid of the Mist অবশ্যই করতে হবে। ৩০ ডলার দিয়ে টিকিট কেটে লঞ্চে করে এই জলভ্রমণ অসাধারণ। লঞ্চ তিনটে জলরাশির একদম সামনে নিয়ে যায়। তখন চোখের সামনে থেকে এই তিন প্রপাত দেখার আনন্দ উত্তেজনা কেমন যেন পাগল করে দেয়। চিৎকার করে আনন্দ জানান দিতে ইচ্ছে করে “অসাধারণ!.. অসাধারণ!.. “

কানাডার দিক দিয়েও এই রকম জলভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। ওদের রেনকোটগুলো দেখলাম লাল। আমেরিকান রেনকোট নীল। ফলে নায়াগ্রার সবুজ জলে লাল ও নীল রেনকোটে সজ্জিত পর্যটকভরা লঞ্চদুটো দেখতেও বেশ লাগে। এ যেন সেই গানের মত- “লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে, আয় আয় দেখবি যদি, দেখবি ছুটে আয়!..”

Maid of the Mist দেখে এসে Observation Tower এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেও এক আশ্চর্য সুন্দর অভিজ্ঞতা। এখান থেকে ওপারের কানাডাকে দেখা যাচ্ছে। হ্যান্ড শেক দূরত্বে কানাডা! এখান থেকে দূরের কানাডিয়ান ফলসকে সরাসরি দেখতে ভালো লাগে। আর দেখা যায় Rainbow Bridge। একদম রামধনুর মত বাঁকানো এই সেতু হল আমেরিকা ও কানাডার মধ্যে সীমান্তরেখা। মাঝখান থেকে ভাগ হয়েছে দুই দেশ, ওপারে কানাডা, এপারে আমেরিকা। আমি এক সৌভাগ্যবান ভারতীয় পর্যটক, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে পৃথিবীর এই আশ্চর্য সুন্দরকে দেখছি আর ভাবছি, মুসাফির তুমি নিজেকেই নিজে একবার সাবাশ বলো!..

লঞ্চ থেকে নেমে এসে এবার চললাম পায়ে পায়ে আমেরিকান ফলস এর কাছে। পাহাড়ের ধাপে সুন্দর সিঁড়ি করা পথ। কম বেশি একশো সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেলাম একদম শেষ ধাপে। এখানে একজন করেই দাঁড়ানো সম্ভব। মনে হচ্ছিল আমি যেন ছুঁয়ে ফেলেছি আমেরিকান জলপ্রপাতকে! ঠিকরে আসা জলের ধারালো কণা ও জলরাশির কুচি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ। গায়ে যেহেতু Maid of the Mist থেকে পাওয়া রেনকোট ( PONCHO বলে) ছিল তাই এই জলোচ্ছ্বাস উপভোগ করতে আরও মজা লেগেছে। বেড়াতে এসে কখনো কখনোএকটু ছেলেমানুষ হয়ে যেতে হয়। ভুলে যেতে হয় বয়স। ভুলে যেতে হয় সময়। আনন্দকে আঁকড়ে ধরা শিখতে হয়। আনন্দের মুহূর্তগুলো জীবনে বড্ড মহার্ঘ্য। আমি সব সময় চেষ্টা করি নিজেকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে ভ্রমণকে স্মরণীয় করে তুলতে। তাই সঙ্গে মেয়ে জামাই থাকলেও আমার ছেলেমানুষি আনন্দগুলো করার সুযোগ নষ্ট করি নি। পাল্লা দিয়ে ওদের সাথে আনন্দ করেছি, ছবি তুলেছি, আর কে না জানে আমি সেলফি তুলতে বড্ড ভালোবাসি!.. তাই সেই শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তে আমেরিকান জলপ্রপাতকে দেখে ছবি ও সেলফি তুলে অন্যকে দেখার সুযোগ করে দিয়ে সরে এলাম হাসিমুখে। বড় অপূর্ব এই ধাপ কাটা জায়গাটা। এখান থেকে আরও এক অন্যরূপে ধরা দেয় আমেরিকান নায়াগ্রা ফলস ও ব্রাইডাল ভেইল ফলস।

Maid of the Mist-থেকে ফিরে এসে নায়াগ্রা দর্শনের আচ্ছন্নতা যেন আর কাটছে না। আমি ইন্ডিয়ান নায়াগ্রা বলে খ্যাত ছত্তিশগড়ের চিত্রকূট জলপ্রপাত দেখেছি। ডুলুং, অন্তরাকে নিয়েই দেখেছিলাম প্রায় দশ বছর আগে। সেও ছিল খুব আনন্দের স্মৃতি। নৌকো করে একদম কাছে চলে গিয়েছিলাম। সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিল। আর আজকের আনন্দর কথা বলতে গেলে বলব, সাহিত্যের ভাষায় সেটা ছিল সুন্দর এক ছোটগল্প, আর এটা হল ধ্রুপদী উপন্যাস!..

Cave of the Winds আরও এক রোমাঞ্চকর ভ্রমণ। আলাদা টিকিট কেটে যেতে হয়ে সেই গুহার কাছে। অনেক সিঁড়ি ভেঙ্গে বেশ পরিশ্রম করে পৌঁছাতে হবে। আমরা আর যাই নি। হাতে সময় কম। শরীরও ক্লান্ত। তার ওপর আছে চিন্তা, ডলার তো গুণে এনেছি!.. তাই আঙ্গুর ফল টক মনে মনে অনেক সময়ই নিজেকে নিজে বলে সান্ত্বনা দিতে হয়েছে!..

নায়াগ্রা নদীর পার ধরে সুন্দর একটা পায়ে চলা পথ রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে নায়াগ্রা নদীকে কাছ থেকে দেখলাম। প্রবল গর্জনে স্বচ্ছ জলরাশি বয়ে চলেছে। ভীষন ভালো লাগে এই প্রবাহকে দেখতে। এখানে দু’ধরণের পাখি দেখলাম খুব। ঠিক সাদা বক নয়, পায়রা নয়। এখানকার এই সাদা সাদা পাখিগুলো পোষমানা পাখিদের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। ছবি তুলতে চাইলে পোজও দিচ্ছে, কিন্তু আশ্চর্য এক ডলারও চাইছে না!..

দিন ফুরিয়ে গেছে কখন খেয়াল করি নি। হঠাৎ দেখি পাঁচটা বাজে। নায়াগ্রা সার্কিটে যখন ঢুকেছিলাম তখন ঘড়িতে সময় দেখেছিলাম সাড়ে বারোটা। এখন পাঁচটা। কি করে যেন চলে গেল সাড়ে চার ঘন্টা। কিন্তু এই সাড়ে চার ঘন্টার স্মৃতি যেন কিনে নিলাম লক্ষ ডলার দিয়ে! যতদিন বাঁচব, নায়াগ্রার স্মৃতি অমলিন থেকে যাবে হৃদয়ে।

রাতের নায়াগ্রা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হয় নি। তাহলে রাত্রিবাস করতে হয়। এখানে থাকার জন্য অনেক নামী দামী হোটেল রয়েছে। আমরা ওয়ান ডে ট্রিপ করেছি। তাই রাতের নায়াগ্রা বা পূর্ণিমা রাতের মোহময়ী রূপের নায়াগ্রা দেখা হলো না!..

আজ লাঞ্চ করা হয় নি! এবার সে কথা মনে পড়ল। কাল রাতে ওদের বন্ধু সৃজন বলেছিল, নায়াগ্রার কাছে ফিস মার্কেটে কয়েকটা ইন্ডিয়ান দোকান আছে। সেখানে ধোসা, ইডলি, কাঠি রোল পাওয়া যায়। ঠিক হলো সেখানেই যাব। আজ আমরা ধোসা খাব।

ফিস মার্কেটে এসে ইন্ডিয়ান দোকান খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। আমি আর সোহম মশলা ধোসার অর্ডার দিলাম। ডুলুং বলল, কড়াই পনির রাইস। পনির পেলে ডুলুং আর থাকতে পারে না। লাঞ্চের পর কোল্ড কফি নিলাম। আমাদের লাঞ্চ করতে খরচ হল ৩৫ ডলার। খেয়ে বেশ তৃপ্তি হলো।

এখানে সন্ধ্যা হয় আটটার পর। আমাদের ঘড়িতে এখন ৬.১০। বাইরে যথেষ্ট আলো। আকাশ কি সুন্দর উজ্বল নীল। তিনঘন্টা লাগবে সিরাকিউজ ফিরতে। ফেরার পথে সিরাকিউজ ডাউনটাউনের Walmart ঘুরে যাব। সোহমের নতুন এপ্যার্টমেন্টের জন্য কিছু জরুরী জিনিস কেনা দরকার। ডুলুং দেখলাম সোহমের সংসার গুছিয়ে দেওয়ার মত করে সব জিনিস কেনার লিস্ট বানাচ্ছে।

নায়াগ্রা থেকে ফেরার পথে সানসেটের আকাশ চোখে পড়ল। সূর্য ডুবু ডুবু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লেগেছে। অনেকটা পথ এভাবে আমরা এসেছি।

Walmart থেকে অনেক দরকারী জিনিস কেনা হলো। বিরাট এই ওয়ালমার্ট। ঘুরে দেখতেও মজা। বেরিয়ে দেখি রাত তখন দশটা। বাইরেটা নির্জন। হাল্কা ঠান্ডা লাগছে। কাল সকালেই বেরিয়ে চলে যাব সিরাকিউজ ছেড়ে বস্টন। লম্বা রাস্তা। কম বেশি তিনশো মাইল। প্রায় পাঁচ- – ছ’ঘন্টার লং ড্রাইভ। আজ রাতটুকু শুধু বিশ্রাম। সবাই বেশ ক্লান্ত। সোহমের জেফার্সন টাওয়ার আর দূরে নয়। আমরা গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলেছি। পথ একদম শুনশান। একটা পথচারীও নেই। শুধু হুশ হুশ করে গাড়ি দৌড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ডুলুং বলল, “বাবা, ঐ দেখো একজন হোমলেস কেমন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।”
সোহম গাড়িটা একটু স্লো করে দিয়ে বলল, “রাতের বেলায় একদম একা হাঁটাচলা করা যায় না। এদের জন্য খুব ভয় করে। এরা সব ড্রাগ খায়। চুরি ছিনতাই করে নেয় একলা পেলে।…”

আমি গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলাম, একটা বেচারা গোছের মানুষ কেমন সর্বহারা চেহারা নিয়ে রাতের নির্জন রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে- সত্যিই তো এটা রাজপথ। আমেরিকা রাজার দেশ! সেই দেশেও এসব দেখতে আশ্চর্য লাগে! আমেরিকায় এসে এমন সাদা চামড়ার ফকির দেখব ভাবি নি!..

আমরা তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ। আমাদের পথে পথে অনেক গৃহহীন,গরীব মানুষ দেখা যায়। আমরা তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু যে দেশ বিশ্বকে চমকে দেয় সব কিছু দিয়ে, যার বৈভব দেখলে তাক লেগে যায়, সেখানেও এই দৃশ্য দেখতে বড্ড কষ্ট হয়!..ভ্রমণ তো শুধুই আনন্দ দিয়ে সাজানো সুখস্মৃতি হয় না, নুড়ি পাথরের মত কিছু দুঃখ, কষ্টও এসে অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে।

ফিরে এলাম জেফার্সন টাওয়ারে। এলিভেটরে চড়ে ১১ তলায় উঠে এলাম। ক্লান্ত শরীর। ডিনার করেই বিছানায় আশ্রয় নিতে হবে।

আগামীকাল শুরু হবে নতুন সফর- আরও এক পৃথিবী বিখ্যাত শহর বস্টন যাত্রা।

আজ তবে এইটুকু থাক্… বাকি কথা পরে হবে!..

শুভরাত্রি। সিরাকিউজ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Ramesh Chandra Das says:

    Khub Valo laglo

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।