ভ্রমণে রোমাঞ্চ ধারাবাহিকে সমীরণ সরকার (পর্ব – ২১)

তীর্থভূমি বীরভূম ,ভ্রমণ তীর্থ বীরভূম

রামায়ণের কাহিনীভিত্তিক যে সমস্ত টেরাকোটা ফলকের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলিতে মূলত শিল্পীরা কৃত্তিবাসের রামায়ণের কাহিনীর উপরে
ভিত্তি করেই শিল্প সৃষ্টি করেছেন।
টেরাকোটা ফলক নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পীরা রামায়ণের কাহিনীকে ভিত্তি করে যত শিল্পকর্ম প্রস্তুত করেছেন তার তুলনায় মহাভারত ভিত্তিক কাহিনীর সহায়তা কম নিয়েছেন। যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম কে জল পান করানোর উদ্দেশ্যে অর্জুনের মাটিতে তিরের ফলা বিঁধিয়ে জল আনার দৃশ্য ইত্যাদি চিত্রায়িত হয়েছে বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলা ও মদনমোহন মন্দিরে। বিষ্ণুপুরের মদনমোহনের মন্দিরে ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধের দৃশ্য ইত্যাদি দেখা যায়।
যুধিষ্ঠির ও শকুনির পাশা খেলার দৃশ্য, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ দৃশ্য দেখা যায় ফুল পাথরে খোদিত বীরভূম জেলার গণপুরের মন্দিরে।
কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাহিনী গুলো বিভিন্ন মন্দিরে ব্যাপকভাবে উৎকীর্ণ হয়েছে। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কাহিনীগুলির মধ্যে কৃষ্ণের জন্ম, বস্ত্রহরণ, ননি চুরি, কালীয় দমন, নৌকা বিলাস ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে।
এছাড়া ‘নবনারীকুঞ্জর’ নামে খ্যাত চিত্রটি, যেখানে নয় জন গোপিনী বিশেষ কৌশলে পরস্পর একতাবদ্ধ হয়ে হাতির আকার তৈরি করে এবং কৃষ্ণ তার উপর উপবিষ্ট— এই রূপ টেরাকোটার ফলকে বীরভূম জেলার ঘুড়িষার রঘুনাথ মন্দিরে, বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় ও মদনমোহন মন্দিরে দেখা যায়। বীরভূমের ঘুড়িষা গ্রামে রঘুনাথ মন্দিরে এবং ফুল পাথরে খোদিত আছে বীরভূম জেলার গণপুরের শিব মন্দিরে।

‌কৃষ্ণলীলা বিষয়ক আরেকটি চিত্র হলো রাস মন্ডল। কৃষ্ণ- রাধার মূর্তিকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে নৃত্যরত গোপিনী পরিবৃত এই ফলকটির রূপায়ণ দেখা যায় বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় মন্দিরে, যেখানে বেশ কয়েকটি রাস মন্ডল ফলকে দুটি এককেন্দ্রিক বৃত্তের মধ্যে হাত ধরাধরি ভঙ্গিতে অসংখ্য কৃষ্ণ ও গোপী মূর্তি উৎকীর্ণ এবং এরই মধ্যে রূপায়িত হয়েছে অগণিত মৃদঙ্গ বাদক ও নৃ্ত্যরত দেবদাসী মূর্তি।
পোড়ামাটির ভাস্কর্য ফলকে উৎকীর্ণ পৌরাণিক দেবদেবীদের মধ্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই ত্রিমূর্তি ছাড়াও ইন্দ্রের মূর্তিও দেখা যায়।
ইন্দ্র বিষয়ক উৎকৃষ্ট ফলক দেখা যায় বীরভূম জেলার ঘুড়িষার শিব মন্দিরে, লক্ষ্মী সরস্বতী সহ শঙ্খ চক্র গদা পদ্মধারী রূপে বিষ্ণুর প্রতিকৃতি দেখা যায় হুগলি জেলায় গুপ্তিপাড়ার রামচন্দ্র মন্দিরে। তবে বিষ্ণুর দশ অবতার রূপ– মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ ,বামন ,পরশুরাম, দশরথের পুত্র রাম ,বলরাম, বুদ্ধ বা জগন্নাথ ও কল্কি বহু মন্দিরের গায়ে খোদিত আছে। বীরভূম জেলার ঘুড়িষায় রঘুনাথ মন্দিরে, ইলামবাজারে বামুনপাড়ার শিবমন্দিরে, গনপুরের মন্দিরে ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় দশাবতার মূর্তি দেখা যায়।
পোড়ামাটির ফলকসজ্জায় অনেক মন্দিরে নন্দী-ভঙ্গি সহ শিব দুর্গা, সতী দেহ বাহী শিব মূর্তি, পদ্মাসীন শিব চতুর্ভুজ হরিহর মূর্তি রূপে উৎকীর্ণ হয়েছেন।
শাক্ত দেবী মধ্যে বহু মন্দিরে মহিষমর্দিনী মূর্তি ছাড়াও সপুত্র কন্যা শিব ও দুর্গাকে দেখা যায়।
দুর্গা ছাড়া অন্নপূর্ণা মূর্তি কালী মূর্তি ও দেখা যায়।
জগদ্ধাত্রী মূর্তির নিদর্শন দেখা যায় বীরভূম জেলার ইলামবাজারের রামেশ্বর শিব মন্দিরে।
বীরভূমের ঘুড়িষায় শিব মন্দিরে উৎকীর্ণ আছে লক্ষ্মী সরস্বতীর পৃথক পৃথক মূর্তি।
ঘুড়িষার লক্ষী জনার্দন মন্দিরে শিবের বুকে দাঁড়ানো কালী মূর্তি দেখা যায়।

চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত কমল কামিনী মূর্তি দেখা যায় বীরভূম জেলার ঘুড়িষার লক্ষ্মী জনার্দনের নবরত্ন মন্দিরে। দেবী মনসার মূর্তি আছে বীরভূম জেলার ইটন্ডা গ্রামের জোড় বাংলা মন্দিরে।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা মাহাত্ম্যসূচক বেশ কিছু মৃৎফলক দেখা যায় বিভিন্ন স্থানের মন্দিরে।
সেগুলির মধ্যে গৌরনিতাই ছাড়া ষড়ভুজ অবতার মূর্তিও দেখা যায় বীরভূম ও বাঁকুড়া জেলার মন্দিরে।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বর্ধমান রাজ পরিবারের প্রচেষ্টায় কালনা শহরে একটি বিশাল মন্দির চত্বর নির্মিত হয়েছিল। তারমধ্যে দুটি মন্দির বিশেষভাবে স্মরণীয়। দুটি মন্দিরই পঞ্চবিংশতরত্ন বা চুড়া সমন্বিত ও ত্রিতল মন্দির

মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত মন্দিরের নিদর্শন হল কালনার রাজবাড়ির মধ্যে অবস্থিত লালজী মন্দির। এই মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা ফলক গুলি ছাঁচে তৈরি এবং কয়েকটি পরপর প্যানেলে একই ধরনের অলংকরণ আছে। পৌরাণিক দেবদেবী, সমাজ চিত্র ,পশুপাখি ,গাছ ,ফুল ,লতা পাতা, রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী ইত্যাদি সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

নাটোরের রানী ভবানীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো গঙ্গার পাড়ে বড় নগরের চার বাংলা রীতি মন্দির(১৭৬০)। চারটি মন্দিরই কমবেশি টেরাকোটার অলংকরণে সজ্জিত। তবে উত্তর দিকের মন্দিরটি সবথেকে বেশি অলংকৃত। রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী, বিচিত্র পৌরাণিক উপাখ্যান ,কৃষ্ণলীলা, নানারকম সমাজচিত্র প্রভৃতি অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পোড়ামাটির খোদিত মূর্তি গুলির মধ্যে গোষ্ঠ লীলা ও বিষ্ণুর বরাহ অবতারের ভাস্কর্য ফলক অপূর্ব।

কেউ কেউ অনুমান করেন যে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে দর্পনারায়ণ রায় নতুন মন্দির নির্মাণ করেন। একই মন্দির চত্বরে এখনো ১৬টি মন্দির অক্ষত অবস্থায় বর্তমান। কিরিটেশ্বরীতে প্রাপ্ত অপর একটি বিষ্ণু মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপি, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বক্ষণে সংরক্ষিত আছে। সেই অনুযায়ী মন্দিরটি ১৩৭৮ শকে নির্মিত হয়েছিল।
কিরিটেশ্বরী থেকে ছয় কিলোমিটার দক্ষিণে এবং লালবাগের পশ্চিমে ভট্ট বাটিতে অষ্টাদশ শতকে রত্নেশ্বর মন্দির তৈরি হয়েছিল। মন্দিরটি পঞ্চরত্ন স্থাপত্য শৈলী এবং চার দেয়াল ও চূড়াগুলিতে উৎকৃষ্ট টেরাকোটার অলংকরণ আছে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।