ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ১২

আমেরিকার ডায়েরি – ১২
।। শিকাগো- ৩০ অগাস্ট, শনিবার।।
শিকাগো শহরে পা দিয়েই এক অন্য অনুভূতি হল সবার আগে, এই সেই শহর, এখানে বিবেকানন্দ এসেছিলেন ১৩১ বছর আগে। তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তৃতা আজও আমাদের স্মরণে আছে,- “Sisters and Brothers of America”
“It fills my heart with joy unspeakable to rise in response to the warm and cordial welcome which you have given us. I thank you…”
আজও তাই লেখা রয়েছে – “Speech delivered by Swami Vivekananda on September 11, 1893, at the First World’s Parliament of Religions in Chicago.
Columbus Hall, 1983.
While Vivekananda gave several speeches at the Parliament, it was in this hall ( now Fullerton Hall) that he gave his most famous speech.”
শিকাগো আমেরিকার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পড়ে। ইলিনয় এর রাজধানী হল Springfield। শিকাগো আমেরিকার দ্বিতীয় হাইরাইজ বিল্ডিং এর শহর। প্রথম নিউইয়র্ক। সে শহর ঘুরে দেখে এসেছি। শিকাগো শহরে পা দিয়েই বুঝতে পেরেছি আরও এক বড় বড় অট্টালিকার শহরে চলে এলাম। চারপাশ জুড়ে অপূর্ব সুন্দর সব গগনচুম্বী অট্টালিকা। যেদিকে তাকাই সেদিকেই চোখ বিদ্ধ হয়ে যায়।
আমরা আজ বিকেলে এসে পৌঁছলাম শিকাগো শহরে। এলাম ইন্ডিয়ানার লাফায়েত থেকে সড়ক পথে আমেরিকান বাস সার্ভিস গ্রে হাউন্ড এর বাসে। এই প্রথম আমেরিকার দূর পাল্লার বাসে চড়লাম। ঠিকই আছে। আমেরিকায় পাবলিক বাস কম। আর এই সব বাসে খুব সাধারণ আমেরিকানরা যাতায়াত করেন। তাঁদের চেহারা চরিত্র দেখলে কেমন যেন একটু ভয় ভয় করে। নেশাখোর। ভবঘুরে। রাফ টাফ ধরণের সহযাত্রী হয় বেশি।
আমাদের হোটেল বুক করাই ছিল। একটু খুঁজে হাঁটতে হাঁটতেই চলে এলাম। হোটেলের নাম- Travelodge। চোদ্দ তলা হোটেল। আমরা চোদ্দ তলায় একটা ফোর বেডেড রুম পেলাম। বেশ ভালো রুম। দুদিনের জন্য ভাড়া পড়ল ৪৮০ ডলার। এখানে কোনও কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট নেই। তবে ঘরে চা- কফি মেকার আছে। চা- কফি- চিনি আছে। ভিউ পেলাম রাস্তার ধারের। বিরাট বড় কাঁচের জানলা দিয়ে দেখলাম একদম মুখোমুখি রুজভেল্ট ইউনিভার্সিটি। নিচে শিকাগো শহরের বিখ্যাত L রেল ঝমঝম করে চলছে। এই রেল পাতালরেল নয়। ওপর দিয়েই চলে সারাদিন। যাত্রী কখনোই বেশি চোখে পড়ল না। কিন্তু রেল সারাদিন ধরে ঘুরে যাচ্ছে।
বিকেল এখানে খুব লম্বা হয়। ঘড়িতে ছটা বেজে গেছে। বাইরে আলো ও রোদ দুটোই আছে। শিকাগোর টাইম জোন আবার আলাদা।আমেরিকার ইস্ট কোস্ট থেকে এক ঘন্টা পিছিয়ে। হোটেলের ঘরে লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম। জেনে নিয়েছি খুব কাছেই মিশিগান লেক। আমাদের হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট।
মিশিগান লেকের কাছাকাছি পৌঁছে খুব সুন্দর একটা ফোয়ারা দেখতে পেলাম। বিরাট ফোয়ারা। নাম Grant Park Buckingham Fountain। ফোয়ারার চারপাশে মস্ত চাতাল। বহু পর্যটক এই সন্ধ্যায় সেখানে জড় হয়েছে। ছোটরা মজা করছে। খেলছে। এখানে দেখলাম অনেক সাইকেল রিক্সা। নিউ ইয়র্ক সিটিতেও দেখেছিলাম এমন অনেক রিক্সা। শিকাগোতে এসে আবার দেখলাম। বিশ্বের এত আধুনিক শহরগুলোতে আজও রিক্সা চলছে। রিক্সাগুলো বেশ বড়। বসলে আরাম হয়। প্যাডেল করেও চলছে, আবার ব্যাটারিতেও চলছে। এই রিক্সায় বসে মিশিগান লেকের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো যায়। শহরেও চাইলে রিক্সায় চড়ে বেড়ানো যায়।
আমেরিকায় পাঁচটা বড় লেক রয়েছে। মিশিগান, অন্টারিও, সুপিরিয়র, হুরন ও ইরি। পৃথিবী বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাত অন্টারিও ও ইরি থেকে উৎপত্তি।
মিশিগান লেকের কাছে এসে বড় ভালো লাগল। চারপাশ সুন্দর সাজানো ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। লেকের জলে অসংখ্য বোট। স্পিড বোট ছুটছে। পালতোলা নৌকোও আছে। ওয়াটার ট্যাক্সি আছে। আর আছে বিত্তবান মানুষজনদের নিজস্ব বিলাসী বোটগুলো। লেকের জলে অনেক হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। জলে ডুব দিয়ে দিয়ে খেলছে। এই হ্রদের জল বড় শান্ত। নির্মল। আমরা চুপ করে বসলাম লেকের পাশে। আমাদের মত আরও অনেক মানুষ বসে আছেন লেকের দিকে মুখ করে। এই শান্ত হয়ে বসে চেয়ে থাকার মধ্যে কোথায় যেন একটা ক্লান্তি মুছে যাওয়া আছে, প্রশান্তি ফিরে পাওয়ার আনন্দ আছে।
শিকাগো শহরে অনেক কিছু দেখার আছে। কিন্তু সব তো আর দেখা সম্ভব নয়। নির্বাচিত কিছু জায়গাকে দেখে নেব। আমরা আজকের সন্ধ্যা-রাত্রি ও কালকের সারাদিন পাচ্ছি শিকাগোকে দেখে নেওয়ার জন্য। সবার আগে অবশ্যই কাল সকালে দেখব বিবেকানন্দ র সেই বিখ্যাত বক্তৃতার সভাগৃহ -Columbus Hall। বর্তমানে তার নাম হয়েছে-The Art Institute of Chicago। এখানেই সেই মঞ্চ, যেখানে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ সকলকে স্তব্ধ করে দিয়ে শুরুতেই বলেছিলেন, “সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অফ আমেরিকা।” বর্তমানে সেই মঞ্চের নাম- Fullerton Hall।
আজকের সন্ধেটা মিশিগান হ্রদের ধারে বসে এবং জলের ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা ঘুরে বেড়ালাম। শহরের মধ্যে একটা বড় পার্ক- মিলেনিয়াম পার্ক। সেখানেও গেলাম। দিনটা ছিল শুক্রবার, পর পর তিনদিন ছুটি। শনি – রবি। এবং সোমবার লেবার ডের ( ২ সেপ্টেম্বর) ছুটি। লেবার ডে আমেরিকাতে বিশেষ ছুটি থাকে। টানা তিনদিন ছুটির ফলে প্রচুর পর্যটক শহরে চলে এসেছে। বেশ একটা উৎসবের মেজাজ। মানুষজন হৈ হৈ আনন্দে মেতে হুল্লোড় করছে। মিলেনিয়াম পার্কে লাইভ জ্যাজ মিউজিক শো চলছে। দাঁড়িয়ে একটু গান শুনলাম। গানের তালে অজান্তেই শরীর দুলে দুলে উঠেছে। জ্যাজ শোনার মধ্যে একটা উষ্ণতা আছে।
পার্কে প্রচুর ফুড স্টল। আলোর রোশনাই। আর একটা জিনিস দেখে বেশ ভালো লাগল, Cloud Gate/ “The Bean”। একজন ভারতীয় অনীশ কাপুর এটি বানিয়েছেন। জিনিসটা হল বৃত্তাকার একটা ইস্পাতের মতন জিনিস, সেখানে চারপাশের প্রতিচ্ছবি ভীষণ সুন্দর প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে শিকাগো শহরের সব হাইরাইজগুলোকে দেখতে দারুণ লাগে।
আজকের বিকেল ও সন্ধেটা মিশিগান লেক, লেকের ধার ধরে হাঁটা, শহরের মিলেনিয়াম পার্ক ভ্রমণ করে ফিরে এলাম হোটেলের কাছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা। একবার ভাবা হলো ডিনার কিনে নিয়েই নয় হোটেলের রুমে চলে যাব, আবার ঠিক হল, না। রেস্তোরাঁয় বসেই খেয়ে হোটেলে ঢুকব।
আজ ডিনারে চাইনিজ খাওয়া হল। রেস্তোরাঁটা বেশ ছিমছাম পিওর চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। আমি আর ডুলুং খেলাম কুংপাও চিকেন উইথ রাইস।সোহম খেল মিক্সড চাউমিন। আমেরিকায় “টিপস” একটা খুব প্রচলিত সংস্কৃতি। সার্ভিস ওরিয়েন্টেড প্রায় সব জায়গায় টিপস দিতে হয়। এবং তার একটা বাজার চলতি রেটও আছে মূল বিলের ২০ পার্সেন্ট। তবে সেটা কাস্টমাইজ করা যায়। তুমি চাইলে তোমার পছন্দমতো দিতে পারো। তাই রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া মানেই বাড়তি একটা টিপস চাপবেই। না দেওয়াটা অভদ্রতা এদেশে।
ডিনার বাইরে সেরেই ক্লান্ত শরীরে ফিরে এলাম হোটেলে। চোদ্দতলার ঘর থেকে রাতের শিকাগো শহরকে দেখলাম। শহর তখনও ঝলমলে। বাইরে উৎসবের আমেজ। আমরা রাত জেগে আর বেশি সময় থাকি নি। আগামীকাল সকালে সারাদিন অনেক বেড়ানো আছে। শিকাগো শহরটাকে যতটা পারি দেখব। তবে সবার আগে যাব Art Institute of Chicago। বিবেকানন্দ র পদস্পর্শ রয়েছে যে পুণ্যভূমিতে সেখান থেকেই হবে শুরু শিকাগোর আসল ভ্রমণ।
শুভরাত্রি।
আমাদের হোটেল থেকে Art Institute of Chicago পায়ে হেঁটে পনেরো মিনিট পথ। সকালেই তৈরী হয়ে হোটেলের ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এলাম। একটু ব্রেকফাস্ট করে নেওয়া দরকার। চোখে পড়ল Dunkin’। এখানে ঢুকে আমি খেলাম লাটে টি ও Egg & Cheese wrap। সোহম ডুলুং নিল Chicken Pepper Wrap ও কোল্ড কফি।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম আর্ট ইনস্টিটিউটে। সকাল এগারোটা থেকে সাধারণ ভিজিটরদের প্রবেশ। ঘড়িতে দশটা পনেরো। একটু অপেক্ষা করতেই হয়। টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বহু পর্যটক রাস্তায়। শহরটা একদম পর্যটকদের দখলে চলে গেছে। পরপর তিনদিনের ছুটি, তাই আনন্দে লুটোপুটি।
আর্ট ইনস্টিটিউটেও ভালোই ভিড়। টিকিটের মূল্য ৩২ ডলার। স্টুডেন্টদের ২৬ ডলার। ডুলুং সোহম সেই ছাড়টুকু পেল।
শিকাগোর এই আর্ট ইনস্টিটিউট খুবই সুন্দর। বিশ্ববিখ্যাত। বহু মূল্যবান ছবি, স্কাল্পচার ও অমূল্য সব জিনিস দিয়ে সাজানো। তাই ওদের লিফলেটে লেখা- “You’ve just stepped into one of the world’s great art museums, with a collection of art that spans centuries of creativity from around the globe. Whether today is your first visit or your hundred and first, we hope you enjoy your time in the galleries.”
এই আর্ট ইনস্টিটিউট এতটাই সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় যে একটা গোটা দিনেও দেখে শেষ করা যায় না। এখানে রয়েছে -Arts of the Americas, Arts of China, Arts of Japan, Arts of Asia, Arts of Africa, Arts of Europe, Impressionism ও Contemporary arts। আমরা ঘুরে ঘুরে কিছু অসাধারণ ছবি দেখলাম। ভাস্কর্য দেখলাম। তারপর আমাদের প্রধান আকর্ষণ ও আবেগের জন্য এখানে আসা সেই পুণ্যভূমি দেখলাম। বিবেকানন্দর স্মৃতিধন্য সেই স্থানে গিয়ে মনে হল যেন কতজন্মের পুণ্যলাভ হল আজ। ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। সার্থক মনে হচ্ছিল। ধন্য এই বিশ্বভ্রমণ। আরও আনন্দ হচ্ছিল সঙ্গে রয়েছে দুই প্রিয়জন সোহম – ডুলুং। তিনজনে একসাথে এই পুণ্যভুমিতে এসে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্পর্শ করে আমার ভ্রমি জীবনের এক পরম পাওয়া হল আজ। তারপর যখন সেই সভাঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম, যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই মঞ্চকে ছুঁয়ে প্রণাম করলাম, সে আনন্দ যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল। আজ থেকে ১৩১ বছর আগে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি পরিব্রাজক এখানে এসেছিলেন, আমেরিকা বাসীর মন জয় করে ফিরেছিলেন, সেই পবিত্রভূমিতে আমরাও আসতে পারলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে, এটা পরম সৌভাগ্য আমাদের। জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে রয়ে গেল আজকের এই অমূল্য স্মৃতি।
Art Institute of Chicago থেকে বেরিয়ে এবার আমরা চললাম শিকাগোর বিখ্যাত Architecture Tour করতে। রাস্তায় থিক থিক করছে ভিড়। মনে হলো যেন কলকাতার দুর্গাপুজোর অষ্টমীর রাত। আজ রোদও খুব ঝলমলে। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম শিকাগোর চার্লস রিভার এসপ্ল্যানেডে। এখান থেকে হয় রিভার আর্কিটেকচার টুর। এই টুর দু’রকম আছে। ৪৫ মিনিট ও ৯০ মিনিট। আমরা সময় বিবেচনা করে ৪৫ মিনিটের রিভার ক্রুজ টুর নিলাম। টিকিট পড়ল এক একজনের ২৬ ডলার করে।
এই ৪৫ মিনিটের আর্কিটেকচার টুর একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চার্লস নদীটাও খুব সুন্দর। নদীর দু’ধারে সারি সারি অট্টালিকা। যেমন তারা দীর্ঘ তেমন তারা ঝকঝকে। কি সুন্দর করে বানানো প্রত্যেকটা স্থাপত্য। একদম আধুনিক আর্কিটেকচার। আমরা শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে গেছি দু’পাশের এই সব গগনচুম্বী হাইরাইজগুলোকে। ক্রুজে একজন গাইড বলে বলে যাচ্ছিলেন কোনটা কি বাড়ি, কি নাম, কার বাড়ি। কি অফিস। দেখলাম আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর অট্টালিকাটাও। চার্লস রিভার ক্রুজের এই পথে অনেকগুলো সেতু পড়বে। সেতুগুলোর তলা দিয়ে যেতে বেশ লাগে। এমন কয়েকটা সেতুর নাম হলো- মিশিগান এভিনিউ, লেক শোর ড্রাইভ, কলম্বাস ড্রাইভ, RANDOLPH STREET, Washington BLVD, LYRIC OPERA BRIDGE, DUSABLE BRIDGE। নদীর দু’ধারের এই সব চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচারগুলো দেখতে দেখতে পয়তাল্লিশ মিনিট সময় হুশ করে ফুস হয়ে গেল! নব্বই মিনিট হলে আরও কত সব আশ্চর্য সুন্দর বিল্ডিং দেখতে পেতাম!..
এই আর্কিটেকচার টুর রিভার সাইড ধরে হেঁটে হেঁটেও করা যায়। তারজন্য খুব সুন্দর করে রাস্তা বানানো আছে। এছাড়াও আছে সানসেট ক্রুজ। শিকাগো একটা অসাধারণ শহর। তিন চারটে দিন থাকার মত সুন্দর শহর। মন মাতাল করে দেয় শিকাগোর চারপাশ।
এরপর আমরা চলে এলাম Chicago Theatre Centre এর সামনে। এটা একটি বিখ্যাত হল। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত। নিয়মিত থিয়েটার হয়। বাইরে থেকে দেখলাম খুব সুন্দর।
এবার একটু মধ্যাহ্নবিরতি নিয়ে লাঞ্চ করলাম। এখানকার জনপ্রিয় এক চেইন ফুড রেস্টুরেন্ট – PANDA EXPRESS এ। খেলাম Fried Rice, Kung Pao Chicken, Honey Walnut Shrimp। ভীষণ সুস্বাদু এই চাইনিজ খাবারটা। Shrimp মানে চিংড়ি মাছ। অনেকগুলো খুব বড় সাইজের চিংড়ি দিয়ে ফ্রাইড রাইসটা খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলাম।
তারপর আমরা চলে গেলাম উবের নিয়ে North Avenue Beach দেখতে। এখানে একটা কৃত্রিম সৈকত তৈরী করা হয়েছে মনে হল। প্রচুর আমেরিকানরা এই রৌদ্রজ্বল দিনে মহানন্দে ফুটবল, ভলিবল খেলছে। কেউ কেউ সাইক্লিং করছে। কেউ দৌড়েই যাচ্ছে। কেউ কেউ সানবাথ নিচ্ছে। অনেকটা সময় চার্লসের নীল জলের দিকে চেয়ে বসে কাটালাম। খুব ভালো লাগছিল। এপারে বসে শিকাগো শহরের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোকে আবার দেখলাম। অবাক হয়ে দেখতে হয় একটা শহরেই কত সুন্দর সুন্দর হাইরাইজ বিল্ডিং কেমন সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কি অপূর্ব দেখায়। চোখ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। নিউইয়র্কেও এমন সারি সারি অট্টালিকা। আমরা যেদিন নিউইয়র্কে ছিলাম, বৃষ্টি খুব বিঘ্ন ঘটিয়েছিল। তাই এমন রোদ ঝলমল নিউইয়র্ককে আমরা পাই নি। আমেরিকার হাইরাইজ বিল্ডিং এর প্রথম সিটিকে ভালো করে না দেখতে পাওয়ার আফসোস রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ আমেরিকার এই দ্বিতীয় বড় শহরকে দেখে মন খুব খুশি। তৃতীয় হাইরাইজ বড় শহর হল মায়ামি। আমার সেটাও দেখার সৌভাগ্য হবে আর কয়েকদিন পরই।
এরপর পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম লিংকন পার্ক ও জু র কাছে। ছোট্ট পার্ক। চিড়িয়াখানাটাও ছোট্ট। কয়েকটা জিরাফ, শিংওলা দুটে হরিণ, কিছু পাখি, দুটো লেপার্ড,কয়েকটা রেড পন্ডা রয়েছে। মূলত এটা ছোটদের জন্যই বানানো এই পার্ক ও জু।
এখান থেকে বেরিয়ে আবার উবের নিয়ে চলে গেলাম Navy Pier এর কাছে। এটা একটা বড় amusement park। অনেক রাইড আছে। ছোট বড় সবাই করতে পারে। নদীর ধারে সুন্দর করে বানানো এই Navy Pier। আমরাও একটা রাইড নিলাম – Ferris wheel। এটা একটা নাগরদোলাই। বৃত্তাকারে ঘুরবে। ঘোরার সময় শিকাগো শহরটাকে সুন্দর দেখা যায়। একদম জোরে ঘোরে না। খুব ধীরে ধীরে দুলে দুলে ওঠানামা করে, ফলে শহরটাকে ওপর থেকে সত্যি দেখতে ভালো লাগে। এই রাইডের টিকিট নিল জনপ্রতি ২০ ডলার।
শিকাগো শহরকে অনেক ওপর থেকে দেখার জন্য রয়েছে একটা চমৎকার observatory- SKY DECK। এখানে উঠে দাঁড়ালে ৩৬০ ড্রিগ্রি দিগন্ত নিয়ে ছড়ানো শিকাগোকে দেখার মজা আরও উপভোগ্য হয়। আমরা সময়ের অভাবে এটা করতে পারি নি। সারাদিন ছুটতে ছুটতে শিকাগো শহরটাকে যতটা পেরেছি এক্সপ্লোর করেছি। দেখে আনন্দ পেয়েছি।
Navy Pier থেকে বেরিয়ে মিশিগান লেকের কাছে চলে এলাম। বিকেল গড়িয়ে গেছে। ঘড়িতে সাড়ে ছটা। কিন্তু দিনের আলো আছে অনেক। আজকের মত আমাদের ঘুরে বেড়ানো শেষ। ক্লান্ত এখন তিনজনই। সেই সকাল থেকে বিকেল টানা সাইট সিয়িং করে চলেছি। তবু কত কিছু বাকি রয়ে গেল। করা সম্ভব হলো না। তাহলে আরও দুটো দিন অন্তত থাকতে হোত শিকাগোয়। কিন্তু সে উপায় তো নেই। এই সব শহরে এক একদিন একজন থাকা- খাওয়ার খরচ কমবেশি ভারতীয় টাকায় দশ হাজার!.. গায়ে বড্ড লাগে। এনেছি তো অনেক কষ্টে জমানো টাকা, ডলারে রূপান্তর করলেই টাকা গলে জল হয়ে যাচ্ছে!.. সে জল আর চোখের জল তখন যেন এক!..
মিশিগানের পার ধরে হাঁটছি। হ্রদের জলে দিনান্তের শেষ আলো পড়ে কেমন একটা মায়াবী রূপ নিয়েছে। এই গোধূলি আলোয় ছবি খুব সুন্দর হয়। হ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। সত্যি খুব সুন্দর হলো ছবিগুলো।
আজ আমাদের তিনজনের একসাথে ভ্রমণের শেষ দিন। কাল আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। তিনজন তিনদিকে চলে যাব। ওদের মঙ্গলবার থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ছোট্ট তিনদিনের ছুটিতে ওদেরও বেড়ানো হলো ইন্ডিয়ানাপোলিস ও শিকাগো। এবার ডুলুং চলে যাবে সাউথ ক্যারোলাইনায়। সোহম সিরাকিউজে। আমি চলে যাব লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স- মিসিসিপির দেশে। শুরু হবে আমার একলা ভ্রমণ। আমেরিকায় এসে এই প্রথম হবে আমার একা একা বেড়ানো। আমেরিকার মত বড় এক মহাদেশে একা একা ঘুরব আগামী আটদিন, প্রথমে যাব নিউ অরলিন্স, তারপর একে একে ফ্লোরিডার মায়ামি, সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লসটন, জর্জিয়ার সাভানা হয়ে ডুলুং এর কাছে সাউথ ক্যারোলাইনায়। একা একা আটদিন ধরে এতগুলো রাজ্যে ঘুরব, ভেবেই কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে। একটু কি ভয় করছে না!.. করছে!.. তাই একটু শঙ্কিত ডুলুং-সোহম। ওরা আমাকে অনেক কিছু বারবার বলে দিচ্ছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে… জীবনে মাঝে মাঝে ছাত্র হয়ে শেখার একটা মজা আছে। আর learning is a continuous process একথা তো সবাই জানি। তাই শিখতে কোনও লজ্জা নেই, শেখার কোনও শেষ নেই। বাধ্য ছাত্রর মত ওদের “ডু আর ডু নটগুলো” শুনে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, একটু আধটু ভুল তবু হয়তো হয়ে যাবে, হারিয়ে তো আর যাব না আমেরিকায় !..বুকের মধ্যে ভূপেন হাজারিকা গুণ গুণ করছেন যে, ” আমি ইলোরার থেকে রং নিয়ে দূরে শিকাগো শহরে দিয়েছি/ আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভলগার রূপ দেখেছি / পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর../ আমি এক… “
আগামীকাল ভোরের উড়ানে আমি একা একা চলে যাব সেই মিসিসিপির দেশে- নিউ অরলিন্স।
মিসিসিপি আমায় ডাকছে!..
শিকাগো এয়ারপোর্ট থেকে কাল সকালে তিনটে বিমান ছাড়বে। তিনজন চলে যাব তিনদিকে।
সাউথ ক্যারোলাইনা!..
সিরাকিউজ!..
নিউ অরলিন্স!..
আমরা তিন ভারতীয় তিনদিকে- আমেরিকার নীল আকাশে কাল উড়ব!..
কি আনন্দ!..
শুভসন্ধ্যা।
খুব ভাল বই হবে।