ধারাবাহিক || ভ্রমণ সিরিজ || সুব্রত সরকার – ৬

।। জাপানের ডায়েরি ।।

হিরোশিমা শহরের বুকে Noboro- Cho, Chuo- ku তে ছিল আমাদের হোটেল -Chisan Hotel Hirosima। এই হোটেলের ঘরগুলো ভীষণই ছোট। সবার খুব অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকে মন খারাপের কষ্ট মুহূর্তে উড়ে যায়, যেই জানালার পর্দা সরালাম, দেখি চোখের সামনে রেললাইন। সুন্দর আকাশ আর শহরের স্থাপত্য। বেশ লাগল বাইরেটা। “নীড় ছোট, ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়…” মনে মনে ভাবলাম, জাপানের এই আকাশ দেখেই আজকের রাত কাটিয়ে দেব ছোট ঘরের দুঃখ ভুলে!…

জাপানে ট্রেন সার্ভিস খুব ভালো। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা ট্রেন নির্ভর। বুলেট ট্রেন তো অনেক আছে। প্রায় মিনিটে মিনিটে আসে- যায়। সঙ্গে আছে সাধারণ ট্রেনও। আর একটা জিনিস চোখে পড়েছে সাইকেল। জাপানীরা খুব সাইকেল ব্যবহার করে। ওরা ফুটপাত দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়। রাস্তায় সচরাচর ওঠে না।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়েছে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে জানালা দিয়ে বাইরের রেল স্টেশন, রাতের নির্জন শহর ও সুন্দর আকাশ দেখে কাটিয়েছি। রাত বারোটার সময়ও দেখেছি লোকাল ট্রেনে অনেক যাত্রী। স্টেশনের বাইরে লাইন দিয়ে সাইকেল রাখা রয়েছে। নিশ্চয়ই এগুলো সব ডেলি প্যাসেঞ্জারদের।
ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। আমার রুমমেট ভূপেনদা অনেক আগেই উঠে তৈরী হয়ে নিয়েছিলেন। ফলে চটজলদি আমিও তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট রুমে চলে গেলাম। খাবারের মেলা আয়োজন। নিজের পছন্দের খাবার খুঁজে খেয়ে নিতে কোনও অসুবিধা হলো না। কদিন ধরে সব কিছু চেখে খেয়ে দেখতে গিয়ে মনের আনন্দে একটু বেশিই খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। ভ্রমণ ও ভোজন যখন মিলেমিশে সুন্দর হয়ে ওঠে- সে আবার এক অন্যরকম মজা।

আমাদের বাস এসে গেল হোটেলের দুয়ারে। একে একে সবাই বাসে উঠে বসলাম। আজও আবার বুলেট ট্রেনে করে হিরোশিমা থেকে ওসাকা যাব। আজ দ্বিতীয়বার বুলেট ট্রেনে ভ্রমণ।
আমরা জাপানে প্রবেশ করেছিলাম ওসাকা দিয়ে। তারপর কিওটো, নারা, হিরোশিমা ঘুরে আজ আবার ওসাকা যাচ্ছি। সেদিন ওসাকা এয়ারপোর্টে নেমে সরাসরি কিওটো শহরে চলে গিয়েছিলাম। ফলে দেখা হয় নি কিছুই সেদিন ওসাকার। আজ ওসাকা স্টেশন থেকে শুরু হবে আমাদের চতুর্থ দিনের ভ্রমণ। সারাদিন ঘুরে বেড়াব ওসাকায়।

হিরোশিমা থেকে বুলেট ট্রেনে শিন ওসাকা কম বেশি একঘন্টা কুড়ি মিনিট লেগেছিল। যাওয়ার পথে ওকাইআমা, হিমেজি, শিন কোবে এমন সব নামের স্টেশন পেয়েছি। এই ট্রেন সফরটা বেশ উপভোগ্য ছিল। রেলপথের দু’ধারে শহর, নদী, পাহাড়, অল্প জঙ্গলও দেখতে দেখতে গেছি। তবে সবচেয়ে বেশি দেখেছি কলকারখানা। নানান ইন্ডাস্ট্রি গিজগিজ করছে। জাপান যে শিল্পোন্নত দেশ তা বুঝে নিতে এতটকু অসুবিধা হয় না।

কিওটো থেকে হিরোশিমায় আসার বুলেট ট্রেনের থেকে এই ট্রেনকে একটু বেশি ভালো মনে হয়েছিল। জানিনা জাপানের এই সব সুপার এক্সপ্রেসগুলো বাইরে থেকে একইরকম দেখতে লাগলেও অঙ্গসজ্জায় কিছু পার্থক্য হয়তো রয়েছে। ট্রেনের গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

শিন ওসাকা স্টেশনের বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ট্যুরিস্ট বাস। শিন ওসাকা বেশ জমজমাট এক স্টেশন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। এই সময়গুলো খুব নিজের দেশের কথা মনে পড়ে! আমরা কেন যে পারি না এমন সুন্দর করে রাখতে!..স্টেশনের বাইরে এসে দূরের এক পাহাড়ের কোলে বৌদ্ধ মন্দির দেখতে পেলাম। শ্বেত শুভ্র এক মন্দির।
ওসাকা জাপানের তৃতীয় জনবহুল আধুনিক শহর। আমাদের বাস শহরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে আজকের প্রথম দর্শনীয় গন্তব্যের দিকে- Umeda Sky Building। জনবহুল শহর তাই সর্বত্র ব্যস্ততা ও শহুরে জিনিসে সেজে সুন্দর লাগছে ওসাকাকে।
এই ওসাকায় ১৯৭০ সালে “এক্সপো সেভেন্টি ” দেখতে এসেছিলেন নারায়ণ সান্যাল। এক্সপো হলো এক বিশ্বমেলা। ‘এক্সপো’ কথাটা ‘এক্সপোজিশান’ শব্দ থেকেই সংক্ষেপিত। প্রথম বিশ্বমেলা হয়েছিল ১৮৫১ সালে, লন্ডনে। তারপর ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন বড় শহরে হয়েছে। কিন্তু এশিয়া ভূখণ্ডে জাপানই প্রথম এর আয়োজন করেছিল। সেই প্রথম মেলার উদ্বোধন করেছিলেন জাপানের সম্রাট হিরোহিতো। সেবছর এক্সপোর মূলবাণী ছিল- ‘Progress and Harmony for Mankind- মনুষ্য সমাজের বিকাশ ও ঐকতান।’

ঘটনাচক্রে এই ২০২৫ এ এসেও দেখলাম জাপানে এবছর এক্সপোর আয়োজন হয়েছে। এবং ওসাকা শহরেই। এবারের মূল বাণী হলো- ‘Designing Future Society for Our Lives”- আমাদের জীবনের জন্য ভবিষ্যৎ সমাজ গঠন।’ এই এক্সপো ভিজিট করা আমাদের সফরসূচিতে ছিল না, তাই আমারও আর তা দেখার সুযোগ হয় নি। এই ছোট ছোট আক্ষেপগুলো থেকেই যায় স্বল্প দিনের গ্রুপ ট্যুরের বিদেশ ভ্রমণে এসে।

শিন ওসাকা স্টেশন থেকে শহরের মধ্যে দিয়ে বাস খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেল উমেদার গগনচুম্বী অট্টালিকার কাছে। বড় জোর মিনিট পনেরো লেগেছে। ওসাকা শহরের অন্যতম সুউচ্চ এক ভবন- উমেদা স্কাই বিল্ডিং। ৪০ তলা এই বাড়ির উচ্চতা ১৭০ মিটার। পাশাপাশি দুটো টাওয়ার। সুন্দর এক স্থাপত্য। এর স্থপতি হলেন বিখ্যাত জাপানি ইঞ্জিনিয়ার হিরোশি হিরা।
এই ৪০ তলার টাওয়ারে উঠতে হয় প্রথমে লিফ্টে করে তারপর এস্কেলেটরে চেপে। দারুণ অভিজ্ঞতা। উমেদার ৪০ তলায় মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ওসাকা শহরটাকে দেখতে বেশ লাগে। চারপাশে আরও অনেক হাইরাইজ। দূরে নদী। সেতু। শহর। খালি চোখে যতদূর চোখ যায় দু’চোখ ভরে দেখলাম ওসাকাকে। আমি এর আগে এত বড় কোনও হাইরাইজে উঠি নি। আমেরিকার শিকাগো শহরেও ছিল এমন একাধিক বিখ্যাত হাইরাইজ বিল্ডিং- উইলিস টাওয়ার, অ্যাকোয়া টাওয়ার। কিন্তু সময়ের অভাবে সেদিন দেখা হয় নি। তাই উমেদার উচ্চতায় উঠে কেমন অন্যরকম এক আনন্দ হচ্ছিল। এটাকে ” ফ্লোটিং গার্ডেন অবজার্ভেটারি” ও বলা হয়। এখানে খুব সুন্দর একটা জিনিস দেখলাম, একটা জায়গায় অনেকেই ছোট্ট তালা ঝুলিয়ে তাদের মনস্কামনা জানিয়ে চাবিটা ফেলে দিচ্ছে। এটা পরস্পরের অটুট বন্ধনের এক গোপন অভীপ্সা। রঙিন তালাগুলো পাশেই বিক্রি হচ্ছে। জাপানী বিশ্বাসে এটা হয়তো খুব পবিত্র। সম্পর্কের চিরবন্ধন। আমাদের তীর্থস্থানে মনের ইচ্ছে জানিয়ে সুতো বেঁধে আসার মতই খানিকটা মনে হয়েছে।।

উমেদার মধ্যে থিয়েটার হল, শপিং সেন্টার, অফিস, ক্যাফে- রেস্টুরেন্ট সহ অনেক কিছু আছে। উমেদা দেখার আনন্দ নিয়ে এবার এগিয়ে চললাম আজকের আরও এক বিশেষ দ্রষ্টব্য ঐতিহাসিক -OSAKA CASTLE দেখতে।

ওসাকা দুর্গ ১৫৮৩ সালে টয়োটোমি হিদোশিয়া নির্মাণ শুরু করেন। শেষ হয় ১৫৯৭ সালে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ১৬১৪ সালে এই দুর্গ দখল করে নেয় টোকুগাওয়া ইয়েয়াসু। তারপরের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এবং সংঘাত জর্জরিত। ওসাকা দুর্গ দখল হয়ে যাওয়ার পর টয়োটোমি হিদোয়ারি ও তাঁর জননী ইয়োডো- ডোনা এই দুর্গের মধ্যেই আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই স্থল একটি পাথর দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা রয়েছে।
ওসাকা ক্যাসলের চারপাশে পরিখা রয়েছে। নীলচে-কালো জলের এই পরিখায় বোট রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। ক্যাসলের চারপাশের উদ্যানও খুব আকর্ষনীয়। চাইলে রোড ট্রেনে করেও আরামদায়ক সুন্দর ভ্রমণ করা যায়। এখানে প্রচুর চেরি ফুলের গাছ দেখেছি। কিন্তু তখনো ফুল ফোটে নি গাছগুলোয়। কুড়ি এসে গেছে। শুনলাম আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে ওসাকায় চেরি ফেস্টিভ্যাল।
আমরা নিজেরাই দলবেঁধে পায়ে হেঁটে ওসাকার ক্যাসলের বাইরে ও ভেতরে ঘুরে বেড়িয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি। এসব ঐতিহাসিক জায়গায় এলে একটা অতীতের গন্ধ ভেসে আসে নাকে। সেই গন্ধে ভ্রমণের বাতাসও তখন কেমন মধুময় হয়ে যায়। চারপাশে বিদেশী পর্যটক। জাপানীরাও রয়েছে অনেক। সব মিলিয়ে ওসাকা ক্যাসল ভ্রমণ মনে রাখার মত এক স্মৃতি।

এরপর আজকের দিনের শেষ দ্রষ্টব্য ছিল ওসাকা শহরের বুকে ফিরে এসে Dotonbori নদীর কাছে বেড়ানো ও নিজের মত সময় কাটানো। অর্থ্যাৎ Free Time। ফিরে আসতে হবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাসের কাছে।সময় জানিয়ে দিলেন আমাদের দুজন গাইড কাওয়াসাকি ও অশোকদা।

ডোটনবরি নদীর দু’পাশে ওসাকা শহর ও শপিং সেন্টার। আমরা সবাই যে যার মত আলাদা হয়ে হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। আমি একা একাই ঘুরে বেড়ালাম অনেক অলি – গলি। নিজের থেকেই কথা বলার চেষ্টা করলাম পথ চলতি জাপানীদের সঙ্গে। কফি খেলাম গল্প করতে করতে দোকানীর সঙ্গে। শপিং সেন্টারে ঘুরতে ঘুরতে কিনে ফেললাম একটা ছাতা মেয়ের জন্য। বেশ সুন্দর হাল্কা একটা ছাতা। পকেটে করেও নিয়ে যাওয়া যায়। দাম পড়ল ১৩০০/- ইয়েন।

এরপর চোখে পড়ল জাপানী সুরার দোকান।
কৌতুহল নিয়ে ঢুকে দেখলাম জাপানী হুইস্কি, বিয়ার, টোবাকো- চুরুটের সব নামগুলো। যেমন The Yamazaki Single Malt Japanese Whisky, HIBIKI Whiskey, Premium Master’s Dream Whiskey, The Hakushu।
বিয়ার দেখলাম SINTO, KAGURA, ISE PILSNER। চুরুট দেখলাম Kiseru Tobacco । দোকানীকে কোন বিয়ার ভালো বলায় সে এগিয়ে দিল SINTO বিয়ারের একটা ক্যান। কিনেও নিলাম একটু স্বাদ নেওয়ার জন্য।

তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নদীর কাছে। এই Dotonbori শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে। নদীতে পর্যটকদের জন্য বোট রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। কুড়ি মিনিটের জন্য দেড় হাজার ইয়েন!..
আমি নদীর ধারের একটা ফুড কর্ণারে বসে পড়লাম। গরম গরম চিকেন স্টিক নিয়ে জাপানী বিয়ার সিনটোর স্বাদ নিলাম। এই ক্যান বিয়ারটা খেয়ে খুব ভালো লেগেছিল। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ডোটনবরি নদীর চারপাশের আলোগুলো একটু একটু করে জ্বলে উঠছে। মিউজিক সিস্টেমে গান বাজছে। হৈ হুল্লোড়ে জায়গাটা জমজমাট হয়ে উঠছে। একদম কার্নিভ্যাল ফ্লেভার। সবাই আনন্দ করছে। হরেকরকম খাবার ও পানীয়। জাপানী সুন্দরীরাও কিমোনো পরে দলবেঁধে বসে রয়েছে নদীপারের দোকানগুলোয়। সন্ধের অস্তরাগের দিকে তাকিয়ে মন একটু বিষন্নই হল, এবার তো ফিরে যেতে হবে বাসে। সময় শেষ। মনে মনে খুব আফসোস হচ্ছিল, এই শহরের নাইট লাইফটা অদেখা রয়ে গেল। খোলামনে খালিচোখে ভ্রমণের আনন্দ নেওয়ার মত একটা মন ও মনন নিয়ে সব জায়গায় যাই, সেই জায়গা ও সেখানকার জীবনযাত্রাকে দেখে ঋদ্ধ হতে চাই। কিন্তু হয় না সব সময়। না হলেই বেদনা, হলেই জড়ো হয়ে যায় লেখার মত সোনাদানা!..তাই ওসাকার সারাদিন মনে থাকবে। কিন্তু সন্ধ্যা- রাত্রির ওসাকাকে আমি দেখতে পাই নি!..

হোটেলের পথে ফিরে চলেছে বাস। তার আগে প্রতিদিনের মতই আজও ডিনারে জাপানী ডিশ শহরের কোনও ভালো রেস্টুরেন্টে।
আগামীকাল আবার নতুন ভ্রমণে চলে যাব জাপানের আরও এক সুন্দর জায়গা – Mikimoto Island এবং সমুদ্র সৈকত Aichi।

জাপানে এসে ভ্রমণের আনন্দে একটা একটা করে দিন শেষ হয়, আর স্মৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। এই সব সুখস্মৃতি বড় সম্পদ আমাদের জীবনে। একটাই তো জীবন- তাকে বর্ণময় স্মরণীয় করে রাখার জন্য পথিক হয়েই বাঁচতে চাই বাকী জীবনটা, গাইতে চাই, ‘আমার পথ চলাতেই আনন্দ!..আমি সুদূরের পিয়াসী!..ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি, হে সুদূর, আমি উদাসী… ‘

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *