নানি যে সত্যি সত্যিই মাচা থেকে কচি কচি লাউডগা গুলো কেটে এনে বলবে,” বেটা নে যা। বউমাকে বলবি, বড়ি দিয়ে ভালো করে রাঁধতে।”
শুভ্র ভাবতে পারে নি। তাই থমকে যায়। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে নানির দিকে।
সরকারী কাজে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে হচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু কথা, দুটো গল্প হচ্ছে। জল বাতাসাও খেতে হয়েছে। কাজের মধ্যে দিয়ে এই গ্রাম ভ্রমণের মজা শুভ্র বেশ উপভোগ করছে।
ভোট নিচ্ছে পোলিং অফিসার। ছবি ও রেকর্ডিং করছে ভিডিওগ্রাফার। বি এল ও বাড়ি চিনিয়ে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সেক্টর অফিসার, রাজ্য পুলিশের প্রতিনিধি ও আধা সেনাবাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানরা। এটা একটা দলগত কাজ। শুভ্র এই দলের পর্যবেক্ষক। মাইক্রো অবজার্ভার। সব কিছু দেখছে। খেয়াল করছে। কোনও অসংগতি হলে ওর রিপোর্টে তা জানাতে হবে।
নানির বাড়ির পুকুর পাড়ের মাচায় কচি কচি লাউডগা দেখে শুভ্র মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। দুটো সুন্দর ছবিও তোলে। মুন্নাকে পাঠাবে বলে। মুন্না এসব ছবি দেখলে খুব খুশি হয়। নানি দূর থেকে তা খেয়াল করেছে। শুভ্ররা বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই নানি হেসে বলে,” লাউডগা গুলো পছন্দ হয়েছে না!”
শুভ্র হেসে বলে,” সত্যি কি সুন্দর তোমার শাকগুলো। একদম কচি।”
ফোঁকলা দাঁতে নানি হাসতে হাসতে বলে,” চারটে ডগা কেটে দিচ্ছি নে যাও বাপ।”
পোলিং অফিসার ও অন্যান্যরা তো মুচকি মুচকি হাসছে। শুভ্রর কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই সব গাছপালা, পুকুর- ডোবা, ফুল- ফলের ছবি তোলা ও দেখার উৎসাহ ওরা খেয়াল করেছে। পুলিশের এক দিদি মজা করে বলেই দিলেন,” স্যার, এমন সুন্দর টাটকা শাক বাজারেও পাবেন না। নানি ভালোবেসে দিচ্ছে যখন, নিয়ে যান।”
নানি হেসে তখন বলে,” ও মেয়ে, তোমাকেও চারটি দেব।”
নানির বাড়ির লাউশাক নিয়ে শুভ্ররা পরের ভোটারের বাড়ি পৌঁছেই শুনল, বদরুদ্দীন শেখ নাকি ভোট দেবেন না! বাড়িতেই আছেন। সুস্থ আছেন। তবু ভোট দেবেন না।
ভোট নিতে এসে এমন ঘটনা এই প্রথম। আজ এর আগে আটজন আশি বছরের উর্ধে মানুষরা ভোট দিয়েছেন বিনাবাক্যে। স্বেচ্ছায়। হাসিমুখে। বদরুদ্দীন শেখ হঠাৎ কেন বেঁকে বসলেন ওরা তা বুঝে উঠতে পারছে না। এখন কি করবে তাই ভেবে আকুল সবাই।
ছড়ানো বাড়ির মস্ত উঠোনে ভাঙ্গা একটা তক্তপোষ। তার ওপরে আদ্দিকালের রংচটা একটা শতরঞ্জি। তুলো বসে যাওয়া তেল চিটচিটে একটা পাতলা বালিশে বদরুদ্দীন শুয়ে আছেন আকাশপানে চেয়ে। ওঁর বড় ছেলে কাসেম অনেক বোঝায়,” আব্বা, আপনি এমন করবেন না। ওঁনারা বাড়িতে এসেছেন। আপনার ভোটটা দিয়ে দিন।”
কানে তোলে না বদরুদ্দীন কাসেমের কথা। বউমাও বলতে এসেছিল, তার কথাও শোনো নি। ভোটবাবুদের দলের বি এল ও রশিদা বিবি এবার বলল,” চাচা, তুমি তো নাম লিখিয়েছিলে আমার কাছে। তখন তো বলেছিলে বাড়িতে বসে ভোট দেবে। এখন ভোট দেবেই না কেন বলছো?”
সেক্টর অফিসার আমতা আমতা করে বললেন,” আমরা কি বলব বলুন তো আপনি ভোটটা না দিলে!”
শুভ্র লাউডগায় ভরা ব্যাগটা হাতে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব পর্যবেক্ষণ করছে। মাইক্রো অবজার্ভারের কাজই তাই। বদরুদ্দীন শেখ পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়া সাচ্চা মানুষ। ব্রিটিশ খেদানোর গল্পও শুনিয়ে দিয়েছেন এক ফাঁকে। যৌবনের সে গল্প বলতে বলতে তাঁর চোখ মুখ ঝলমল করছিল। তাই সে যখন পণ করেছেন এবার ভোট দেবেন না, তখন তাঁকে রাজি করানো আল্লাতালারও কাজ নয়!
আধাসেনা জওয়ানরাও হতভম্ব। পোলিং অফিসার অপ্রস্তুত। শুভ্র অল্প দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে আছে। এমন সময় বদরুদ্দীন শেখ আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে চোখদুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন,” খালি ভোটের সময় আমাদের মনে পড়ে! সারাবছর সরকার চোখে ঠুলি লাগিয়ে অন্ধ সেজে থাকে। আগেরবারও তো বলেছিল,রাস্তা করে দেব। পানি এনে দেব। বড় একটা স্কুল হবে। করে দিয়েছে? কিচ্ছু টি করে নি! ফের এসেছে ভোট মাঙতে! শুধু ভাঁওতা! মিথ্যার বেসাতি। আমি এবার ভোট দেব না!..” শেষ কথাটা চিৎকার করেই যেন শোনালেন সবাইকে।
বদরুদ্দীনের বড় ছেলে কাসেম আরও একবার চেষ্টা করে বললেন,” আব্বা,আপনি সত্যিই ভোট দেবেন না!”…
” না!” প্রতিবাদী উচ্চারণ টা দীর্ঘ হল। তারপর একটু থেমে গভীর ভাবনায় ডুব দিয়ে বদরুদ্দীন বললেন,” আমার মেরুদণ্ড টা ঐ স্যারের হাতে ধরা লাউডগার মত নড়বড়ে নয়। ভোট দেব না একবার যখন বলেছি, দেব না।”…
সবাই হতচকিত হয়ে তখন চেয়ে থাকে শুভ্রর দিকে। শুভ্রর হাতে ধরা ব্যাগটার কচি কচি লাউডগা গুলো কেমন লক লক করে দুলছে। ডগার শূঁড়গুলো বাতাসে ভাসছে। ছোট্ট সাদা লাউ ফুলটা কি সুন্দর হাসছে। কিন্তু সেই শাক আর তার সব সৌন্দর্য হঠাৎ যেন হারিয়ে গেল!…
লাউডগা তো সত্যিই বড় নড়বড়ে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মেরুদন্ড নেই লাউডগার। বদরুদ্দীন শেখের কথার ঝঙ্কারে শুভ্র মোহিত হয়ে চেয়ে থাকে মানুষটার দিকে!
ভোট না দিতে চাওয়া শিরদাঁড়া সোজা বদরুদ্দীন কে নিয়ে বেজায় ধন্দে তখন সকলে!…