ক্যাফে ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজে সুব্রত সরকার (পর্ব – ১)

চেল খোলার গান – অপরুপ গোরুবাথান 

কোথাও বেড়াতে গিয়ে সেই গ্রাম বা জনপদের হাট ও নদী দেখার ইচ্ছে আমার বরাবরের। তাই গোরুবাথানে এসে যেই শুনলাম, আজ সোমবার, হাটবার। আমার আনন্দ আর ধরে না!

একলা ভ্রমণের এটাই মজা! নিজের ইচ্ছেতে স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো যায়!.. “হাটে কি এমন আছে, যে দেখতে যাব?”এমন ভেংচে বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই!

গোরুবাথান ডুয়ার্সের একটা ছোট্ট জনপদ। নিউ মাল থেকে খুব সহজেই চলে আসা যায়। আবার শিলিগুড়ি থেকেও আসা যায়। কিন্তু আমি আজ এসেছি একদম সিকিমের পাহাড় চূড়া থেকে। পূর্ব সিকিমের এক প্রান্তিক গ্রাম রোলেপ থেকে ভোর বেলায় বেরিয়ে রংলী, রেনক, পেডং, আলগারা, রিকিসুম, রিশপ, লাভা, পাপরক্ষেতি হয়ে গোরুবাথান। কমবেশি দুশো কিমি পথ পেরিয়ে নিচে নেমে আসার কারণ হল উত্তর সিকিমের ঘটে যাওয়া ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তাই পাহাড় থেকে চটজলদি নেমে আসা।

গোরুবাথানে অতিথি হোম স্টের অতিথি হয়েছি। হোম স্টে থেকে সামান্য দূরেই হাট বসেছে। প্রতি সোমবার বসে বলে এই হাটের নাম সোমবারি। জমজমাট হাট। আশপাশের সব পাহাড়ি বস্তি থেকে মানুষজনরা এসে বিকিকিনি করছে। হরেকরকম পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা।

সব্জি, জামা-কাপড়-জুতো, বাসন, ফার্ণিচার, লোহার যন্ত্রপাতি, সানগ্লাস, টুপি, থেকে শুরু করে শুটকি মাছ, ক্ষয়ের পাতা সব আছে।

হাট ঘুরতে ঘুরতে মাছ বাজারের পেছনের নদীর ধারে চলে গেলাম। চেল নদীর অপূর্ব সুন্দর জলধারা বয়ে চলেছে সগর্জনে। আর নদীর চরে কাশফুলের ছড়াছড়ি। আশ্বিন মাস। শরৎ কালের নীল আকাশ নদীর জলে ছায়া ফেলে কি দারুণ এক দৃষ্টিসুখ সৃষ্টি করেছে। একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম এক প্রাচীন ঝুলন্ত সেতু। সেই সেতুতে দাঁড়িয়ে চারপাশের গোরুবাথানকে পাখির চোখে দেখার মজা অতুলনীয়। সেতু দোল খায়। হাটের মানুষরা সমানে দল বেঁধে যাওয়া আসা করছে। দাঁড়িয়ে থাকতে একটু ভয়ও করছিল। তাই সেতু বেয়ে ওপারে চলে গেলাম। ওমা আরও একটা ছোট্ট সেতু! তবে এটা খুব পুরোনো নয়। বাঁশের সেতু। বাঁশের রং দেখে মনে হল তাই।

আসা যাওয়া করা লোকেদের থেকেই জানলাম ওপারে কি কি বস্তি আছে। মায়ালু বস্তি, পাথরঝোরা, নোম বস্তি ও ছোটা মাংজিন। হাটের মানুষগুলোর মধ্যে কি আনন্দ।  সবাই খুব হাসিখুশি মনে হাটে সওদা করছে। হাটে ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হল ওদলাবাড়ির ক্রান্তি থেকে ফুলের গাছ নিয়ে আসা মহম্মদ আলির সাথে। সে সপ্তাহের পাঁচদিন পাঁচটা হাটে যায়। বাকি দুূদিন গাছের চারা তৈরী করে।

গোরুবাথানে অনেক চা বাগান। অ্যামবিয়ক টি গার্ডেনের খুব নাম। চা বাগানে ঘুরে বেড়াতে খুব মজা। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক উড়ন্ত ময়ূর দেখলাম! সে চকিতে অনেকটা উড়ে গিয়ে একটা গাছের ডালে বসল। এ দৃশ্য দেখা এক দারুণ আনন্দ।

গোরুবাথান পাহাড় নদী চা বাগানে ঘেরা এক শান্ত জনপদ। সহজেই চলে আসা যায়। চারপাশে অনেক পরিচিত বেড়ানোর জায়গাও রয়েছে। ঝান্ডি, ডালিমটাঁড়, পশ্চিম ডামডিম, মাগুরমারি, কাঠামবাড়ি ফরেস্ট, সুনতালেখোলা, রকি আইল্যান্ড, চালসা।

আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পর্যটকের মত হঠাৎই চলে এসেছি গোরুবাথানে সিকিম ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে। তাই এসে অল্প বেড়িয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার আনন্দে গোরুবাথানকে দারুণ উপভোগ করলাম। মনে হয়েছে গোরুবাথান যেন একটু অনাদরে, একটু আন্ডার রেটেড এক ডেস্টিনেশন হয়ে রয়েছে ডুয়ার্সের পর্যটন মানচিত্রে।

চেল নদীর শোভা, চা বাগান, ছোট ছোট পাহাড়, অল্প জঙ্গল আর নিরিবিলিময় শান্ত স্নিগ্ধ পাহাড়ি পথ নিয়ে গোরুবাথান অপূর্ব। শুধু পায়ে হেঁটে ঘুরলেও গোরুবাথানকে উপভোগ করা যায়। মুগ্ধ হওয়া যায়।

গোরুবাথানের সেরার সেরা চেল খোলার জলের গান, তাই অপরুপ গোরুবাথান!..

কিভাবে যাবেন- নিউ মাল জংশন থেকে ডামডিম মোড় হয়ে গোরুবাথান সহজেই চলে আসা যায়। আবার  জলপাইগুড়ি -শিলিগুড়ি থেকেও আসা যায়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Rumpi Mukherjee says:

    অসাধারণ লাগলো
    গরুবাথান না গিয়েও বেশ উপভোগ করতে পারলাম ঘরে বসে ভালো লাগলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।