এলাকার কচি নেতা নিধু মিত্তিরের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার খুব সাধ। তবে, সাধের সঙ্গে সাধ্যের সমন্বয়ের অভাব। লাল-সাদা দলে তাঁর অবস্থান অনেক টা নীচের দিকে, ওই ক্যাটারার দলের পাত কুড়োনীর মতো, তাই কবে যে কপালে শিঁকে ছিঁড়বে তা বলা মুশকিল!
নিধু বাবু রসিক মানুষ, তবে নিন্দুকে বলে সকাল থেকেই সুধারসে টইটম্বুর থাকেন তাই অনর্গল জনসংযোগ করতে পারেন। ওতে কোনো দোষ নেই। তাঁর নিপাট ভালোমানুষ মার্কা সদাশিব চেহারা। নেতাসুলভ গেরেমভারি হাবভাবও নেই, বরং কবি কবি ভাব বেশী! হেতমপুর গ্রামের যাবতীয় উৎসব অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি বাঁধা। তবে ওই ‘হ্যালো হ্যালো, মাইক টেস্টিং’ থেকে শুরু করে ‘এবার আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন মাননীয় শ্রী অমুক চন্দ্র তমুক’ পর্যন্ত।
কদমতলার চায়ের ঠেক এ বসে আপন মনে চিন্তা করছিলেন নিধু মিত্তির, তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন আর সামনে বসা জনতা তাঁর বক্তব্যের ঝাঁঝে শিউরে শিউরে উঠছে। লাল-সাদা দলে নয় নয় করে কুড়িটা বছর হয়েছে, আর কত অপেক্ষা করা যায়! চারপাশ দিয়ে নতুন নতুন রক্ত গরম ছেলে ছোকরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ধমকে চমকে রাখছে, নিধু বাবুদের মতো মানুষেরা এরপর ভীড় হয়ে যাবেন একসময়! এদিকে দলের বড়নেতা নন্দদুলাল পুরকায়স্থ মোটেই বলতে জানেন না। অথচ নন্দবাবুর অনেক বক্তৃতাই নিধুবাবুর লিখে দেওয়া। নন্দ দুলাল পুরকায়স্থ মাধ্যমিকে ডাব্বু খেয়েছেন তিনবার, ভরসার কথা জনগণ জানেন শিক্ষাব্যাবস্থার হাল সেযুগে কেমন ছিল, শিক্ষা টিক্ষার হাল তো পানি পেল এই সেদিন! কিন্তু কথা সেটা না, কথা হচ্ছে নাইন পাশ নন্দু গাঁক গাঁক করে বলতে পারেন বটে, তবে মানুষ যে কিছুই শোনেনা সেটা নিধু মিত্তির হলফ করে বলতে পারেন। যাঁর লেখা, তাঁর তো মায়া হবেই লোকে না শুনলে!
নিধু জানেন, বলতে উঠে শুরুটা করতে হয় মোলায়েম ভাবে, যাতে মানুষ জন একটু গা এলিয়ে বসতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়বে লয় আর তাল। যত লয় বাড়বে তত গলার জোর বাড়বে, বাড়তে বাড়তে ঝড়ের গতিতে পৌঁছে যেতে হবে একদম চড়ায়, সামনের মানুষগুলোরও তখন নিঃশ্বাস বন্ধ, গোল চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে…ঠিক এমন সময় ঝপ করে নামতে হবে খাদে! সবার নিঃশ্বাস পড়বে একসাথে, সভাস্হলে বয়ে যাবে ছোটখাটো ঝড়…এভাবে চড়া-খাদ, চড়া-খাদের নাগরদোলা চক্কর, তবে না বলার মতো বলা! ওসব ওই নাইন পাশ দিয়ে হয়? ‘হুহ্’ বলে ঠক্ করে কাঠের বেঞ্চিতে গ্লাসটা নামালেন নিধু।
দুধ জ্বাল দিতে দিতে উল্টো দিকে ফটিক সব নজর রাখছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল। সে বলল, ‘নিধু দা যে বড় ভাবতে লেগেছেন আজকাল! তা অবশ্য আপনারা ভাববেন না তো কে ভাববে!’
নিধু বাবু বললেন, ‘তা ভাই, শুধু ভেবে ভেবে কে আর কবে বড়লোক হয়েছে বলো, মানুষের মাঝে সঠিক ভাবে বক্তব্য পৌঁছে দেওয়াটাই বড়ো ব্যাপার!’
‘এই যেমন আমার ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘রোদ্দুরে বারোমাস’। আমিই সম্পাদক, প্রধান পৃষ্ঠপোষক, প্রধান লেখকও, তা বলে বই বিক্রির সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামাবো? চলবে? আসল কথা হলো ছেলে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার, জনচেতনা।’ নিধু বলেন।
ফটিক কথা বাড়ায় না। নিধু মিত্তিরের ছেলে গেলবার হেতমপুর হাইস্কুলে মাধ্যমিকে নকল সাপ্লাই দিতে গিয়ে পুলিশের ঠ্যাঙানি খেয়ে গোড়ালি ভেঙে বিছানায় ছিল দু’মাস। আর মেয়ে মালগাড়ির গতিতে ঢুকু ঢুকু গড়িয়ে কলেজে উঠেছে সদ্য। দশের ছেলের ভালো করার আগে কেন যে এঁরা নিজের ছেলেমেয়েদের দেখেন না, ফটিকের মাথায় ঢোকেনা। নিধু বাবু এগারোটায় চলে গেলে ছেলে আসবে চা খেতে। সিগারেট বাবদ ইতিমধ্যেই পাঁচশ আশি টাকা তার কাছে পাওনা!
এদিকে দুঃখের কথা, আজ বাদে কাল স্বাধীনতা দিবস, এবছরও নিধুর লিখে দেওয়া বক্তব্য পাঠ করবেন, হাততালি কুড়োবেন বড় নেতা নন্দ। তার প্রস্তুতি দেখতেই সকাল সকাল কদমতলায় আসা। শহীদ বেদী পরিস্কার করা, পতাকার চেন টাঙানো, বাঁশ বেঁধে রাস্তা আটকানো, ফটিকের দোকানে চায়ের ভাঁড়ের যোগান দেখা, চেয়ার টেবিল, মাচা বাঁধা, মাইক বাঁধা ইত্যাদি সাত সতেরো কাজ।
অনুষ্ঠান শুরু হ’ল সকাল ন’টায়। পাড়ার মানুষ গুটিকয়, কিশোর বাহিনীর ছেলেরা, পাশের প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চা কাচ্চার দল, বড়, মেজ, সেজ, ছোট এবং কচি নেতার দল, বড় নেতাদের বডিগার্ড জনা ছয়, এই তো, মেলা লোক। মোবাইলে অনুষ্ঠানের ভিডিও তুলে লাইভ স্ট্রিমিং হবে এবার। নন্দবাবু ইয়াং জেনারেশনের মন বোঝেন। সাত সকালে শুধু পতাকা তুলব বললে ছেলের দল আসবেনা জানা কথা, আঙুলে ঘি দেখিয়ে মুখ দেখানোর টোপ দিলে ছেলেপুলে আসবে ভেবে লাইভ স্ট্রিমিং।
প্রথমে ছোটনেতা দুচার কথা বলার পর মেজ নেতা শহীদ বেদীতে মাল্যদান করলেন। তারপর কচি নেতা নিধু ঘোষণা করলেন, ‘আপনারা সবাই শান্ত হয়ে বসুন, এখন মঞ্চে আসছেন জনদরদী, আপনাদেরই ঘরের ছেলে শ্রী নন্দদুলাল পুরকায়স্থ মহাশয়।’
বড়নেতা নন্দদুলাল ফিসফিস করে বললেন,’আরে গাধা, মঞ্চে আসবো কী রে, মঞ্চেই তো আছি, বল পতাকা উত্তোলন করবেন’!
নিধু তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘এখন আপনাদের সামনে পতাকা উত্তোলন করে দেখাবেন মাননীয় শ্রী নন্দদুলাল মহাশয়’।
নন্দবাবু আড়চোখে নিধুকে মেপে হাসিমুখে নীচে নামলেন। জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হলো। তারপর পরস্পরকে অবাক সবাই দাঁড়িয়ে নির্ভুল জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন।
মাইকে ঘোষণা হলো, ‘এবার নন্দবাবুকে বিনীত অনুরোধ করছি উপস্থিত জনগণের প্রতি কিছু মূল্যবান বক্তব্য রাখুন’।
মেজনেতা সেই থেকে মোবাইলে লাইভ। অনেক লাইক, লাভ ইমোজি আসছে। ‘মেরা ভারত মহান’ আসছে বেশী। ‘আই লাভ মাই ইন্ডিয়া’ সাথে টকটকে লাল হার্ট সাইনও আসছে প্রচুর। মোবাইল স্ক্রীনে এবার নন্দবাবুর মুখ, “…… আজকের এই দিনে, আপনারা জানেন আজ থেকে অনেক বছর আগে, সেই সুদুর বিলেত থেকে কালাপানি পার হয়ে একদল দস্যু আমাদের এই পূণ্য ভূমি কলকাতা মহানগরে এসেছিল…তারা ছিল অসভ্য বর্বর! এসেই আমাদের মহানগরী ছারখার করে,লুটপাট করে সব জাহাজে ভরে ভরে নিজের দেশে পাঠিয়েছিল। তারপর দেখতে দেখতে গোটা দেশকে শ্মশানে পরিণত করেছিল ওই অসভ্য ইংরেজ সাহেবরা। এবং এই রাহুর দশা চলেছিল পাক্কা দুশো বছর। তারপর আমাদের এই বাংলার দামাল কিশোর, এই এমম্…”
ততক্ষণে ছেলেপুলের মুখ টিপে হাসা নন্দদুলাল দেখতে পেয়েছেন। অভিজ্ঞতায় বুঝলেন কিছু ছড়িয়েছেন। বিলকুল না দমে তিনি আবার শুরু করলেন, “… আমাদের দামাল বালক ক্ষুদিরাম প্রথম পথ দেখিয়েছিল, কী করে ইংরেজ সাহেব দেশ ছাড়া করতে হয়। আমাদের নেতাজী বলেছিলেন, ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’…তারপর….তারপর… আমাদের গান্ধীজী বলেছিলেন ‘অংরেজ ভারত ছাড়ো’ তারপর অনেক আন্দোলন হয়েছিল আপনারা সবাই জানেন। আমি আজ আর বেশী কথা বাড়াবো না, মনীষীরা বলে গেছেন, কথায় নয়, কাজে বড়ো হতে হবে আমাদের। আসুন আমরা সবাই হাত হাত ধরে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই, এ দেশ তোমার আমার, আমাদের সবার। জয় ভারত, জয় হিন্দ, জয় বাংলা”।
নন্দবাবুর চোখ বনবন করে ঘুরছে, নিধু মিত্তিরের খোঁজে। ভাবখানা এমন, পেলে এখানেই আছাড় মেরে প্যাটা পিত্ত গেলে দেবেন। ভরা সভায় এমন ভরাডুবি আগে কখনো হয়নি!
নিধু মিত্তির ততক্ষণে পগার পার। পাশের পাড়ার পাকুড়তলা মোড় এ লাল-নীল দলের হয়ে পতাকা তুলেছেন এই মাত্র। মাইক হাতে গুছিয়ে বলতে শুরু করেছেন, ” বন্ধু, সাথী এবং আমার ছোট ছোট ভাই বোনেরা, আজ আমরা এই পূণ্য প্রভাতে তেরঙা পতাকার তলে সমবেত হয়েছি চুয়াত্তর তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে। তোমরা সবাই জানো এই স্বাধীনতা শত শত বীর শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি….,” হাততালি পড়তে থাকে চটাপট।