ধারাবাহিক ভ্রমণ সিরিজ আমেরিকার ডায়েরি || সুব্রত সরকার – ১১

আমেরিকার ডায়েরি -১১

।। ইন্ডিয়ানাপোলিস- ২৯ অগাস্ট,  বৃহস্পতিবার।। 

মধ্যরাতে অ্যালার্ম বাজল। রাত দুটো!..

বিছানায় আর নয়। আজ ভোরের উড়ান। সাউথ ক্যারোলাইনার কলম্বিয়া এয়ারপোর্টে পৌঁছে যেতে হবে কাকভোরে।

 আজ যাব ইন্ডিয়ানাপোলিস। আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী শহর ইন্ডিয়ানাপোলিস। আমেরিকার ২৯ তম বড় শহরের শিরোপায় ভূষিত ইন্ডিয়ানাপোলিস।

 সাউথ ক্যারোলাইনার কলোম্বিয়া এয়ারপোর্ট  থেকে সকাল ৬ টায় বিমান। প্রথমে যাব আটলান্টা। এক ঘন্টার আকাশপথে সফর। তারপর দেড় ঘন্টার লে ওভার। পরবর্তী বিমানে সরাসরি ইন্ডিয়ানাপোলিস। সেখানে সোহমও চলে আসবে সিরাকিউজ থেকে। আমাদের দু’ পক্ষের  বিমান মোটামুটি একই সময়ে ল্যান্ড করবে ইন্ডিয়ানাপোলিসে। দেখা হবে ওখানে।

ইন্ডিয়ানাপোলিসে হোটেলে নয়, থাকব অতিথির বাসভবনে। যাঁর অতিথি আজ আমরা, তিনি একজন সফল ভারতীয় বাঙালি। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে আমেরিকায় রয়েছেন। West Lafayette এর বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি PURDUE  UNIVERSITY-র Distinguished Professor। নাম তাঁর প্রফেসর কুমারেশ চন্দ্র সিনহা। ৮৬ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। সম্পর্কে আমার জামাই, সোহমের মামাদাদু।

ডুলুং আর আমি  SAGA Apartment থেকে বেরোলাম। ভোরের আলো নেই। রাতের অন্ধকারে উবের চলে এলো। কলম্বিয়া  এয়ারপোর্ট কম-বেশি ৮ মাইল। এমনিতেই  এদেশে পথে লোক কম দেখা যায়। এই শেষরাতে কাউকেই দেখতে পেলাম না। পথ শুনশান। মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে যাচ্ছে শহর। কলম্বিয়ার আরও একটা দিক দেখতে দেখতে চললাম। এপথেও সুন্দর সুন্দর বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, ফুলের বাগান সহ সবুজ লন সাজানো রয়েছে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে হুশ করে পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট। খুব বড় নয়। বেশ ঝা চকচকে সুন্দর। সময়মত পৌঁছে গেলাম। ঘড়িতে তিনটে পঞ্চান্ন। ট্রাভেলার একদম কম। সিকিউরিটি চেকিং এর সময় একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। সেখানে দায়িত্বে থাকা একজন কালো আমেরিকান যুবক  হঠাৎ বললেন, “নমস্তে!”

আমরা তো অবাক হয়ে বললাম,” নমস্তে। গুড মর্নিং।”

সে মুচকি হেসে বললেন, “কেমছো”?

ডুলুং বলল, “উই আর নট ফর্ম গুজরাট” ।

“ও! সরি!..ক্যায়সে হো?”

আমরা বললাম,” ফাইন।”

তারপর অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে হাসতে হাসতে বললেন, “I have some Indian friends।” সকাল বেলার এই মধুর স্মৃতি মনটাকে বেশ ফুরফুরে করে দিল।

এবার আমরা এসে বসলাম লাউঞ্জে। হাতে প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা। বোর্ডে দেখলাম আমাদের ফ্লাইট নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। দেখাচ্ছে ON TIME।

কিছুটা সময় বসে থাকার পর এখানেও একটা মজার জিনিস দেখলাম, রিপোর্টিং ডেস্কের কাছে এসে একজন দীর্ঘাঙ্গী অ্যাফ্রো- আমেরিকান যুবতী খুব হেসে হেসে কি যেন বললেন। তারপরই মাইকে ঘোষণা শুনলাম, এই যুবতী এখানকার স্টাফ। তাঁর আজ জন্মদিন।উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে উইশ করলেন। মেয়েটিতো খুব খুশি। “থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু “বলেই চলল! জীবনের এই সহজ আনন্দগুলো কুড়িয়ে পেতে খুব ভালো লাগে। এগুলো দিয়েই তো কথামালা গাঁথা হয়ে যায়।

আজ আমাদের ডেলটা এয়ারলাইন্সের বিমান। সময় মত ছাড়ল না বিমান। মাইকে ঘোষণা করে জানাল, জেটওয়েতে একটু সমস্যা হচ্ছে। মেকানিক দেখছেন। ঠিক হলেই জানানো হবে। একটু বিরক্ত হলাম। কিন্তু কিছু করার নেই। আমেরিকারও এমন হয়!..

কুড়ি মিনিট দেরীতে বিমান ছাড়ল। বিমান রানওয়েতে টেক অফ করতেই একটু একটু করে মহাশূন্যে ভেসে গেলাম। এই মুহূর্তটা আমি খুব এনজয় করি। উড়ছে উড়ছে আরও উঁচুতে উঠে গিয়ে যখন চলতে শুরু করে তারপর থেকে একটু যেন একঘেয়ে লাগে। কিন্তু জানলা পেলে সেটা কিছুটা কমে যায়। আজও ডুলুং আমাকে উইন্ডো সিট গিফট করেছে। তাই জানলা দিয়ে মেঘের দেশের দৃশ্য দেখতে দেখতে চললাম।

আটলান্টায় লে ওভার আছে। এই জার্নিটা এক ঘন্টার। আটলান্টায় নেমে টার্মিনাল খু্ঁজে ইন্ডিয়ানাপোলিসের বিমানে উঠে পড়লাম।

ইন্ডিয়ানাপোলিস আমেরিকার জনপ্রিয় ভ্রমণ সার্কিটের মধ্যে ঠিক পড়ে না। কিন্তু এটাও একটা বড় শহর। সুন্দর শহর। অনেক কিছু দেখার আছে- Monument Circle, Museum of Art, White River State Park, Lilly House & Gardens, Zoo, Botanical Garden, Dolphin Pavilion।

আমরা যাচ্ছি সোহমের মামাদাদুর অতিথি হয়ে। তাঁর আমন্ত্রণেই আমাদের আগমন। আমাদের একরাত্রির সফর। মূলত তাঁর সাথে দেখা করা ও একটু দেখে নেওয়া শহরটাকে।

ইন্ডিয়ানাপোলিসে নেমে সোহমের সাথে দেখা হয়ে গেল। প্রায় একই সময়ে দুটো বিমান ল্যান্ড করেছে। আমরা তিনজন এবার এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই দেখি, হাত নাড়ছেন মামাদাদু।

আমার ও ডুলুং এর সঙ্গে মামাদাদুর আলাপ পরিচয় আগে হয় নি। আজই প্রথম হলো। খুব সহজেই পরিচয়পর্ব মিটে গেল। মামাদাদুর সঙ্গে এসেছেন বড় ছেলের বৌ লিসা। সে বিদেশিনী। খুব হাসিখুশি বৌমা।  তাঁর সাথেও সহজেই আলাপ হয়ে গেল।

 

মামাদাদুর বৌমা স্টিয়ারিং এ বসলেন। মামা বললেন, “এখন শহরে আর গাড়ি চালিয়ে আসি না। তাই লিসাকে নিয়ে এলাম।” বৌমা হেসে বললেন, “নো মিস্টার সিনহা। ইউ আর স্টিল ড্রাইভিং গুড।”

 

 

গাড়ি এগিয়ে চলল। মামাদাদু কথা শুরু করলেন। নাম তাঁর কুমারেশ চন্দ্র সিনহা। ১৯৩৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রংপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হাওড়ায় তাঁর অনেকটা সময় কেটেছে। ষাট বছর ধরে আমেরিকায় রয়েছেন। সিটিজেনশিপ পেয়ে গেছেন অনেক বছর আগে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইন্জিনিয়ারিং পাস করে এদেশে এসে পি এইচ ডি করেছেন। এবং এখানকার পাড়ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের Distinguished Professor হয়েছেন। অবসর নিয়েও আবার এমিরিটাস প্রফেসর হয়ে আজও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। লাফায়েতের বহু প্রতিষ্ঠানের মাননীয় সাম্মানিক সদস্য। মামাকে ৮৬ বছর বয়স হয়েছে দেখে মনে হয় না। আজও বেশ হ্যান্ডসাম। চেহারাটা একদম সাবেকি বাঙালিয়ানায় সাজানো। শুধু কথা বলার সময় বাংলায় একটু অসুবিধা হয়। গড় গড় করে আর বলতে পারছেন না।

মামাদাদু বিয়ে করেছিলেন বিদেশিনী অ্যানকে। নিজের পছন্দের পাত্রী ছিলেন অ্যান। তাঁদের পাঁচ সন্তান। দুই মেয়ে, তিন ছেলে। ছেলের ঘরে পাঁচ নাতি নাতনি। মামাদাদুর পরিবারের সবাই আমেরিকান। মামাদাদুই একমাত্র বাঙ্গালি-আমেরিকান। দিদাকে হারিয়েছেন ন’বছর আগে। ৪৮ বছর বিবাহিত জীবন কাটিয়েছেন। আজ মামাদাদু বিশাল এক বাড়িতে একা থাকেন। দু’ ছেলে কাছাকাছি থাকেন। ছোট ছেলে একটু দূরে আমেরিকার কলোরাডোতে। এমন একজন বাঙালি-আমেরিকান মানুষকে আমি প্রথম দেখলাম। মুগ্ধ হলাম।

বড় ছেলে রাহুন নরম্যান সিনহা সিভিল ইন্জিনিয়ার। মেজ ছেলে অর্জুন ড্যানিয়াল সিনহা ডাক্তার। মেজ বৌমাও ডাক্তার।  ছোট ছেলে  ঈশান এডম্যান সিনহা চাকরী করেন আমেরিকান পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে। দুই মেয়ে সোহিনী সারা ও নবীনা জাস্টিন সিনহা। এক মেয়ে চাকরি করেন FBI তে। এক মেয়ে ল’ ইয়ার। দুজনেই আমেরিকায় আছেন। এমন একজন সফল কৃতী আশ্চর্য বাঙালিকে দেখে এবং তাঁর সাথে অনেক কথা ও গল্প করে আমি যেমন মুগ্ধ হয়ে গেছি, তেমন ঋদ্ধ হয়েছি। এক মুহূর্তের জন্যও কোনও হা হুতাশ নেই। জীবন যেমন চলছে, তেমন করে মানিয়ে নিয়ে চলেছেন। খুব পজিটিভ এনার্জি এখনো তাঁর মধ্যে রয়েছে। সন্তানরা কি সুন্দর মামাকে “বাবা” বলে ডাকছেন, ড্যাড নয়। ওঁদের সন্তানরাও দেখলাম “বাবা” বলছে। ড্যাড বলছে না। নাতি-নাতনিরা কুমারেশবাবুকে ‘দাদু’ বলে ডাকছে। এই একটা জায়গায় ওরা বাঙালি বংশোদ্ভূত  হয়ে রয়েছে। বাকিটা পুরোপুরি আমেরিকান।

কুমারেশবাবু থাকেন ইন্ডিয়ানাপোলিস এয়ারপোর্ট থেকে অনেক দূরের সুন্দর গ্রামীণ জনপদের মত এক অপূর্ব জায়গায়, নাম তার – WEST PORT।  আমরা এখন সরাসরি তাঁর বাড়ি যাচ্ছি না। আজকের সারাদিনের প্রোগ্রাম সুন্দর সাজিয়ে রেখেছেন আমাদের জন্য। যেহেতু আমরা এখানে এক রাতের অতিথি তাই খুব দ্রুত যতটুকু দেখিয়ে আমাদের ভ্রমণকে সুন্দর করা যায় চেষ্টা করেছেন।

এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়েই বলেছেন, প্রথমে আমরা  যাব ব্রড রিপিল। সেখানে মেজ ছেলে অর্জুনের বাড়ি। সেই জনপদে একটা সুন্দর ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা সবাই মিলে ওখানে লাঞ্চ করব। মেজ ছেলে অর্জুনের পরিবারও থাকবে। তারপর আমরা চলে যাব লাফায়েত ডাউনটাউনে। সেখানে বড় ছেলে রাহুল থাকেন। আলাপ হবে তাঁর সাথে। তারপর চলে যাব ALAMO। এখানে তাঁর অসাধারণ এক বনবাংলো রয়েছে। সোহমের কাছে আগেই জেনেছিলাম এই জঙ্গলের মধ্যে মামার বনবাংলোর কথা। তাই ভীষণ কৌতূহল রয়েছে দেখার। Alamo তে বিকেলের কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসব WEST PORT। এখানে তাঁর বসতবাড়ি। যেহেতু তিনি বাড়িতে একা থাকেন তাই আজ ডিনারের ব্যবস্থা করেছেন ওয়েস্ট লাফায়েতের বিখ্যাত এক  Restaurant THAI ESSENCE এ। সেখানে বড় ছেলের পরিবারও আসবে। সবাই মিলে ডিনার করব। আজ সারাদিন আমাদের এই ভ্রমণ সূচী।

লিসা গাড়ি চালাচ্ছেন। এয়ারপোর্ট ছেড়ে শহরের রাস্তা ধরে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি। নতুন শহর। অচেনা মহাদেশ। সব কিছু নতুন লাগছে। দূর থেকেই দেখতে পেলাম মূল শহরের বড় বড় বাড়িগুলোকে। উড়ালপুল দিয়ে একরকম উড়তে উড়তেই যেন চলেছি। লিসা খুব দক্ষ চালক। কথা বলতে বলতেই সুন্দর ড্রাইভ করছেন। ইন্ডিয়ানাপোলিসের ডাউনটাউনে এবার ঢুকে পড়লাম। চারপাশে ছড়ানো সুন্দর সুন্দর সব হাইরাইজ, অফিস, কলেজ, মার্কেট প্লেস, শপিং মল, হসপিটাল। চোখের ঝলকে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। শহরটা বেশ সাজানো। রাস্তাঘাটে লোকজন রয়েছে, কিন্তু শহরের তুলনায় কম। তাই চারপাশকে বেশ নির্জন পরিচ্ছন্ন লাগছে।

ব্রড রিপিল আসতে কমবেশি এক ঘন্টা লাগল।

আমেরিকার এই ছোট ছোট জনপদগুলো এক কথায় অপূর্ব। হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি থাকে। এবং সেই পাড়া অনুযায়ী বাড়ির গঠন, বাড়ির লন- বাগান ও রঙ থাকে খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ। চোখের জন্য বড় আরাম। আর মনের জন্য দারুণ তৃপ্তি।

অর্জুনের বাড়িটা তেমনই সুন্দর। বেশ বড় ছড়ানো বাড়ি। তিন সন্তান নিয়ে ওরা পাঁচজন থাকেন। আর রয়েছে ওদের মস্ত বড় এক ডগ। আমেরিকানরা প্রায় সবাই বাড়িতে প্রিয় পোষ্য হিসেবে ডগ রাখেন। এবং তাকে যে ভাবে আদর যত্ন করেন তা দেখে অবাক হতে হয়।

অর্জুনের বাড়িতে একটু বসে আলাপ পরিচয় পর্ব মিটতেই আমরা চলে গেলাম টেবিল বুক করে রাখা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে – “The Little India”। পাশেই ছিল এই ছোট্ট সুন্দর রেস্টুরেন্ট। মালিক দক্ষিণ ভারতের মানুষ। সম্ভবত হায়দরাবাদ বলেছিলেন।

লাঞ্চের মেনুর অনেক অপশন ছিল। ইন্ডিয়ান ডিশ অনেক রয়েছে। আমি একটু ভেতো বাঙালি সেজেই বললাম, “আজ মাছ ভাত খাব।” ডুলুং-সোহম খেল চিকেন বিরিয়ানি। লিসা নিলেন ওর পছন্দের ডিশ। অর্জুন প্রথমে এক প্লেট সিঙাড়া খেল সপরিবারে। এটা নাকি ওরা খুব পছন্দ করে। মামা নিলেন ভাত আলু ফুলকফির তরকারি। মামা খুব অল্প খাওয়া দাওয়া করেন। ড্রিংক্সেরও অনেক অপশন। কোল্ড ড্রিংক্স, হার্ড ড্রিংক্স, বিয়ার। অনেকেই কোল্ড ড্রিকিংস নিল। আমি নিলাম আমেরিকান বিয়ার- CORONA।

গরম ভাত ও মাছের ঝোলের সাথে আমাকে দিয়েছিল একটা গার্লিক চাপাটি। এত সুন্দর লেগেছিল এই গার্লিক চাপাটি। মনে থাকবে, ভুলতে পারব না। আমেরিকান বিয়ার ভালোই লাগল। মাছের ঝোল মানে তেলাপিয়ার কারি। রান্নাটা বেশ ভালো। খাবার টেবিলে প্রচুর গল্প হল। খাওয়াও হলো অনেক। সবশেষে গোলাপ জামুন। একদম ইন্ডিয়ান ফ্লেভার ও অ্যামবিয়েন্স নিয়ে ছোট্ট রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে বসে খেয়ে বেশ মজা হল।

এবার মেজো ছেলে সপরিবারে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে সবাইকে গুডবাই। মামাকে জড়িয়ে ধরে অর্জুন বলল, “বাবা,  Stay Alive ” বাবাও কি সুন্দর বললেন, “টেক কেয়ার।”

লিসা আবার ড্রাইভিং সিটে। এবার যাব লাফায়েত শহরের ডাউনটাউনে। সেখানে লিসাদের বাড়ি। বড় ছেলে রাহুলের সাথে আলাপ হবে।

ব্রড রিপিল থেকে লাফায়েত ডাউনটাউন অনেকটা রাস্তা। সুন্দর স্টেট হাইওয়ে। গাড়ি দুরন্ত ছুটছে। আমরা গল্প করছি। নানান ধরনের গল্প হচ্ছে। লিসা এক মনে ড্রাইভ করছেন। মামা  দেশের সব খবরই মোটামুটি রাখেন। কথা বলতে বলতে কলকাতার কথাও উঠে এল। মামারও আর জি কর কান্ডের জন্য মন খারাপ। এটা খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জার। প্রবাসী মানুষজনদের কাছে দেশের এই সব খবর সব সময়ই খুব লজ্জার হয়।

হাইওয়ের দু’ধার কি সুন্দর শস্যশ্যামলা হয়ে আছে। মাঠের পর মাঠ ভুট্টা চাষের জমি। সয়াবিন চাষের খেত। আলুর বাগান। আমেরিকায় এই তিন ধরণের চাষ খুব চোখে পড়ল। এত শস্যশ্যামল একটা মহাদেশ। শস্যভান্ডারও কত বড় তাহলে। অথচ খাওয়ার লোক কত কম!..রপ্তানি করে তাই ডলারকে আরও আরও শক্তিশালী করে তুলছে। সারাবিশ্বকে কর্ণ খাওয়াচ্ছে। পটেটো চিপস খাওয়াচ্ছে। আমরাও কেমন কর্ণ, বেবি কর্ণ খাওয়া শিখে গেছি! এখন বেবিকর্ণের কি জনপ্রিয়তা। প্যাকেট খুললেই ফুরুৎ সেই পটেটো চিপস্ও খুব চলছে। আমেরিকা শিল্পের মত কৃষিতেও ভীষণ শক্তিশালী। তাই ওরা সারাবিশ্বে অনায়াসে দাদাগিরি করতে পারে। আর একটা জিনিস ওরা কিন্তু খুব শান্ত অথচ শাণিত! বাইরে থেকে বোঝা যায় না।

লাফায়েত ডাউনটাউনের বড় রাস্তার পাশেই বড় ছেলে রাহুলের বাড়ি। বেশ অদ্ভুত ধরণের বাড়ি।

বাইরেটা একদম কাঠ দিয়ে এমন ভাবে ঢাকা মনে হবে গোডাউন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। কি সুন্দর করে সাজানো গোছানো। বাড়ির প্রতিটি কোণে, দেওয়ালে শিল্পকর্ম রয়েছে। এটাও বলার মত, ওরা সবাই বাড়ি সাজাতে চিত্রকলাকে খুব ব্যবহার করে।

ঘরের দেওয়ালে নানান ধরণের পেইন্টিং থাকবে। এই বাড়িতেও যথারীতি একটা বিশাল ডগ আছে। সে ছুটে এল নতুন অতিথিদের দেখে। তারপর গন্ধ শুকে ও রাহুলের কথা শুনে  পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। তারপর আর হাঁকডাক না করে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে।

রাহুলের সাথে আলাপ হল। একটু লাজুক। রাহুলের দুই ছেলে ধ্রুব ও প্রিয়। এক মেয়ে নিকো। ওরাও বাড়িতে ছিল। বেশ লম্বা সুন্দর চেহারার তিন সন্তান। সোহমকে দেখে তো কি খুশি, চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও সোহম দাদা! ” তারপর ওদের সাথে একটু গল্প করেই বেরিয়ে পড়লাম ALAMO র উদ্দেশে। সেখানে মামাদাদুর বনবাংলো রয়েছে।

এবার চালকের আসনে মামাদাদু স্বয়ং। লিসা বাড়িতে থেকে গেল। সোহম একবার মৃদু স্বরে বলল, ” আমি কি ড্রাইভ করব?”

মামাদাদু হেসে বললেন, “নো। তুমি আমার পাশে বসো। “

৮৬ বছরের একজন মানুষ ড্রাইভিং সিটে বসলেন একদম স্বাভাবিক ভাবে। মার্সিডিজ বেঞ্জ। সুন্দর ইন্টেরিয়র। সব ব্যবস্থা আধুনিক। নিজের গাড়ি, তাই চালাতে খুব স্বচ্ছন্দ দেখলাম কুমারেশবাবুকে।

লাফায়েত ডাউনটাউন থেকে Alamo পাক্কা এক ঘন্টার ড্রাইভ। এই পথটা মাঠ ঘাট জলাশয় বাগান নদী দেখতে দেখতে যাওয়া। আর আকাশও ছিল কি অপূর্ব নীল। ঠিক যেন, “নীলে নীলে অম্বর পর চাঁদ যব আয়ে…”চোখ জুড়ানো আমেরিকার এই গ্রামীণ নিসর্গ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীতেই বোধহয় সত্যিকারের গ্রামগুলো প্রায় একইরকম। আমাদের দেশেও আছে এমন সুন্দর সুন্দর নিটোল নির্মল গ্রাম। একটু লংড্রাইভ করে চলে যাওয়া যায় সেই সব নিসর্গের নিকুঞ্জে।

একজন ৮৬ বছরের প্রবীণ মানুষ কি সুন্দর গল্প করতে করতে ড্রাইভ করছেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আমার থেকে ২৫ বছরের বড়! যদি আমি ততদিন জীবিত থাকি এমন করে কি বাঁচতে পারব? পারব কি এভাবে লং ড্রাইভ করতে! জানি না। মনে প্রাণে সব সময় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করি, একাকিত্বকে অভিশাপ মনে না করে মানিয়ে নিয়ে সুন্দর ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে চলেছি। মামাদাদুকে এত কাছ থেকে দেখে এবং কথা-গল্প করে অনেকটা অনুপ্রাণিত হলাম। ভ্রমণে এই প্রাপ্তিগুলো বড় মূল্যবান।

আমাদের দেশে ৮৬ বছরের প্রবীণ মানুষজনরা বার্ধ্যকের ঘেরাটোপে কেমন বন্দী জীবন কাটান। ডাক্তারের হাজার নিষেধ মানতে মানতে বেঁচে থাকার মজাটাই  হারিয়ে ফেলেন। আমেরিকা বুড়ো হওয়াকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাঁচে। তাঁদের সঙ্গিনীকে বুড়ি মনে করেন না। কি সুন্দর রাস্তা ঘাটে, রেস্টুরেন্টে, নদীর ধারে দুজনে কুজনে ঘুরে বেড়ায়। হ্যাট পড়ে। কোল্ড কফি খায়!..বেশ  তো জীবন!..

মামাদাদুর জঙ্গলে ঘেরা মন কেড়ে নেওয়া বাড়িটার নাম SYCAMORE FORD। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে চলে এসে জঙ্গলের কাঁচা রাস্তা দিয়ে পৌঁছে গেলাম এই অপরূপ নির্জনপুরীতে। গাড়ি থেকে নেমে বিস্ময় আর কাটে না! কি নিপুণ ভাবে সব সাজানো। এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ। মনে হবে যেন আজ সকালেও কেউ পরিস্কার করে রেখে গেছেন। কিন্তু মামা আজ অনেকদিন পর এলেন। এখানে ধুলো, ময়লা, পলিউশন নেই। তাই সব কিছুই সুন্দর থাকে। বাড়িতে ঢুকে ঘরগুলো দেখে আরও মুগ্ধ হলাম। কতগুলো ঘর। সব ঘর পরিপাটি করে সাজানো। দামী দামী আসবাবপত্র। কত বই। পেইন্টিং। একজন শিক্ষিত পড়ুয়া মানুষের ড্রয়িংরুম সাধারণত যেমন হয়, এ যেন তার চেয়েও বেশি সুন্দর।  আমি তো মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখছি। অর্থ দিয়ে কি সুন্দর পরমার্থ রচনা।

বাড়িটার বয়স প্রায় তিরিশ বছর। মামী অ্যানের কথা বারবার বলছিলেন। এই বাড়ি সাজানো ও বাড়ি রচনার সব পরিকল্পনা অ্যানের। অ্যানের স্মৃতিও রাখা রয়েছে বাড়ির বাগানে।

আমি সোহমকে বলেই ফেললাম, “তুমি যদি এই বাড়িটার কথা আমাকে আরেকটু বলতে, তবে আমি এখানে থাকার পরিকল্পনা করেই আসতাম।”

মামার সাথে পুরো বনবাংলো, বাগান, ওয়াচ টাওয়ার, সবুজ লনে ঘুরে ঘুরে অনেকটা সময় কাটালাম। বনবাংলোর পাশেই আছে এক সরু নদী-  ক্রিক। জল ছিল না তেমন। এই বনবাংলোর অনেক গল্প শুনলাম। এখন মামা আর বেশি আসতে পারেন না। কিন্তু ছেলে মেয়েরা নিয়মিত বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আসে। রাত্রিযাপন করে। তাই বাড়ির এয়ারকন্ডিশন সারাবছর অন করাই থাকে! ফলে ঘরগুলোতে ঢুকে কোনও বন্ধ বাড়ির ভ্যাপসা গন্ধ নেই। একদম ফ্রেশ। কোনও রুমফ্রেশনার দরকার হলো না!..

এখানে তো দিনের আলো অনেকক্ষণ থাকে। ঘড়িতে দেখলাম ছটা। কিন্তু  আকাশের আলো দেখে মনে হবে বিকেল চারটে। আজ আমরা খুব ভোরে বেরিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে নেমেই শুরু হয়েছিল ভ্রমণ। সূচী মেনেই সারাদিন বেড়ানো হলো। এবার চলে যাব West Port। মামাদাদুর বসতবাড়িতে। ফিরে আসার সময় একটু মনকেমন করছিল, ইশ্ একটা রাত এখানে থাকার আনন্দ অভিজ্ঞতাটা অধরা থেকে গেল!..

বিকেলের নরম আলোয় ফিরে আসছি। যে পথ দিয়ে গিয়েছিলাম সে পথেই ফেরা। আবার চোখজুড়ানো পথের দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে চলে এলাম West Port এ। এই ছোট্ট জনপদটাও অপূর্ব। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন তো বটেই, কি সুন্দর শান্ত নিরিবিলি। সারি দিয়ে অনেকটা করে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িগুলো। সব কটা বাড়িই আশ্চর্যরকমের সুন্দর ও পরিপাটি।

 মামাদাদুর বাড়ির কাছাকাছি এসে বাড়ির উন্মুক্ত লনে গাড়ি উঠতেই ম্যাজিকের মত চিচিংফাঁক হল- গ্যারাজের দরজাটা  সুন্দর উঠে গেল। কেউ তো খুলে দিল না!.. রিমোট কন্ট্রোলে খুলে গেল। গাড়ি ঢুকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এমন অভিজ্ঞতা আগে আমার ছিল না। তাই বেশ মজা পেলাম। ভালোও লাগল। সত্যিই গাড়ি গ্যারেজ খুলে বের করা ও ঢোকানো যে কি ঝঞ্জাটের কাজ! সেটা যদি এমন রিমোট কন্ট্রোলে করা যায় তো দারুণ। বাহ্ আমেরিকা। নতুন জিনিস শিখলাম।

মামাদাদুর বাড়িটাও বড় সুন্দর। একজন মানুষ খুব রুচিশীল না হলে এভাবে বাড়ি সাজিয়ে রাখতে পারবেন না। মামা আজ ন’বছর ধরে একা থাকেন। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে মনে হবে না ৮৬ বছরের মানুষটা একা থাকেন! এত বড় বাড়িটা এমন সুন্দর করে প্রতিটা ঘরকে কে সাজিয়ে গুছিয়ে  রাখেন! সারা পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর জিনিসের সংগ্রহ এ বাড়ির সর্বত্র।

আজ সারাদিনে আমাদের স্নানের সুযোগ হয় নি। তাই আগে স্নান করে নিলাম। মামাদাদু ইতিমধ্যে চা করে টি পটে সাজিয়ে ফেলেছেন। সুন্দর একটা টি কর্ণারে বসে চা পান করতে করতে অনেক গল্প হল। তখনই জানলাম, মাসে দু’বার পনেরো দিন অন্তর দু’জন জার্মান লেডি এবাড়ির সব কাজ সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করে দিয়ে যান।

আজ ডিনারের টেবিল বুক করা আছে Thai Essence এ। বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়।  মামাই গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পথে দূর থেকে দেখলাম একটা পার্ক ও ফোয়ারা। হাতে সময় নেই, তাই পার্ক ঘুরে দেখা হলো না। আমেরিকা যেন এক পার্কের দেশ। সব শহরে একাধিক পার্ক থাকবেই থাকবে।

থাই এসেন্সে পৌঁছেই দেখলাম বড় ছেলে রাহুল, লিসা, ওদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে বুক করা টেবিলে বসে রয়েছে। আমরা পৌঁছতেই হৈ হৈ করে উঠল। কি আনন্দ।  কি মজা! দাদু ঢুকেই বলে দিলেন, “তোমাদের যার যা পছন্দ অর্ডার দাও। মিস্টার সরকার আপনি কি কোনও ড্রিংক্স নেবেন?”

সকালে বিয়ার খেয়েছি। এখন আর কোনও ড্রিংক্স নিলাম না। শুধু খাবার খাব বললাম। থাই খাবারের নাম আমি অত জানি না। বুঝিও না। ডুলুং সোহম আমার জন্য ডিশ ঠিক করল। আমি খেলাম চিকেন উইথ মাশরুম। ওরা খেল ক্যাট ফিশ কারি উইথ রাইস। মামাদাদু খেলেন একটা সুপ ও ফিস উইথ মাশরুম।

ডিনার করে ফিরছি হঠাৎ পথের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখে মনে হল হোমলেস পুওর আমেরিকান! সিওর হওয়ার জন্য বলেই ফেললাম, “এখানেও কি হোমলেসরা আছেন?”

মামাদাদু ড্রাইভ করতে করতে বললেন, “অফকোর্স।”

আমি বললাম, “এদের জন্য কোনও ভাবনা নেই সরকারের?”

“আছে। ওদের জন্য ফুড ব্যাঙ্ক ও নাইট শেল্টার আছে। কিন্তু সেগুলো ততটা কার্যকরী বা সফল নয়।”

“কেন কার্যকরী বা সফল নয়?” তা আর প্রশ্ন করলাম না! কদিন ধরে আমেরিকার শহরে শহরে,পথে ঘাটে এদের দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এরা অধিকাংশই মানসিক ভাবে অসুস্থ। ড্রাগ নেয়। চিকিৎসাও দরকার। কাউন্সেলিং প্রয়োজন। সামনে থেকে দেখলে ভয় করে। আমেরিকাও যদি নিজের দেশের এই সামান্যদের না দেখে তো কে দেখবে? জানি না কেন এই উদাসীনতা বা অবহেলা এদের জন্য?

Thai Essence থেকে ডিনার করে বাড়ি ফিরে আর দেরী নয় সকলেই ক্লান্ত শরীরে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

কাল সকালে আমরা একটু লেটে বেরিয়ে একদম BRUNCH করব শহরের এক রেস্তোরাঁ – Town and Gown Bistro তে। টেবিল বুক করা আছে, মামাদাদু এটা জানিয়ে দিলেন।

আগামীকাল সকালে মামাদাদুর ইউনিভার্সিটি দেখে আমরা দুপুরের Greyhound বাস ধরে সরাসরি চলে যাব শিকাগো।

শুভরাত্রি!..

আজকের সকালটা একটু দেরী করেই শুরু হলো। চায়ের টেবিলে জড়ো হলাম চারজন আটটার সময়। টানা একঘন্টা নানান গল্প হলো। মামাদাদুর ষাট বছর আমেরিকা বাসের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো শুনতে ভালো লাগছিল। শুধু আমেরিকা কেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দিয়ে দিয়ে। চিনে তিনবার গেছেন। জাপান, রাশিয়া গেছেন। বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও আরও নানান দেশে গেছেন সেই সব দেশের সরকারী আমন্ত্রণ পেয়ে। তাই তাঁর ড্রয়িংরুম এক যাদুঘর। নানান দেশের জিনিস দিয়ে  বৈচিত্র্যময় করে সাজানো।

শহরের মধ্যেই সুন্দর এই রেস্তোরাঁ Town and Gown Bistro। টেবিল বুক করাই ছিল। ঢুকে বুঝলাম এই সব জায়গাগুলোয় মামাদাদু নিয়মিত আসেন বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে।

BRUNCH এর ডিশ ডুলুং-সোহম ঠিক করল। মামাদাদু নিলেন এগ স্যান্ডউইচ সঙ্গে ভার্জিন মেরি ড্রিংক্স। সোহম-ডুলুং নিল অ্যালফ্রেডো পাস্তা, স্মোক সলমন। আমার জন্য এলো ওমলেট উইথ স্মোক সলমন্।

সঙ্গে ব্লাডি মেরি ড্রিংক্স।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম পাড়ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশাল এরিয়া জুড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়। কি সুন্দর করে সাজানো চারপাশ। ফুলের বাগান থেকে ঝর্ণা সব আছে।  মামাদাদু আজও যুক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে।  বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। জানলাম নীল আমস্ট্রং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাঁর নামে বিল্ডিং রয়েছে।  NEIL ARMSTRONG HALL OF ENGINEERING। আর্মস্ট্রং এর একটা সুন্দর পাথুরে মূর্তিও রয়েছে।

তারপর আমরা গেলাম তাঁর নিজের রুমে। কত পুরস্কার, প্রশংসাপত্র, বই, স্মৃতিচিহ্ন সারা অফিস জুড়ে। আর রয়েছে অনেক থিসিসের সংগ্রহ। সব দেখালেন। বিদেশে এমন একজন সফল, গুণী  অপরাজিত বাঙ্গালিকে দেখে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। আমেরিকায় তাঁর কত সম্মান। বয়সটা যে একটা সংখ্যামাত্র এমন মানুষজনদের চোখের সামনে দেখলে সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।

গতকাল সকাল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত যেভাবে আমাদের কত কিছু দেখালেন, আদর যত্ন করে খাওয়ালেন, পরিবারের অনেকের সাথে আলাপ পরিচয় করালেন – তার কোনও তুলনা হয় না। এই আন্তরিকতাকে প্রণাম জানাই।

Greyhound এর বাস ধরার সময় হয়ে এলো।

আমরা এবার ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাস স্টেশন সামনেই। ডুলুং সোহম গাড়ির দিকে আসছে। আমি আর কুমারেশবাবু দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে সময় হঠাৎ তিনি বললেন, “জীবনটা একটা মায়া বুঝলেন। সব করে যেতে হবে। কিন্তু মায়ায় জড়ালে চলবে না।” একটু থামলেন।  তারপর আবার বললেন, “আমি স্ত্রীকে হারিয়েছি সাতাত্তর বছর বয়সে। আপনার টু আর্লি! বাট কিছু করার নেই। লাইফ ইজ গোয়িং অন। এগিয়ে যেতে হবে। আবার সময় সুযোগ করে আসবেন।”

অনেক ধন্যবাদ এবং গভীর কৃতজ্ঞতা জানালাম।

Greyhound বাস এসে গেছে। শিকাগোয় চলে যাব। আমেরিকায় এসে এই প্রথম দূরপাল্লার বাসে উঠলাম। গুডবাই ইন্ডিয়ানাপোলিস। বিদায় লাফায়েত। একটা নতুন শহরে একটা দিনরাত্রি কাটালাম একজন প্রিয়জনের সাথে। অনেক স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। বিদায় মুহূর্তে একটু মন কেমন তো করবেই। আমাদের দুজনের চোখেই ছিল রোদচশমা। মনটা ছিল বিষন্ন। তাই চোখের তারায় বৃষ্টি ছিল কিনা কেউ কারোরটা আর দেখতে পেলাম না!..

ভালো থাকবেন কুমারেশবাবু।

আমেরিকা গুণীর কদর করতে জানে। তাই তো আর আপনার ফেরা হলো না স্বদেশে!..

শিকাগোর পথে বাস এগিয়ে চলেছে।..

।। শুভ অপরাহ্ন।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

1 Response

  1. Ramesh Chandra Das says:

    বেশ ভাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।